গত বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বইমেলা থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনায় অভিযোগ দিতে ডিবি পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে নিজের অভিযোগ পেশ করেন তিনি। হিরো আলম বলেন, একজন মানুষকে শুধু বইমেলা থেকে নয়, যে কেউ যে কোনো স্থান থেকে বের করে দিতে পারে না। সেখানে বইমেলায় আমাকে দুয়োধ্বনি দেওয়া হয়েছে, যেটা আমার কাছে উত্ত্যক্তের পর্যায়ে মনে হয়েছে। তাই ডিবি কার্যালয়ে এসেছি।
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে দর্শনার্থীদের ‘ভুয়া ভুয়া’ ও ‘ছি ছি’ দুয়োধ্বনিতে মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়তে বাধ্য হন হিরো আলম। এদিন বিকেল ৪টার দিকে বইমেলায় পাঠক-দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। এ সময় নিজের লেখা ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, আমরা সমাজকে বদলে দেব’ বইটি হাতে নিয়ে পাঠকদের কিনতে উৎসাহিত করছিলেন তিনি। হঠাৎ একদল দর্শনার্থী তাকে ‘ভুয়া, ভুয়া’ ও ‘ছি ছি’ দুয়োধ্বনি দিতে শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে হিরো আলম নিজেই বইমেলা থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হন। পরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এসে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে তাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
হিরো আলম পরে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি সবার কাছে জানতে চাই, ‘ভুয়া’ শব্দের অর্থ কী? ভুয়া বলার মতো আমি কী করেছি? ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান যারা দেয়, তারা কারা? আর এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখেও পুলিশ কেন নীরব থাকে?
এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি একইরকম দুয়োধ্বনির মুখে বইমেলা থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন আলোচিত-সমালোচিত দম্পতি মুশতাক-তিশা দম্পতি। এরপরে একই কাণ্ড ঘটে ডা. সাবরিনার সঙ্গেও।
আলোচিত এই তিনটি ঘটনাই ঘটেছে অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে এবং এই তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি গভীর যোগসূত্র আছে। সম্প্রতি ভাইরাল তিশা-মুশতাক দম্পতি, ডা. সাবরিনা এবং হিরো আলম প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক আলোচিত, সমালোচিত। তিশা-মুশতাক দম্পতি আলোচিত এবং সমালোচিত তাদের অসম বয়সী প্রেম এবং বিয়ের কারণে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থাকে। তা হলো তিশা ও মুশতাক দম্পতি কি কোনো আইনবিরোধী, ধর্মবিরোধী বা অনৈতিক কোনো কাজ করেছেন? অসম বয়সের সম্পর্কে কি আইনে, ধর্মে বা নৈতিকতা শাস্ত্রে কোথাও নিষেধ আছে? উত্তর হলো, না এবং নেই। তাছাড়া নৈতিকতা শব্দটিও ভীষণ আপেক্ষিক। এক সমাজে বা সময়ে যেটি নৈতিক অন্য সমাজে বা সময়ে সেটিই অনৈতিক হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বাল্যবিয়ে এবং বিধবা বিয়ের উল্লেখ করা যায়। তারপরও বলা যায় যে তিশা প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ একজন মানুষ। তিনি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে মুশতাককে বিয়ে করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং মুশতাক তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এখানে আইনি, ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো বাধা নেই। যদিও সমাজের কাছে বিষয়টা খানিকটা দৃষ্টিকটু কারণ এটি বর্তমান সমাজে বহুল প্রচলিত নয়। কিন্তু খুব অপ্রচলিত কিছুও নয়। কাজেই বিষয়টি নিন্দনীয় হলেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া তারা যা করেছেন যেহেতু তা আইনের চোখে অপরাধ নয়, সেহেতু তাদের অপরাধী প্রমাণেরও কোনো সুযোগ নেই। তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের সমাজে, সকলের নাকের ডগায় বহু অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত ঘটছে, যা অনেকক্ষেত্রেই এমনকি আইনের চোখেও ভয়ঙ্কর অপরাধ। যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি। সেসব নিয়ে আমরা নির্বিকার। সেসব ক্ষেত্রে আমরা আশ্চর্যরকমভাবে চুপ। তাহলে তিশা-মুশতাক দম্পতিকে নিয়ে আমরা এতটা উচ্চকিত কেন? কেন এমন ‘গেল গেল’ রব তুলে গলা ব্যথা করে ফেলছি আমরা?
