একদম শুরু থেকেই সৃজনশীল পদ্ধতিকে ঘৃণার চোখে দেখে এসেছেন এক শ্রেণির শিক্ষক, অভিভাবক ও তাদের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা। এ পদ্ধতি নাকি শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আধুনিক ভাবনা কোনোকালেই কারো ছিলো না। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থা যদি ধ্বংস হয়ে থাকে, এর জন্য সৃজনশীল পদ্ধতিকে আমি অন্তত দায়ী করবো না। আমাদের সর্ষের ভেতরেই ভূত। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই হুট করে এ পদ্ধতি চালু করে দেওয়া এবং বাজারে পাওয়া গাইড বইয়ের ওপর শিক্ষক যখন নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তখন শিক্ষাব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে বইকি! কিন্তু এর জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি দায়ী হয় কী করে? দায়ী যদি হয়ে থাকে তবে সেটা সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিই দায়ী। শিক্ষকদের সৃজনশীলতার চর্চা আছে কি নেই, সে কথায় পরে আসছি।
সৃজনশীল পদ্ধতি মূলত ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ বেঞ্জামিন ব্লুমসের ট্যাক্সোনমির ওপর ভিত্তি করে চালু করা হয়। এ পদ্ধতিটি বৈজ্ঞানিক এবং এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, অনুধাবন, মনোপেশিজ দক্ষতা, বাস্তব জীবনে অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ ইত্যাদি দক্ষতার মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। যদিও শুধুমাত্র খাতা কলমের পরীক্ষা পদ্ধতিতে মনোপেশিজ দক্ষতা মূল্যায়ন করার কোনো উপায় রাখা হয়নি। তারপরও গতানুগতিক মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার একটি দরজা এর মাধ্যমে খোলার সুযোগ হয়েছিলো। কিন্তু এ পদ্ধতি চালুর আগে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়ার কারণে, এটিকে কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেও সৃজনশীলতার চর্চা না থাকায়, এই নতুন পদ্ধতিটিকে রীতিমতো শত্রুজ্ঞান শুরু করে দিলেন বেশিরভাগ ব্যক্তি। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে। ফলাফল সেই ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’-এর মতো শেষ পর্যন্ত সৃজনশীলতার মোড়কে মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাই চালু রইলো। শিক্ষকদের জন্য সহায়িকা হলো বাজারের সস্তা মানের গাইড বই। প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলো না। শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হলো না। এর ফলে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’এর মতো সব দোষ গিয়ে পড়লো ‘বেচারা’ সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর।
এবার ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলো। প্রথম পর্যায়ে অনলাইনে নেওয়া প্রশিক্ষণগুলো একজন শিক্ষক ঠিকমতো না করেও দিব্যি এক বা একাধিক সনদ বাগিয়ে নিতে পারেন। ইউটিউবে সব প্রশ্নের সমাধান দেওয়া ভিডিও দেখে সহজেই উত্তর দিয়ে দেওয়া, আর সনদও পাওয়া যায় প্রশিক্ষণ না করেই। সুতরাং অনলাইনের প্রশিক্ষণগুলো কতখানি কার্যকরী প্রশিক্ষণ হয়েছে, এ প্রশ্ন রয়েই গেলো। এবার অফলাইনের প্রশিক্ষণগুলো যদি যথাযথভাবে পরিচালনা করা হয়ে থাকে, শিক্ষকেরা যদি এর থেকে প্রেষণা (মোটিভেশন) পান এবং নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে এর সঠিক প্রয়োগ করতে পারেন, তাহলে এটিকে সফল বলা যাবে।
আগের সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে আগে থেকেই এক শ্রেণির ব্যক্তির ডিমোটিভেটেড হয়ে আছেন, ফলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়েও অনেকের মনে অনেক দ্বিধা। নতুন শিক্ষাক্রমে বেঞ্জামিন ব্লুমসের ট্যাক্সোনমির ওপর ভিত্তি করে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। গতানুগতিক মুখস্থ বা কাগজ কলমের মূল্যায়নের বদলে মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আসছে। বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে বরং নতুনত্বকে পজিটিভলি গ্রহণ করার মানসিকতা থাকা দরকার। এর মাঝে যদি কোনো ত্রুটি থাকে তবে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করে দ্রুত সংশোধন, পরিমার্জন করা দরকার। কিন্তু তাই বলে পুরো পদ্ধতিটিই অকার্যকর, এমন ধুয়ো তোলা উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন।
নতুন শিক্ষাক্রমে আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, নবম-দশম শ্রেণি থেকে আর বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগ থাকবে না। এটিও অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বছরের শুরুতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাগ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যায়। গতানুগতিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বাছাই করে দেওয়া হয়। অথচ আমরা ভুলে যাই, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে অনেক ভালো ফলাফল করলেও জীববিজ্ঞানে সাফল্যের সঙ্গে ফেল করতেন। তাই তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করতে চায়নি। ভাগ্যিস, পরবর্তী সময় তাকে ভর্তি করে নেয়ায় আমরা আইনস্টাইনকে এত বড় বিজ্ঞানী হিসেবে পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গতানুগতিকভাবেই শিক্ষার্থীর বিভাগ বাছাই ও ভর্তি করা হয়ে থাকে। ফলে অনেকেই নিজের পছন্দের বিভাগ পায় না। আবার বিজ্ঞান বিভাগে পড়েও তাদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হচ্ছে না। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ পাওয়ার জন্য এত সংগ্রাম করা শিক্ষার্থীও পরবর্তী সময়ে দেখা যায় অবলীলায় বিভাগ বদলে ফেলছে। তাহলে মাধ্যমিক স্তরে আলাদা বিভাগ রাখার যৌক্তিকতা কী? বরং এ স্তরে সকল শিক্ষার্থীকেই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বিজ্ঞান পড়তে হবে। তাতে বরং সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
নতুন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষই বেশি করে দরকার।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক।