ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ উত্তেজনা বিরাজ করছে। ১ অক্টোবর রাতের প্রথম ভাগে ইরান থেকে ইসরায়েলের ওপর মারাত্মকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর এই উত্তেজনা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা সবাই জেনেছি, ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার থেকে অন্তত ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েলের ওপর। তবে ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য তারা ৪০০-এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে অন্তত ২০০ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র।
ইসরায়েল প্রথম দিকে এ হামলাকে ব্যর্থ হামলা বলেছিল। এ কথা বলেছিলেন খোদ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ব্যর্থ করার জন্য তিনি তার সামরিক বাহিনীকে খুবই বাহবা দিয়েছিলেন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীও ওই হামলাকে ব্যর্থ বলেছিল। এসবই যে আসল ঘটনা লুকানোর চেষ্টা ছিল, তা রাজনীতির জটিল কুটিল হিসাব-নিকাশ না জানা মানুষও প্রথম দিকেই বুঝতে পেরেছেন।
হামলার পরপরই সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে এক্স ডটকম (সাবেক টুইটার) যেভাবে ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে, তাতে একেবারেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বিপুলসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন অবস্থানে আঘাত হেনেছে। সে আঘাতের দৃশ্য আমরা দেখেছি ভিডিওগুলোতে। তাতে দেখা গেছে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে এবং আগুনের গোলা উঠছে। রাতের অন্ধকারে তেল আবিবের আকাশ আলোকিত হয়ে উঠছে, বারবার আগুনের মতো লাল গোলা আকাশের অন্ধকারকে আলোর ঝলকানি দিয়ে স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
হামলার পরপরই ইরান জানিয়েছিল, তারা এই হামলায় ২০০ ফাত্তাহ-১ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এর পাশাপাশি তারা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করে। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের শতকরা ৯০ ভাগ সফলভাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে। ইরান জানিয়েছিল, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে পারেনি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। শুধু তা-ই নয়, হামলার পরপরই ইরান জানিয়েছিল, তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের নেভাটিম বিমানঘাঁটি, নেটজারিম বিমানঘাঁটি এবং তেল নফ ঘাঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তেল আবিবে অবস্থিত মোসাদের সদর দপ্তরেও আঘাত হেনেছে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র।
ইরান জানিয়েছিল, হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়া এবং হিজবুল্লাহ প্রধান সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহসহ বড় বড় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ইসরায়েল, তাতে এসব বিমানঘাঁটি ও গোয়েন্দা সদর দপ্তর কাজে লাগিয়েছে ইসরায়েল সেনারা। তার প্রতিশোধ নিতে সেসব বিমান ও সেনাঘাঁটি এবং গোয়েন্দা সদর দপ্তরে হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলায় ঘাঁটিগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ইরান জানিয়েছিল।
কিন্তু ইসরায়েল সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কথা নাকচ করে দেয়। তারা দাবি করে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এক শিশু সামান্য আহত হয়েছে এবং বিক্ষিপ্তভাবে ফাঁকা জায়গায় ও মরুভূমিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে। কিন্তু কোথায় কোথায় ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে এবং তার ফলে আসলেই কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য ইসরায়েল কিংবা বাইরের কোনো গণমাধ্যমকে অনুমতি দেয়নি। এমনকি এই সংক্রান্ত খবর, তথ্যচিত্র ও ভিডিও প্রকাশ করার ব্যাপারে ইসরায়েল সরকার তার দেশের গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করে।
এর ভেতরে আমেরিকার কোনো কোনো গণমাধ্যম কিছু কিছু তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যায় ইসরায়েলের যেসব বিমান ও সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল, সেগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি ভালোই হয়েছে।
এরপর ইসরায়েল ধীরে ধীরে স্বীকার করতে শুরু করেছে তাদের বিমান ও সামরিক ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে; তবে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। মোসাদের সদর দপ্তরে হামলা সম্পর্কে বলেছে, মোসাদ সদর দপ্তরের বাইরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে তো ওয়ার হেড ছিল এবং তাতে যথেষ্ট পরিমাণে বিস্ফোরক ছিল। সেসব ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পরে বিস্ফোরণ হয়েছে, আগুনের গোলার মতো উঠেছে এবং বিকট শব্দ হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওর কল্যাণে সবই দেখা গেছে, শোনা গেছে। তাহলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমান ঘাঁটি বা সামরিক ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি হয় না কীভাবে? ইসরায়েলের এই লুকোচুরির কারণে এখন মোটামুটি বেশির ভাগ মানুষই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রে বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ইসরায়েল।
শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের যদি সামান্য ক্ষতি হতো তাহলে নিশ্চিতভাবে ইরানের ওপর পাল্টা হামলা চালানোর কথা, ইসরায়েলের দেওয়া হুমকিধমকি তো তেমনই ছিল। হামলার পরপরই নেতানিয়াহু বলেছিলেন যে ইরান বড় একটা ভুল করেছে এবং তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। কিন্তু ইরানি হামলার পাঁচ দিন পরেও ইসরায়েল কোনো পাল্টা হামলা করেনি। ব্যাপারটা মোটেই ইসরায়েলের জন্য শুভ ইঙ্গিত বহন করছে না বরং তাদের দুর্বলতা প্রকাশ করছে।
ইসরায়েল এমন এক শক্তি, যাদের বিরুদ্ধে কেউ ফুলের পাপড়ি ছুড়লেও তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, বিমান হামলা চালায়। আর সেখানে ইরান দুই-দুইবার হামলা চালালো অথচ ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, এটা ইসরায়েলের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যায় না।
এখন শোনা যাচ্ছে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর বিষয়ে পরিকল্পনা করছে এবং তারা পরিকল্পনার মাঝপথে রয়েছে। শনিবার টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, সামরিক বাহিনী ইরানের বিরুদ্ধে হামলার জন্য পরিকল্পনা করছে তবে এই পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী এবং যুদ্ধমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাবে, সে কথা ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তেহরান পরিষ্কার করে বলে আসছে। এরপরে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এরপরেও ইসরায়েল কি ভাবেনি যে ইরান হামলা চালালে তাকে কোন পদ্ধতিতে বা কোন কৌশলে, কোনভাবে ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দিতে হবে? নিশ্চয়ই ভেবেছে। ইসরায়েল ভাবেনি বা পরিকল্পনা ও কৌশল ছিল না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে যে নেভাটিম নেটজারিম এবং তেলনফ ঘাঁটিগুলো এতটাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে এই ঘটনার পর ইসরায়েলকে ইরানে হামলা চালানোর আগে দশবার ভাবতে হচ্ছে।
অথবা মধ্যপ্রাচ্যের যেসব মিত্রদেশের বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে ইরানের ওপরে ইসরায়েল হামলা চালাতে চেয়েছিল, সেই সব দেশ ইরানের হামলার ভয়াবহতা এবং প্রভাব দেখে ইসরায়েলকে এখন তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিতে রাজি হচ্ছে না।
এ কথা পরিষ্কার যে ১ অক্টোবরের হামলায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের সমস্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে ইসরায়েলের ওপরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তা প্রতিহত করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল যদি ইরানের ওপর হামলা চালায়, তাহলে তার পাল্টা আঘাত যেটা হবে, তা হজম করার ক্ষমতা ইসরায়েলের আছে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন। কারণ, ইসরায়েল খুবই সামান্য ভূখণ্ডের অধিকারী। পক্ষান্তরে ইরান বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী। ইরানকে হামলা করে ধ্বংস করা একেবারে কঠিন কাজ। সে জায়গায় অল্প সময়ের ভেতরে পুরো ইসরায়েলকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া সম্ভবত এখন আর ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়।
অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে ইরানের বিরুদ্ধে একমাত্র বড় ক্ষয়ক্ষতি ঘটানোর ব্যবস্থা হলো পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করলেও যে ইসরায়েল নিরাপদ থাকবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ ইরান কোনোমতেই ছেড়ে কথা বলবে না, এমনকি ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে, না তারই-বা নিশ্চয়তা কোথায়? এত বছর ধরে ইরান পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে আসছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে তার বোঝাপড়া চূড়ান্ত হবেই, এটাও দীর্ঘদিনের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। ফলে পরমাণু শক্তি অর্জন না করেই ইরান পরমাণু শক্তিধর ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে, এটা বিশ্বাস করা বা ভাবা যুক্তিসংগত নয়। ইরান বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছে তারা প্রয়োজনে পরমাণু ডকট্রিন পরিবর্তন করবে। ফলে ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালালে এটা ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ইসরায়েলি সেনারা মোটেই বিনা জবাবে পার পাবে না।
এদিকে আরেকটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি ইসরায়েল। যদি ইরানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক হামলার জবাব না দেয় তাহলে ইসরায়েলে বসবাসকারী ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকজন নিশ্চিত হয়ে যাবে যে ইরানের সামনে ইসরায়েল টিকতে পারবে না এবং ইসরায়েলে তাদের নিরাপত্তা এখন আর নিশ্চিত নয়। ফলে এসব বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েল ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু করবে। তখন ইসরায়েল প্রকৃতপক্ষে ভেতর থেকেই ধসে পড়বে, যা ইরান বহুদিন থেকে বলে আসছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সামরিক কর্তৃত্ব মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্নের মুখে পড়বে। এসব বিবেচনায় ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর চেষ্টা করবে।
এরই মধ্যে তারা ইরানের পরমাণু ও তেল স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। জবাবে ইরান বলেছে তাদের তেল স্থাপনায় হামলা হলে তারাও ইসরায়েলের তেল ও গ্যাস স্থাপনা পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। এ পর্যায়ে আমেরিকা ইসরায়েলকে ইরানের পরমাণু ও তেল স্থাপনায় হামলা না চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। যদিও আমেরিকার এ ধরনের আহ্বানের কোনো বিশেষ মূল্য ও মর্যাদা নেই। তবে ইসরায়েল যদি আমেরিকার এই পরামর্শ শোনে, তবে তার জন্য কল্যাণ হবে। আর ইরানের ওপর হামলার চিন্তা যদি পরিপূর্ণভাবে বাদ দেয় তাহলে সেটা হবে আরও বেশি কল্যাণকর। এ পর্যায়ে প্রশ্ন এসে দাঁড়াচ্ছে, ইসরায়েল কল্যাণের পথে হাঁটবে নাকি ধ্বংসের পথে হাঁটবে। ইরান কিন্তু বহুদিন ধরেই বলে আসছে, তারা ইসরায়েলকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে দেবে। তাহলে কি বিশ্ব সম্প্রদায় সেই যুগ-সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে?
সিরাজুল ইসলাম ।। কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক