১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে, সেই সঙ্গে অবসান ঘটে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার। বিশ্ব প্রবেশ করে নতুনতর এক ব্যবস্থায়। উত্থান ঘটে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে অনেকগুলো নতুন দেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন এমন একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, যেহেতু সোভিয়েত পরাশক্তির পতন ঘটেছে, কাজেই এখন মার্কিন পরাশক্তি বিশ্বময় প্রভুত্ব করবে, ছড়ি ঘোরাবে পুরো বিশ্বে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
দেখা যায় যে মার্কিন পরাশক্তিকে টেক্কা দিতে উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়া, জাপানের মতো নতুন নতুন শক্তির উত্থান ঘটছে, যারা মার্কিন পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে তৎপর। এ সময় বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গঠন করতে থাকে বিভিন্ন আঞ্চলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জোট। যাদের মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা এবং পরাশক্তিগুলোর আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করা। ব্রিকস মূলত এমনই একটি জোট।
ব্রিকস মূলত বিশ্বের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার নামের প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংঘ। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই সংঘে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে এটি ব্রিক নামে পরিচিত ছিল। ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই উন্নয়নশীল কিংবা সদ্য শিল্পোন্নত। কিন্তু এই দেশগুলোর রয়েছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব। ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি রাষ্ট্রই জি-২০-এর সদস্য। ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ব্রিকস রাষ্ট্রসমূহ আনুষ্ঠানিক সম্মেলন করে আসছে।
২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য রাষ্ট্র প্রায় ৩ বিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। পাঁচটি রাষ্ট্রের সম্মিলিত জিডিপি মোট বিশ্বপণ্যের প্রায় ২০ শতাংশ সমতুল্য। বর্তমানে ব্রিকস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট হিসেবে কাজ করছে।
ব্রিকসের সদ্য সমাপ্ত ১৫তম বৈঠকে আমন্ত্রিত দেশের অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধারণা করা হয়েছিল যে যেহেতু আমন্ত্রিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে, সেহেতু বাংলাদেশ হয়তো এবার ব্রিকসের সদস্যপদ পেতে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত জুনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ব্রিকস সম্প্রতি অতিথি হিসেবে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ব্যাংকে আমাদের সদস্য করেছে। ভবিষ্যতে তারা ব্রিকসে বাংলাদেশকে সদস্য করবে, আগস্ট মাসে ওদের সম্মেলন আছে।’
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে ব্রিকস সম্মেলনের পাশাপাশি বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘(চীন বলেছে) ব্রিকসে আপনি যাতে জয়েন করতে পারেন, সেই জন্য আমাদের সব সময় সমর্থন থাকবে।’
স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে এবার ব্রিকসের সদস্যপদ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সবশেষে ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলনে গত ২৪ আগস্ট দেখা গেল যে ব্রিকসের সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানানো নতুন ছয়টি রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামফোসা ঘোষিত এ ছয়টি দেশ হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিসর ও ইথিওপিয়া।
আমন্ত্রিত রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকা নিয়ে তাই চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। আমন্ত্রিত অতিথি হয়েও কেন বাংলাদেশ পিছিয়ে গেল সদস্য হওয়ার দৌড়ে? এটি কি শুধুই বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি এর পেছনে আছে আরও কোনো অজানা গল্প? সেসব নিয়ে চলছে নানা বিচার-বিশ্লেষণ। তবে ব্রিকসের ১৫তম এই বৈঠকে জোটটির সদস্য হিসেবে যুক্ত না হওয়ার সম্ভাব্য নানা কারণের মধ্যে কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে আমলে না নিয়ে বিশ্লেষকেরা বরং অর্থনীতি এবং ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এ ছাড়া তারা বলছেন যে সদস্য না হতে পারার পেছনের প্রকৃত কারণ জানতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ফলে ব্রিকসের সদস্য না হতে পারার কারণ হিসেবে এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতাই আলোচিত হয়ে আসছে।
গত বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) জোহানেসবার্গের স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগ (ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) ‘নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক অব ব্রিকস’- এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে ভাষণ দানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ব্রিকসকে বহুমুখী বিশ্বের বাতিঘর হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে এবং প্রতিক্রিয়ার সময় অন্তর্ভূক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ থেকেই ব্রিকসের গুরুত্ব সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়। তাহলে কেন এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি জোটের সদস্যপদের আমন্ত্রণ পেল না বাংলাদেশ? সে দিকটায় আলোকপাত করা যাক:
প্রথমেই বিষয়টিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে নাকচ করে দিয়ে বিশ্লেষকেরা নজর দিচ্ছেন প্রধানত অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বিষয়ের দিকে। অনেকে আবার এমনও বলছেন যে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং সেসব বিষয়ে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকায়ই এ দফায় বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরত থেকেছে ব্রিকস। কিন্তু এ যুক্তিটি ধোপে টেকে না যখন ব্রিকসের আমন্ত্রিত সদস্যরাষ্ট্রের তালিকায় নাম থাকে ইথিওপিয়ার মতো একটি অনুন্নত দেশের।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন যে প্রথমত ব্রিকসে যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাদের মধ্যে সব কটি দেশই অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমাণ দেশ এবং এদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থাই বাংলাদেশের তুলনায় ভালো। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখনো এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবেই আছে। আর ব্রিকসে যারা আমন্ত্রণ পেয়েছে, তাদের লেভেলটা আরেকটু ওপরে। তার মতে, বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির সক্ষমতা রাখে, এমন সব দেশকেই এবার ব্রিকসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো সে ধরনের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম কি না, সেটাও ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে হুমায়ুন কবির মনে করেন, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। কাজেই আগ্রহ দেখানো এবং তার জন্য যতটুকু মোবিলাইজেশন দরকার, সেটা কতটুকু হয়েছিল সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হয়তো সে কারণেই বিষয়টা বিবেচনায় আসেনি বলেও মনে করেন তিনি। ব্যাপারটিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো একটু বেশি প্রত্যাশা করেছিলাম। অথবা একটা আশাবাদ তৈরি করে একটা অবস্থান বা একটা ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য হয়তো চেষ্টা করা হয়েছিল যা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না।’
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও প্রায় একই কথা বলেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ বাদ পড়ার যথাযথ কারণ জানতে অপেক্ষা করা উচিত। তার মতে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, চারটি দেশকে যুক্ত করা হলে তার মধ্যে একটি হবে বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায়নি। এর কারণ হতে পারে, তারা যে ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় নিয়েছে সেগুলো হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ করেনি। তিনি বলেন, সবকিছুতে একদিনে সাফল্য পাওয়া যায় না, অনেক কিছু আছে সেগুলোতে অনেক সময় লাগে।
প্রায় একই রকম মত ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের অন্যান্য কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস বিশেষ একটি দিকে মনোযোগ দিয়ে বলেন, ব্রিকসের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণযোগ্য। যেমন যেসব দেশের সমস্যা মেটাতে চীন মধ্যস্থতা করেছে সেসব দেশ আমন্ত্রণ পেয়েছে। আবার ইথিওপিয়াতেও চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে।
এ ছাড়া আঞ্চলিক ভারসাম্যও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। যেমন ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা সব অঞ্চলের দেশই রয়েছে। এদের মধ্যে একমাত্র ইথিওপিয়া ছাড়া বাকি সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশের থেকে সব দিক থেকেই এগিয়ে। তাহলে ইথিওপিয়া আমন্ত্রণ পেল, বাংলাদেশ কেন পেল না? সে প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। তবে এবার এ দৌড়ে পিছিয়ে গেলেও সামনের জন্য লম্বা দম নিয়ে নব উদ্যমে দৌড় শুরু করবে বাংলাদেশ, এটাই প্রত্যাশা সবার।
লেখক : শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক