ষোলোই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বাঙালির বিজয়ের দিন। এই দিনে দীর্ঘ তেইশ বছরের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের পর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছে। দিনটি গৌরবের, শহিদদের স্মরণের, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তির সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের।
বাংলাদেশ বিজয়ের একান্ন বছর পেরিয়েছে। বায়ান্নতম বিজয়ের দিন এবার। বিজয় অর্জনের এই একান্ন বছরে আমরা এখনও মুক্তির সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারিনি। একাত্তরের রণাঙ্গনের যোদ্ধা ও সংগঠকদের সম্মানিত করার নানা তালিকা আছে, আছে সরকারি বিবিধ সুযোগসুবিধা। এটাও আবার বিতর্কমুক্ত নয়। এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অ-মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়ে গেছে। এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নাম রয়ে গেছে তালিকার বাইরে।
এটা অনুমান থেকে বলা কথা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা কথা। কারণ আমার বাবা আজিজ উদ্দিন চৌধুরীরও নাম নাই মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি তালিকায়। অথচ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই আমাদের এলাকা থেকে বৃহৎ এক দল নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। করিমগঞ্জে ক্যাম্পে খাবারদাবারের দায়িত্বে ছিলেন। অংশ ছিলেন ট্রেনিংয়ের বিষয়েও। এরপর ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে তাদের দল পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিল। তারা শেষমেশ কৌশলে সেখান থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন বটে, তবে অনেক সহযোদ্ধাদের নির্যাতনের সাক্ষী হয়েছিলেন।
বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম যুক্ত করার আবেদন করেছিলেন। এরপর ডাক আসে উপজেলা পর্যায়ের বাছাইয়ে। সেখানে হাজির ছিলেন তিনি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে যে কমিটি ছিল সেখানে কমিটির অনেকেই আমার বাবাকে নাম উঠানোর তালিকায় দেখে অবাক হয়েছিল। কেন নেই তিনি এতদিন এমন প্রশ্নও করেছিলেন একাধিকজন। কিন্তু বাছাই শেষে জানা গেল তাঁর আবেদন গ্রহণ হয়নি। এরপর এই বাছাইকে চ্যালেঞ্জ করে জামুকায় আপিল করেছিলেন তিনি। উল্লেখ করেছিলেন তাঁর শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টিও। যাচাই-বাছাইয়ের যে সাক্ষাৎকার সেখানে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলেও অজ্ঞাত কারণে তাঁর আবেদন গ্রহণ না করার বিষয়টি আমাদেরকে অবাক করেছিল, সাক্ষ্য দিতে যাওয়া সাক্ষীদেরও পরবর্তীতে অবাক করেছিল, আর বাবাকে দিয়েছিল কষ্ট।
আমার বাবা নেই আজ সাড়ে তিন বছর। একেবারে শুরুর দিকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করেননি। মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণের স্বপক্ষে কোন দলিল সংগ্রহ করেননি। ভাবতেন তালিকায় নাম ওঠানোর জন্যে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে এসে চেয়েছিলেন নাম অন্তত থাকুক এই তালিকায়, কারণ রাষ্ট্র যেখানে সম্মান জানাচ্ছে তখন এই গৌরব যেন তার পরবর্তী প্রজন্মদের ছুঁয়ে যায়। আমার বাবার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধা জানেন, বিশ্বাস করেন এবং বলেনও তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হননি। তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকজন রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্যে কথা বলেছিলেন কিন্তু তালিকায় নাম না থাকায় সেটা হয়নি। তালিকায় নাম না থাকার অপ্রাপ্তির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত না হওয়ার অপ্রাপ্তি এখানে রয়ে গেছে।
বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর একটা চিঠি এসেছিল উপাধ্যক্ষ আবদুস শহিদ এমপি আপিল করা সকলের সঙ্গে সিলেটে সাক্ষাৎ করবেন উল্লেখ করে। চিঠি আমাদের কাছে পৌঁছেছিল সাক্ষাতের নির্ধারিত সময়ের পর; ওইদিন অথবা পরের দিন। ‘বাবা নেই কী হবে আর যোগাযোগ করে’ ভেবে আর আগ বাড়িনি। যে অপ্রাপ্তি নিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে গেছেন সে অপ্রাপ্তি থেকেই গেল, থেকেই যাচ্ছে!
অথচ যতবারই এলাকার যত মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়েছে, যতজনই আমাদের পরিচয় পেয়েছেন ততজনই আমার বাবার কথা বলেছেন। তেরোর গণজাগরণ আন্দোলনের সময়ে আমরা সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় অনেক ঘরোয়া বৈঠক করেছি। আম্বরখানা বড়বাজারের তেমন এক বৈঠকে অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান (বর্তমানে প্রয়াত) জানতে চেয়েছিলেন আমি বিয়ানীবাজারের আজিজ উদ্দিন চৌধুরীর কিছু হই কি-না? আমি তাঁর সন্তান বলার পর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করেছিলেন, আমার বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার কথা স্মরণ করিয়ে জানিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের বাড়িতে যাওয়া-আসার বিষয়টি, আমাদের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখার কথাও তিনি বলেছিলেন। লুৎফুর রহমান পরবর্তীতে সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই আব্বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে তিনি সিলেট থেকে কাউন্সিলর হিসেবে ঢাকায় গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর আমাদের এলাকায় বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আব্বা ছিলেন তাদের অন্যতম। খুনিদের আস্থাভাজন প্রশাসন থানায় এক রাত রেখে আমার বাবাসহ অন্যদের কাছ থেকে লিখিত অঙ্গীকার নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার যাতে প্রতিবাদ না হয়! তারা কেউ প্রতিবাদ করতে পারেননি, এই কষ্ট ছিল আমৃত্যু।
এখন বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী রাজনৈতিক মহল প্রচার করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ হয়নি দেশে, কিন্তু তারা এড়িয়ে যায় কী কারণে বড় প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদ মোকাবেলার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল খুনিরা, প্রতিবাদের সকল রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল সারাদেশে এভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে, নির্যাতন করে, লিখিত অঙ্গীকারনামায় সই করিয়ে। এটা কেউ বলে না, এটা অনেকেই হয়তো জানেও না।
বাংলাদেশের বিজয় দিনে প্রতিবারই আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে ‘ধন্যবাদ’ জানাতাম। সরকারি তালিকায় নাম থাকা না থাকা এখানে মুখ্য ছিল না, কারণ তিনি আমাদের মতো এলাকার মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা সকলের কাছেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি হাসতেন। আনন্দ পেতেন। রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতি না পেলেও পরিবারের সদস্য ও এলাকার সকলের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন; কে জানে এটাই হয়তো আনন্দ ছিল তাঁর!
একান্ন বছরের বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সঠিক ও বিতর্কমুক্ত তালিকা নাই, তালিকা নাই দেশবিরোধী শান্তি কমিটি-রাজাকার-আল বদর- আল শামসদের; এটা নিছক দুর্ভাগ্যই নয়, এটা কষ্টের ইতিহাসও। সরকার বারবার বলছে, কিন্তু এটা বক্তব্য ও অঙ্গীকারের পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে পূর্ণাঙ্গ তালিকা নাই সেখানে এখনও ভাবা যাচ্ছে না মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী মুক্তির সংগ্রামীদের তালিকা। অথচ তাদের দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে এসেছিল দেশ।
আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসকে যদি কেবলই নয়মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে দিয়ে বিচার করি তবে বোধহয় পূর্ণাঙ্গ হয় না বাংলাদেশের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে ষোলোই ডিসেম্বরের বিজয় যদি হয় চূড়ান্ত অর্জন, তবে দীর্ঘদিনের মুক্তির সংগ্রাম সেই বাংলাদেশের সোপান। আমাদের উচিত হবে না সেটা অগ্রাহ্য করার।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক