• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উন্নয়নে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ : একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২৪, ১২:৩১ পিএম
উন্নয়নে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ : একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বিকাশমান অর্থনীতিতে যত বেশি জনসংখ্যা, তত বেশি কর্মসংস্থানের চাহিদা এবং ভোক্তা পাওয়ার সুযোগ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতা যদিও একটি বিষয়, তবু তা মূল মানদণ্ড নয়। কারণ, কর্মঠ হাত নিজেই সম্পদ। এই বিবেচনায় ছোট্ট ভূখণ্ডের বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, যার মধ্যে প্রায় ৮ কোটিই কোনো না কোনোভাবে তার দুই হাতকে কাজে লাগানোর সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা খুব বেশি পরিপক্ব ও শক্তিশালী নয়। সামান্য সংকটেই তার ভিত নড়ে ওঠে। অথচ এই দেশ ৫৩ বছর আগে বাইরের সব শক্তির কবল থেকে নিস্তার পেয়ে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতা পেয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় একই সঙ্গে পথচলা শুরু করা অনেক দেশ তো ঠিকই আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কিছু না কিছু সক্ষমতা অর্জন করেছে, যা দিয়ে সে সংকট-ঝড় সামাল দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করাই যুক্তিযুক্ত হতো, কেননা ১৯৫৭ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটি নিজের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে ব্যবহার করার সুযোগ পায় ১৯৭০-এর দশকে। আর এখন এই দুই দেশের মধ্যে পার্থক্য এতটাই বেশি যে বিষয়টি তুলনার উপলব্ধিতে সমস্যা হবে। তাই ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করাই শ্রেয় হবে। ভিয়েতনাম বাংলাদেশের ৩ বছর পর স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, ১৯৭৪ সালে এবং তা-ও আমেরিকার মতো মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের কবল থেকে। এখন বাংলাদেশ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। তবে ভিয়েতনাম অনেক বিষয়ে বাংলাদেশকে ইতিমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায় ভিয়েতনামের এই ছাড়িয়ে যাওয়া ও সামনে এগিয়ে যাওয়া বিশ্লেষণ করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হবে, যাতে করে কেউ চাইলে বাংলাদেশের সত্যিকার বিনির্মাণ চিত্রটি আঁকতে পারে।  

বিশ্লেষণের সুবিধার্থে শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, বাংলাদেশ পোশাক খাতে ভিয়েতনামের ওপরে থাকতে সদাসচেষ্ট। বাংলাদেশ এই খাতে দ্বিতীয়, ভিয়েতনাম তৃতীয়। ভিয়েতনাম কোনোভাবে পোশাক খাতে টপকে গেলে বাংলাদেশে নানা আলোচনা শুরু হয়, চারদিকে মোটামুটি রব ওঠে। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, ভিয়েতনাম মন থেকেই চায় পোশাকের উৎপাদন খাত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে। কিন্তু কেন?

ভিয়েতনামের শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে দেশটির ডিজিটাল ইকোনমির বাজার ছিল ৩০০ কোটি ডলারের, যা ২০২৩ দাঁড়ায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে। ২০২২ এর তুলনায় ২০২৩ সালে এই খাতে দেশটির আয় ১৯ শতাংশ বেশি ছিল এবং এই সংখ্যা ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৫ বিলিয়ন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০-২০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। অপর দিকে দেশটির ২০২৩ সালে টেক্সটাইল ও পোশাক পণ্যের রপ্তানি একবছর আগের তুলনায় প্রায় ৯.২ শতাংশ কমে যায়, যেখান থেকে আয় হয় প্রায় ৪০.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর কারণ দেশটি গার্মেন্টস খাতের চেয়ে প্রযুক্তিশিল্পে মনোযোগ বেশি দিচ্ছে। কারণ, পোশাক খাতের মূল্যসংযোজন ক্ষমতা কম ও শ্রমিক বঞ্চনার সুযোগ বেশি। দেশটি নিজের অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে উন্নত বিশ্বের শত বছর আগে পরিত্যাগ করা বস্ত্র খাতকে ব্যবহার করেছে, কিন্তু একটি শক্ত ভিত পাওয়ার শুরুতেই যাতে এই খাত থেকে সরে আসা যায়, তার জন্য মাঠ প্রস্তুত করেছে। এখন স্যামসাংয়ের মতো বড় বড় প্রযুক্তি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান কারখানা গড়ে তুলেছে ভিয়েতনামে। নিজেদের ডিজিটাল অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে অনেক আগে থেকেই ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু করে দেশটি।

ভিয়েতনামের যে শ্রমিক শ্রেণি তাদের মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি, যার কারণ তাদের উৎপাদনশীলতা বেশি। এই উৎপাদনশীল ক্ষমতা অর্জনে দেশটির সরকার মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যয় করে অনেক বেশি। বাংলাদেশ সরকার মানবসম্পদ খাতে যে অর্থ ব্যয় করে, তার বড় একটি অংশ চলে দুই পায়ের রাহুর গ্রাসে। ভিয়েতনাম পোশাক খাতে যে অর্থ আয় করে, তার বেশির ভাগই উচ্চ মূল্যসংযোজনের পোশাক থেকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নিরন্তর চেষ্টা শুধু সস্তা পোশাকের বাজারে, যেখানে শ্রমিক শোষণের সুযোগ বেশি, মূল্য সংযোজন ক্ষমতা কম। এ রকম পরিসংখ্যানগত পার্থক্য দেখালে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা সহজে বোঝা যাবে ঠিকই, কিন্তু এই দুই দেশের এমন বৈপরীত্য-পার্থক্য কেন হলো, কীভাবে হলো কিংবা কী করা যায়, সেটি বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের চেয়ে এই দুই দেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও চলার গতিধারা বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সেখানেই বাংলাদেশের ভিয়েতনামের ধারে-কাছে যাওয়া এবং টেকসই একটি উন্নয়নের কাঠামোবদ্ধ ট্রেনে ওঠার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে। তা না-হলে নীতিনির্ধারক কিংবা সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের উন্নয়ন-উন্নতি নিয়ে যত কথাই বলুক না কেন, বৃথাই সময় ও শ্রম নষ্ট হবে। তারপরও যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে পলকা বাতাসে আবারও শূন্য থেকে শূন্যে ফিরে যেতে হবে।

বাংলাদেশের জনমানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমরা সবাই কমবেশি জানি। এখানে আগাগোড়া নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণকেও প্রকারান্তরে অনিরপেক্ষ এবং একপক্ষের প্রতি সূক্ষ্ম পক্ষপাতিত্ব বলে নির্দ্বিধায় উড়িয়ে দিয়ে জাতে ‘দলকানা’ উপাধি দেওয়া হয়। সবকিছুই এখানে বিভক্তির মাপকাঠিতে মাপা হয়। তাই ভিয়েতনামের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র উদ্ঘাটন করা নিরাপদ বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে শুধু দুটি পরিসংখ্যান লক্ষণীয়। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার সূচক বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে ভিয়েতনামের অবস্থান ১৯০ দেশের মধ্যে ৭০তম, বাংলাদেশ দ্বিগুণের বেশি (২.৪ গুণ) দূরত্বে ১৬৮ নম্বরে। কেউ হয়তো বলবেন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের র‌্যাঙ্কিংয়ে তো একই অবস্থানে, ৩৫ নম্বরে ২০২৩ সালে। তবে বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, ভিয়েতনামের ৯ কোটি ৯৬ লাখ, আর কর্মে নিয়োজিত মানুষের বিচারে ভিয়েতনামে ৫ কোটি ২৪ লাখ, বাংলাদেশে ৭ কোটি ৮২ লাখ। এখানে দুই দেশের এই পার্থক্যের বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়, সম্প্রদায়গতভাবে ভিয়েতনামের মানুষ সমষ্টিবাদ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর বেশি জোর দেয়, যা মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধ থাকা এবং সংহতির অনুভূতি তৈরি করে। 

ভিয়েতনামের মানুষ তাদের সম্প্রদায়গত ঐক্যের জন্য গর্বিত, যেখানে সবাই একে অপরকে সমর্থন করে, পাশের মানুষটির উন্নতিকে নিজের উন্নতি বলে বিশ্বাস করে। কঠোর পরিশ্রমী ভিয়েতনামিজদের অল্প বয়স থেকেই কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা তৈরি করে দেওয়া হয় এবং শেখানো হয় সমস্যা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়। মূল্যায়নভিত্তিক শক্তিশালী কর্মনীতির এই দেশে মানুষ স্থিতিস্থাপকতা, অভিযোজন ক্ষমতা এবং সম্পদশালী হওয়ার ক্ষমতা অর্জনে সংঘবদ্ধভাবে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী, যা বন্ধুত্ব ও ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে গর্বিত এই দেশের মানুষ বিপদের বন্ধুকে নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করে, চিরকাল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে অধিষ্ঠিত রাখে। কারণ, এই দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, ব্যক্তির মনের অবস্থাই কেবল তার চারপাশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ, কেউ যদি দেশপ্রেম মানসিকতা বহন করে, তাহলে তা সমাজের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশকে কোনো না কোনোভাবে সমৃদ্ধ করে, যা দিন শেষে ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই নিশ্চিত করে।

বাংলাদেশ ও তার আশপাশের দেশগুলোতে অর্থনীতি শাস্ত্রের চর্চা শুরু হয় কয়েক হাজার বছর আগে, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের (৩২৬-২৯৮) প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তের প্রধান পরামর্শদাতা দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, কূটনীতিক এবং বহুবিধ গুণের অধিকারী কৌটিল্যের হাত ধরে। তিনি এই ভূখণ্ডের মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করে ‘অর্থশাস্ত্র’ নামের জগৎবিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। অথচ এখন বাংলাদেশের মানুষের অনেকের এমনকি অনেক অর্থনীতিবিদেরও অজানা যে অর্থনীতি শাস্ত্রে ‘বিহেভিরিয়াল ইকোনমি’ নামে একটি বিশেষ ক্ষেত্র আছে, যেখানে বলা হয় যে মানুষের মনোজাগতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বিহেভিরিয়াল ইকোনমি কাজ করে, যেখানে মানুষ যা চিন্তা করে তা-ই তার আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ভাষার মতো অর্থনীতির তত্ত্বকাঠামোও সতত পরিবর্তনশীল। কিন্তু আচরণের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পাল্টাতে দীর্ঘ সময় লাগে, তা-ও আবার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এখানে সদাই মনে রাখতে হবে। এই দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এখানে খেয়াল করতে হবে, এই মানসিকতার শিকড় কতটা গভীরে।

ভিয়েতনামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মাসিক বেতন শুরু হয় বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ৫ হাজার দিয়ে, অধ্যাপক হলে ২ লাখ ৬৯ হাজারে। কিন্তু একজন স্কুল শিক্ষকের বেতন শুরু হয় ৭৬ হাজার টাকা দিয়ে, সিনিয়র পর্যায়ে গেলে ২ লাখ ৫০ হাজারে। বাংলাদেশের স্কুলের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকেরা কত বেতন পান, তা অনেকেই জানেন, তাদের ন্যায্য বেতন-বোনাস ও বকেয়া চাইতে গিয়ে আট-নয় ক্লাস পাস করা আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের লাঠির আঘাত কেবলই পিছু টানে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা বৈষম্য নিরসনে এখন তো লেখাপড়া বন্ধ করে সড়কেই নামেন। শিক্ষকদের মর্যাদা দেওয়ায় ভিয়েতনামে ২০২২ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৯৬ শতাংশ (বাংলাদেশে ৭৩ শতাংশ,তা-ও জগাখিচুড়ি পরিসংখ্যানে)। ভিয়েতনাম ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে, তখন সাংবিধানিকভাবে নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলে। তথাকথিত গণতন্ত্রের ধারক-বাহক যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা ছাড়া আর সবকিছু অস্ত্র সহ্য করা এই দেশ মার্কিনদের বিতাড়িত করে সেই যে বলেছে যে সে ‘সমাজতান্ত্রিক’, এখনো তা নিয়ে দেশটি গর্ব করে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের মতো সমাজতন্ত্রকে সাজিয়ে নিয়ে দেশটি জমির ওপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে, অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় উদ্যোগকেই উৎসাহিত করেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে সমাজতন্ত্র সংবিধানে লিপিবদ্ধ করলেও, তা শুধু কাগজের অক্ষরে সীমাবদ্ধ রেখে পুরোপুরি ভোল পাল্টে ক্রনি ক্যাপিটালিজমে বা স্বজনতুষ্টিবাদী পুঁজিবাদের পূজা করে। বাংলাদেশ টাকার কুমির (ধনকুবের) সৃষ্টিতে ২০১৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার পর তা ধরে রাখতে এখনো বদ্ধপরিকর। অথচ ভিয়েতনাম আইন ও নীতিমালা এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে, যাতে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টি না হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ভিয়েতনাম প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর বাংলাদেশ ধনীদের আবাসস্থল গুলশান-বনানীর উন্নয়নে প্রতিবছর যে অর্থ ব্যয় করে, তার সিকি শতাংশও যদি কুড়িগ্রাম-রংপুরে ব্যয় করে তাহলে কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়ে যায়। ভিয়েতনাম গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, যেকোনো বৈদেশিক চুক্তিতে টেকনোলজি ট্রান্সফারকে বাধ্যতামূলক করে। আর বাংলাদেশ গবেষণায় বড়জোর শত কোটি টাকা ঘোষণা করে, যার বড় অংশ নানা উছিলায় হয় অন্য খাতে সরিয়ে নেওয়া হয়, না-হয় কোষাগারের ফেরত খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়।

ভিয়েতনামের মানুষের মানসিকতার বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতার দীনতা প্রকাশ ও তার তুলনার সবচেয়ে অকাট্য প্রমাণ দিতে হলে কোনো ভণিতা না করে একটি অতি সত্য কথা বলাই যায়, কেননা আমাদের সমস্যার গভীরতা চিহ্নিত করতে বিষয়টি না তুললেই নয়। ভিয়েতনাম তার স্বাধীনতার নায়ক হো চি মিনকে পূজনীয় পর্যায়ে নিতে গিয়ে যা-কিছু করার সব করেছে, এখনো করছে। আর বাংলাদেশ তার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বন্ধুটিকে সপরিবারে হত্যা করেছে, হত্যাকারীদের মানমর্যাদা দিয়েছে এবং খুনিরা ‘খুন করেছি’ বলার পরও আইন করে বিচার থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে। আবার এই খুনিদের ফাঁসির রশিতে যদিও বা ঝুলিয়ে দিতে পেরেছে, তারপরও সংখ্যাস্বল্প মানুষের গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, যারা নিজের ভাগের সব অটুট রেখে পরেরটা থেকেও কিছু না কিছু চেটেপুটে খাওয়ার জন্য সদাই প্রস্তুত হয়ে বসে আছে।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি

Link copied!