• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কাকে বলবেন ভালো সাংবাদিক


মানজুর মোরশেদ
প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২৩, ১১:৪৪ এএম
কাকে বলবেন ভালো সাংবাদিক

বলা হয় গণমাধ্যম বা মিডিয়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সেখানে কাজ করতে হলে সাহস, সততা, সংকল্প, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি—এমন কিছু অপরিহার্য গুণ একজন পেশাদার সাংবাদিকের থাকতে হয়, যা তাকে সামনে এগিয়ে নেয়। তা সেই সাংবাদিক প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল যে মাধ্যমেই কাজ করুন না কেন, সেই আলোচনায় সবচেয়ে বড় নিয়ামক যে বিষয়গুলো, সেটিই তুলে ধরার চেষ্টা আজ।

শব্দ আর ছবি দিয়ে খেলা

সাংবাদিককে খেলতে জানতে হয়। সেটি ছবি আর শব্দ দিয়ে, তা সে মাধ্যম যা-ই হোক না কেন। কখনো শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতে হয়, কখনোবা ছবি দিয়ে ঘটনা। একটি গড় খবরের গল্পও জনপ্রিয়-আকর্ষক হয়ে উঠতে পারে সাংবাদিকের দক্ষতায়। বাস্তব তথ্যের নিরিখে শব্দ ও ছবি নিয়ে খেলতে পারলেই কেবল মেলে শিক্ষিত দর্শক-পাঠকের বাহবা। ত্রুটিমুক্ত, ব্যাকরণগতভাবে সঠিক এবং সংক্ষিপ্ত আকারে রিপোর্ট করতে পারা একজন দক্ষ সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণাবলি হিসেবে ধরা হয় সংবাদকক্ষে।

সমসাময়িক জ্ঞান

কোনো একটি বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান একজন ভালো সাংবাদিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ঘটমান ঘটনার ওপর জানাশোনা যেকোনো গল্পকে সমৃদ্ধ করে সঙ্গে ‘নৈকট্য’ বাড়ায়, সময় উপযোগী করে তোলে। একটি গল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যাকে আমরা বলি ‘সংবাদ মূল্য’, সেটি খুঁজে বের করতে হয় সাংবাদিককে। অর্থাৎ সেই সংবাদ যেটি সাধারণ মানুষ নিজের মনে করতে পারে, আপন মনে করতে পারে, সেটি খুঁজে বের করতে হয়।

অনুসন্ধানী দক্ষতা

একজন সাংবাদিক কোনো গল্পে কাজ করার সময় আবেগের ওপর নয়, ঘটনা এবং প্রমাণের ওপর নির্ভর করেন। গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারার দক্ষতা থাকতে হয় একজন আদর্শ সাংবাদিকের। সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা, ঘটনার মূল্যায়ন ও সঠিক বিচার প্রথমত তাকেই করতে হয়। তা না হলে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে ‘গলদ’। ‘ক্রস চেক’ যতটা পুঙ্খানুপুঙ্খ হবে, গল্পের গাঁথুনি তত শক্ত হবে। দিন শেষে সেটি সব চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করতে পারবে। আর তাই তো অনুসন্ধান হতে হবে উন্মুক্ত ও নিরপেক্ষ। সম্ভাব্য কোনো পক্ষ বা কারা চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, কী হবে তার জবাব, সেটি মাথায় রাখলে অনুসন্ধান পায় পূর্ণতা।

তথ্য জোগাড় ও সাক্ষাৎকার নেওয়ার দক্ষতা

একজন সাংবাদিককে যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় কৌশলী ও দক্ষ হতে হয়। পরিস্থিতি ও ঘটনার দাবি অনুযায়ী ছক আঁকতে হয়। তথ্য যাচাই করার জন্য নিজের কাছে সঠিক বিচারও সমান তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো পক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হলে গল্প সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে ওজন হারায়। এ জন্য কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতা অপরিহার্য। একটি গল্পের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য বের করার কৌশল অবশ্যই জানতে হবে একজন আদর্শ সাংবাদিককে। পেশাদারত্ব এবং আত্মবিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা সেই সাংবাদিক প্রবীণ অথবা নবীন যেমনই হোন না কেন।

সংবাদকক্ষে ও বাইরে পেশাদারত্ব

পেশাদারত্ব বলতে যা বোঝায় তা হলো, এককথায় টাইমলাইন বা সময়সীমা পূরণ করা। সেটি সংবাদকক্ষের জন্য যেমন, নির্দিষ্ট সংবাদের চরিত্র ও ঘটনার জন্যও তেমন। সব জায়গায় সময়মতো পৌঁছাতে পারার একটা তাড়া থাকে একজন আদর্শ সাংবাদিকের। কাজ শেষ করারও বৈকি। সম্পাদকের ভিন্নমত, সমালোচনা গ্রহণ করার মতো ঋজুতা থাকতে হয় সাংবাদিকের। সীমাবদ্ধতা থেকে শেখা এবং দক্ষতা বাড়ানোর আগ্রহ শেষ পর্যন্ত একজন সাংবাদিককে সফল করে তোলে।

অধ্যবসায় ও শৃঙ্খলা

এই পেশায় ভালো করতে হলে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবস্যায়ের বিকল্প নেই। কখনো কখনো লিড নিউজ পেতে, সংবাদকক্ষে, পেশায়, সমাজে সাড়া ফেলতে মাসের পর মাস ছুটতে হয়। দেখা যায় নির্দিষ্ট একটি গল্পের পেছনে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসে নতুন গল্প। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসে সাপ। সেই প্রাপ্তির আনন্দ পেশাগতভাবে সেই সাংবাদিকই কেবল বোঝে যে এটির দেখা পায়।

সাংবাদিকের নীতি-নৈতিকতা

সাংবাদিকের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সত্যের সন্ধান করা এবং সব বিষয়ে ন্যায়বিচার খোঁজা। তবে রাষ্ট্র-সমাজ সেই পরিপ্রেক্ষিত সব সময় না-ও রাখতে পারে। কখনো কখনো সাংবাদিক অর্থ এবং খ্যাতির জন্য তাদের নীতি-নৈতিকতা ত্যাগ করেন। কিন্তু এটি ভালো দৃষ্টান্ত তৈরি করে না, এই পেশাকে আস্থাহীন করে তোলে সাধারণ মানুষের কাছে।

ভারতের বেঙ্গালুরুর রিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন বিভাগে একজন সফল সাংবাদিকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এই শিক্ষা দেওয়া হয়। এটা আসলে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন শিক্ষা সাংবাদিকতার ছাত্রছাত্রীদের জন্য। কিন্তু এই শিক্ষার প্রতিফলন কার্যক্ষেত্রে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে, থাকছে। কারণ পৃথিবী নয়, করপোরেট স্বার্থ সংরক্ষণই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্র ও সমাজের মূল দায়িত্ব। সেখানে সাংবাদিকতা এখন যেন শুধুই পথের পাঁচালী!

লেখক : সাংবাদিক

Link copied!