• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আতঙ্ক যখন ডেঙ্গু নিয়ে


নাজিয়া আফরীন
প্রকাশিত: জুলাই ৫, ২০২৩, ০৭:২১ পিএম
আতঙ্ক যখন ডেঙ্গু নিয়ে

বাংলাদেশে ডেঙ্গু সনাক্তের ২৩ বছরের মাথায় সর্বোচ্চ রেকর্ডের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ডেঙ্গু সনাক্ত হলেও তিনবছরের মাথায় মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ২০১৮ সালে আবারো ফিরে আসে ডেঙ্গু। মারা যায় ২৬ জন, আক্রান্ত হয় ১০ হাজারেরও বেশি। আর এবছর জুলাইয়ের শুরুতেই ১০ হাজারের ঘর ছুঁয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। গতবছরের তুলনায় এবছর আক্রান্তরা খুব কম সময়ের মধ্যে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে।
ডেঙ্গু মৌসুম আসার আগেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে, সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত প্রাক মৌসুম এডিস মশা সার্ভে নীরিক্ষাতেও তা স্পষ্ট। ৪ জুলাইয়েরে নীরিক্ষাতে বলা হয়েছে, বিগত বছর একই সময়ে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০২। আর এই বছর এখন পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৭১ জনে। অর্থাৎ রোগী বেড়েছে ৬ গুণ। এছাড়া এবারের জরিপে লার্ভার যে ঘনত্ব উঠে এসেছে, তাতে আগামী কয়েক দিনে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত কয়েক দিনে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় অসংখ্য পরিত্যক্ত পাত্রে পানি জমা হয়েছে, যার মধ্যে এডিস মশা ডিম পাড়বে। এই ডিমগুলো ফুটে লার্ভা, পিউপা ও উড়ন্ত মশায় পরিণত হবে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাপক হারে না বাড়ালে এ বছর ডেঙ্গু স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে দেখা দেবে।

এডিস মশার প্রাক মৌসুম জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, পুরো ঢাকার সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ঢাকা উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ডে এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডে সর্বমোট ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে সার্ভে করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স’র মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সার্ভেতে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে।
তারচেয়েও শঙ্কার কথা, ডেঙ্গু ছড়িয়েছে ৫৩ জেলায়। গত ৩ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার চেয়েও বেশি রোগী পাওয়া গেছে ঢাকার বাইরে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর এখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, নাটোর, কুষ্টিয়া ও গোপালগঞ্জে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বাকি সব জেলায় পাওয়া গেছে।
 

আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবার আশঙ্কাই শুধু ভয়ের কথা নয়। এবারের ডেঙ্গু আক্রান্তের জন্য সবচেয়ে খারাপ খবর হচ্ছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৮০ শতাংশ রোগী। বাকি ১৪ শতাংশ ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং ৬ শতাংশ ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে। চলতি বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত মৃত ৫০ জন রোগীর মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
 

ডেঙ্গুতে মৃত ৫০ জনের মধ্যে ৬২ শতাংশ নারী আর পুরুষ ৩৮ শতাংশ। মৃতদের ৬০ দশমিক ৮০ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ৯ শতাংশ মৃত্যু ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে, ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ৬ থেকে ১১ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

 

রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ডেঙ্গুতে মৃত ৬১ জনের মধ্যে ১৯ জনই মারা গেছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ৮ জন মারা গেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে ৬ জন ও আজগর আলী হাসপাতালে মারা গেছে ৪ জন। পাশাপাশি বারডেম, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আরো ১৪ জন মারা গেছে।

 

ডেঙ্গুতে বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হেমোরেজিক ফিভার ও শক সিনড্রোম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে ক্লিনিক্যালি মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মৃতদের প্রায় প্রত্যেকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অন্য আরও কারণ থাকতে পারে, যা জানার জন্য অটোপসি করা প্রয়োজন। যা এদেশের পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে সেটা সম্ভব নয়।
 

সব মিলিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এবছর করোনার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে দেশজুড়ে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি আত্মসচেতনতার কোন বিকল্প নেই। সিটি কর্পোরেশনগুলো চিরুনী অভিযান, ড্রোন অভিযানসহ নানা কার্যক্রম চালাচ্ছে। জনসাধারণের অভিযোগ, মশা মারতে কামান দাগছে মেয়ররা আবার মেয়ররা বলছেন, তাদের কার্যক্রমে জনসাধারণের হেলদোল নেই। কিন্তু কেন এত চেষ্টাতেও এডিস নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না- বিষয়টিতে সবধরনের মানুষের সমান অংশগ্রহণ না হবে, ততদিন হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়বেই। 
 

এখানেই শেষ নয়, রাজধানীর প্রায় সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ একটাই, রোগী এমন মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসে, যখন মাত্র কয়েক ঘন্টা থাকে তার হাতে। হাসপাতালগুলো থেকে বারবার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে, এবছর হালকা জ্বর একদিন থাকলেও সচেতন থাকতে হবে। হালকা বা তীব্রমাত্রার জ্বরের প্রথম তিনদিনের মধ্যেই ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। এখন সবখানেই মাত্র একশ টাকার বিনিময়ে ডেঙ্গু টেস্ট করা যায়। ডেঙ্গু সনাক্ত হলেই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। কোনরকম অ্যান্টিবায়োটিক নয়, কারণ ভাইরাসের সংক্রমণে ডেঙ্গু হয়, তাতে অ্যান্টিবায়োটিক কোন ভূমিকা রাখতে পারেনা। 
প্রচুর পরিমাণ পানি, বিশুদ্ধ ফলের রস খেতে হবে। আর একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে বলে চিকিৎসকরা অভিযোগ করেন, ডেঙ্গু হলেই প্লাটিলেট দেবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রোগীর স্বজনরা। চিকিৎসকরা বলছেন, প্লাটিলেট কমে গেলেও স্বাভাবিকভাবেই তা একসময় বেড়ে যায়। এটা নেয় চিন্তার কিছু নেই। খেয়াল রাখতে হবে শরীরের কোথাও রক্ষক্ষরণ হয় কিনা। রক্তক্ষরণ হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। এবারের ডেঙ্গুতে খুব সহজেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। 
 

মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউতে ভর্তি রোগীদের সম্পর্কে  চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সময়মতো চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় অনেকের লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, অনেকে জন্ডিস, টাইফয়েড , ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়ায় একসাথে আক্রান্ত হয়েছেন। ঝুঁকিতে আছেন গর্ভবতী নারীরাও। হাসপাতালগুলোতে এমন গর্ভবতী নারীদের পাওয়া গেছে, যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন, গর্ভের সন্তানও আশঙ্কামুক্ত নয়।
 

একইভাবে ঝুঁকিতে শিশুরাও। রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন সর্বোচ্চ সংখ্যক শিশু আসে ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে। চিকৎসকরা বলছেন, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। হালকা একদিনের জ্বরকেও যেন অন্তত এই সময়টাতে অবহেলা না করা হয়। কারণ মাত্র তিনদিনের জ্বরেই একটি শিশু শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে।

 

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, এটিএন নিউজ

 

Link copied!