কারণটা সম্ভবত আমাদের জানা। আমরা অন্যের আনন্দ বা সুখ সহ্য করতে পারি না। আমাদের চোখ ঈর্ষায় জ্বলে। আর তাই আমরা নৈতিকতার দোহাই দিয়ে নিজেদের পুলিশের ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে লাঠি নিয়ে তেড়ে যাই। সমাজে প্রেমের নামে, ভালোবাসার নামে, বহু নোংরামি চালু আছে, বহু বুড়ো ভাম সম্পত্তি আর বিত্তের জোরে বহু তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে আবার সুযোগ বুঝে কেটে পড়ছে, বহু তরুণী তার রূপের মোহে ভুলিয়ে বহু নারীলোভী পুরুষের সর্বস্ব বাগিয়ে নিয়ে সরে পড়ছে সম্পর্ক থেকে, তাদের তুলনায় তিশা-মুশতাক দম্পতি অন্তত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৎ থেকেছেন, একটা পরিণতিতে গিয়েছেন। ব্যাপারটা আমাদের চোখে যতই অসামঞ্জস্যকর লাগুক, আইন, ধর্ম বা নৈতিকতার চোখে তা অপরাধ নয়, সেটি ভুলে গেলে চলবে না। কাজেই এই দম্পতি তাদের লিখিত বই নিয়ে বইমেলায় প্রচার চালানোর ষোলোআনা অধিকার রাখেন। তাদের অপছন্দ করলে, তাদের লেখা ভালো না লাগলে তাদের বই না পড়ার বা না কেনার, ইচ্ছেমতো তাদের লেখার সমালোচনা করার অধিকারও যে কোনো ব্যক্তির তথা পাঠকের আছে। কিন্তু মেলা থেকে তাদের বের করে দেওয়াটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়, সমর্থনযোগ্যও নয়। একই কথা ডা. সাবরিনা এবং হিরো আলমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ডা. সাবরিনা যত বড় অপরাধীই হোক, একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তার অধিকার আছে নিজের লেখা বইয়ের প্রচারণা চালানোর, তার অপরাধ নিয়ে ভাবার জন্য দেশে আইন আছে, বিচার আছে, সেটি সাধারণ মানুষের বিচার্য বিষয় নয়, তাছাড়া তিনি তো তার অপরাধ সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে বইমেলায় হাজির হননি। তিনি তার প্রকাশিত বইয়ের প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন একজন লেখক হিসেবে। তার বইটি সাহিত্য হয়ে উঠেছে কি ওঠেনি সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে, লেখক হিসেবে তিনি কতটা ব্যর্থ অথবা সফল সেটিও আলোচনায় আসতে পারে, কিংবা তার প্রচারণা কৌশল নিয়েও হয়তো কথা বলা সমীচীন হতে পারে কিন্তু তাকে বইমেলা থেকে বের করে দেওয়ার অধিকার কি আমরা রাখি? এতটা নৈতিক পুলিশ আমরা হয়ে উঠলাম কবে? আর যদি হলামই, তাহলে সমাজে ঘটমান এত যে অনাচার, অনৈতিকতা, সেসব নিয়ে আমরা এমন নিঃস্পৃহ কেন? কেন শুধু মুশতাক-তিশা দম্পতি, ডা. সাবরিনা আর হিরো আলমের বই লেখা আর তাদের বইমেলায় আগমনের ক্ষেত্রেই আমরা এমন মুখর?
হিরো আলম সমাজের প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা একজন মানুষ। তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় আজ এ পর্যন্ত এসেছেন, সমাজের সব প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে তিনি চেষ্টা করেছেন নিজেকে মধ্যবিত্তের কাতারে তুলে আনার। লোকলজ্জা বা লোকভয় শব্দদুটি তার অভিধানে সম্ভবত নেই। একই কথা মুশতাক-তিশা দম্পতি এবং ডা. সাবরিনার ক্ষেত্রেও বলা যায়। তারা সমাজের ভয় করেননি বলেই ভাইরাল হয়েছেন। এক্ষেত্রে নিজেদের অগোচরেই তাদের সাপোর্ট দিয়েছে মিডিয়া। যে কোনো ইস্যুতে তাদের নিউজ করে তাদের পরিচিতি বাড়িয়ে তোলা হয়েছে, নিউজ, সেটি নেগেটিভ বা পজিটিভ যা-ই হোক, তা পরিচিতি বাড়ায়, সেটি জেনেও মিডিয়া তাদের ভাইরাল হতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সচেতন মানুষ হিসেবে তাদের অপছন্দ বা বর্জন করলেই ল্যাঠা চুকে যায়, পাত্তা না দিলেই চলে। কিন্তু উল্টো তাদের নিয়ে মাতামাতি করে, তাদের স্টলের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেলফি তুলে আবার মেলা থেকে তাদের বিতাড়নের মোরাল পুলিশি চেষ্টাটা ভীষণ দ্বিমুখী আর নিন্দনীয় আচরণ। কারণ তারা তো রাষ্ট্র বা দেশবিরোধী কিছু লেখেননি, তাদের বই নিষিদ্ধও করা হয়নি, তাহলে তারা কেন নিজ স্টলে গিয়ে বইয়ের প্রচারণা চালানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন?
কাজেই বইমেলা থেকে লেখক বিতাড়নের এই মোরাল পুলিশি আচরণ ভীষণ নিন্দনীয় ও অযৌক্তিক এবং যারা এর সঙ্গে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নইলে এমন স্টুপিডসুলভ আচরণ ভবিষ্যতে বাড়তেই থাকবে যা লেখকদের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠবে একসময়। কাজেই এদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি এবং সেটি যত দ্রুত করা যাবে, ততই মঙ্গল।
লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক