• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তাজউদ্দীন আহমদের দর্শন


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৩, ০৯:২৭ এএম
তাজউদ্দীন আহমদের দর্শন

হয়তো তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বাস করতেন—ইতিহাসে মূল নায়ক জনগণ। সেজন্যই তিনি নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছেন। হয়তো ভেবেছিলেন, এর ফলে ভবিষ্যৎ জনগণও দায়িত্ববান হবে। তাজউদ্দীন আহমদের দর্শন ছিল, ‘তুমি ইতিহাসে এমনভাবে কাজ কর, যেন ইতিহাসে কোথাও তোমাকে খুঁজে পাওয়া না যায়।’ 

ইতিহাসের এমন নির্মোহ নির্মাতা পৃথিবীতে বিরল। জনগণের নেতা হয়ে ওঠার দর্শনটি আমরা মার্কসীয় দর্শন থেকে পাই। মার্কসীয় আদর্শের রাজনীতিক না হয়ে বরং শতভাগ একজন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ জনগণকে নিজের থেকে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন বেশি। অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘আমি নিজে মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট নই, তবে আমি কমিউনিজম থেকে নিজের জীবনাচরণে অনেকখানি গ্রহণ করি।’

কমিউনিস্টদের ভেতরেও দক্ষিণপন্থীরা ছিলেন, যেমন ছিলেন বামপন্থীরা। তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান জাতীয়তাবাদের বামপন্থী সীমান্তে; সে সীমান্তটি পার হয়ে যাওয়া যায় কিনা, সে চেষ্টা নিশ্চয়ই করতেন, যদি না তার অকালপ্রয়াণ ঘটত। তিনি তো চলে গেলেন মাত্র ৫০ বছর বয়সে।

দুই।

অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ—বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি। ইতিহাসের একটি কালপর্ব নিয়ে তার নীরবতাও তাকে খুঁজে পেতে বাধাগ্রস্ত করে। সে কারণে ইতিহাসের অনেক জায়গায় তাকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।

তাজউদ্দীন আহমেদ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি তার সাদা শার্টটি রাতে ধুয়ে দিতেন এবং পরদিন সকালে সেটি পরেই রাজনৈতিক মঞ্চে যেতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন। তার এরকম সহজ-সরল জীবনাচার প্রকৃত রাজনীতিবিদের একটি মূল্যবোধে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন।

তিন।

স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা তাজউদ্দিনের নাম-ধর্ম-জাত সবকিছুই বিকৃত করে দিয়েছিল তখনকার শাসক-শোষকরা। তারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি কোনো মুসলমান নয়, তিনি একজন ভারতীয় হিন্দু, আসল নাম তেজারাম। পাকিস্তানকে ভাঙার জন্যেই তিনি পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ এ একজন পাকিস্তানি অফিসার তার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সৈয়দ সাহেব, আপনি ছিলেন আরবি প্রফেসর এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধেও আপনার অগাধ জ্ঞান রয়েছে। অথচ আপনার মেয়ের কি না বিয়ে দিলেন এক হিন্দুর সঙ্গে।’

আরেক কুখ্যাত পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেছিলেন, He hated West Pakistan and perhaps Pakistan itself. He was reputed to have a Hindu up to the age of 8. I do not think this story was correct, but it revealed his mental make–up.

যাকে পাকিস্তানীরা বারেবারে হিন্দু বলে আখ্যায়িত করছিল, তিনি ছিলেন একজন কোরআনে হাফেজ; নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি মৌলভী বাবার কাছ থেকেই এটা আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের স্বপ্ন সারথি, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রদূত শেখ মুজিবের চরম ভরসার পাত্র তাজউদ্দীন আহমদ। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন; প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রথম হয়ে। বিনিময়ে পেয়েছিলেন মূল্যবান পুরস্কার–দেড় পয়সার কালির দোয়াত এবং সাড়ে আট পয়সার একটি কলম। সেই থেকে এক মহামানবের যাত্রা শুরু।  

পাকিস্তানিরা তাকে এমনি এমনি হিন্দু কিংবা ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেনি, তাজউদ্দীন আহমদের ধীরস্থির মস্তিষ্কের প্রতি তাদের একটা ভয়াবহ ভীতি কাজ করত। ৭১ এ মুজিব–ইয়াহিয়া বৈঠকের সময়কালে ভুট্টো তখন একবার উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়। কিন্তু তার পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাকে কাবু করা শক্ত। This Tajuddin, I tell you, will be your main problem.

পাকিস্তানিদের এই ভয়ও অমূলক ছিল না। যে লোকটি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিংবা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সহ সব ধরনের আন্দোলনের সহিত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তাকে ভয় পাওয়ারই কথা। 

পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেলেও এ অঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়া যে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে আলাদা, দেশপ্রেমিক কিছু তরুণের হাতে আওয়ামী লীগের জন্ম নিশ্চিত করেছে সেই সত্যকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে ফাইল হাতে ছুটে চলা তাজউদ্দীনকে তখন ধরা যায় একটি মুক্তিকামী ভূখণ্ডের প্রতীক হিসেবে।

চার।

১৯৭৪ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফরের আগে মার্কিন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক তাজউদ্দীনকে পদত্যাগ করানো হয়। যদিও মতপার্থক্যের কারণে তাজউদ্দীন নিজেই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি আর ওই মন্ত্রীসভায় থাকতে চাচ্ছিলেন না। তবে তিনি নিজ থেকে তিনি পদত্যাগ পত্র দিলে বঙ্গবন্ধু বিব্রত হতে পারেন তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর পদত্যাগের আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন।

২৬ অক্টোবর দুপুর ১২টা ২২ মিনিটে তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে অফিস থেকে ফোন করে তার স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে জানালেন—লিলি, আমি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছি। ১২টা বেজে ২২ মিনিটে আমি পদত্যাগপত্রে সই করেছি। ফোনের মধ্যেই জোহারা তাজউদ্দীন স্বামীকে অভিনন্দন জানালেন। জোহরা তাজউদ্দীন ৭২ সাল থেকেই বলে আসছিলেন তাজউদ্দীন এই মন্ত্রীসভায় বেশিদিন টিকতে পারবেন না, স্বাধীনভাবে তাকে কাজ করতে দেবে না।

ঐতিহাসিক চরমপত্রের রচয়িতা ও পাঠক এম আর আখতার মুকুল তাজউদ্দীনের পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেছেন, মন্ত্রীসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হল বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল।… ছায়ার মতো যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন এক গোপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন।

পাঁচ।  

মুক্ত হয়েছে দেশ—তাজউদ্দীন আহমদ তার মন্ত্রীসভা নিয়ে দেশে ফিরবেন। এয়ারপোর্টে তাদের বিদায় দিতে আসেন ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান রুস্তমজী, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার গোলক মজুমদার সহ অনেকেই। 

রুস্তমজি বললেন, ‘আশাকরি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব চিরকাল অক্ষুণ্ণ থাকবে’। নম্র স্বভাবের তাজউদ্দীন তখন উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, সমতা সহকারেই বন্ধুত্ব হতে পারে’।

ফিরলেন দেশে তাজউদ্দীন আহমদ। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুও প্রত্যাবর্তন করলেন তার প্রিয় দেশে। শেখ মুজিবকেও অনেক কিছু বলার ছিল তাজউদ্দীনের। প্রথম সাক্ষাতেই বুঝেছিলেন, তিনি (তাজউদ্দীন) তার নেতার (বঙ্গবন্ধু) আস্থা হারিয়েছেন। দেশের প্রয়োজনে তাজউদ্দীন ঐতিহাসিক একটি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং তা যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন এবং প্রাণ দিয়েছিলেন তার কারণও ইতিহাসে নিহিত।  

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, নিহত হন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার। এর ঠিক মাস দুয়েক পর ৩ নভেম্বর জেলের মধ্যে নিহত হন তাজউদ্দীন আহমদ। খন্দকার মোশতাক তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, তাজউদ্দিন সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। 

বাগান করার বড় শখ ছিল বোধহয় তার। জেলের মধ্যে পচা নর্দমা ভরাট করে সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন মৌসুমী ফুলের বাগান; রক্তলাল জবা ফুলের একটা গাছও নাকি ছিল সেখানে। এমন সুন্দর বাগান তৈরির কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন আজীবন।

পাঁচ। 

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। অনেকটাই আড়ালে রাখা হয়েছে তাকে। তিনি দেশকে ও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে কাজ করে গেছেন। আজ যে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এর পেছনে তার অবদানকে স্মরণ করতে হবে। কাজেই তাজউদ্দিনের জীবনের মূল্যবোধ তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার, যাতে পেশাগত জীবনে তারা সেই মূল্যবোধের চর্চা করে। তিনি ইতিহাসে থাকবেন, সঙ্গী হবেন অগ্রগতির সংগ্রামে।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Link copied!