এবারের নির্বাচনটি যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ভোটাররা অনেক আগে থেকেই বাইডেন প্রশাসনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। সেই অস্বস্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য ভোটাররা এমন কাউকেই চাচ্ছিলেন যিনি দেশের মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দিতে পারবেন। তারপরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই জয় অনেকাংশে বিস্ময়কর। কারণ গোটা দেশ জানে ট্রাম্প একজন ফৌজদার আসামি, প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বলেন এবং বর্ণবাদী। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা তাকেই বেছে নিয়েছেন। অথচ নির্বাচনের আগে রাজনীতি-বিশ্লেষকদের মতে, পপুলার ভোটেও ট্রাম্পের জয়ের আশা ছিল ক্ষীণ। হিসেবটি ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের। হয়েছে তার উল্টো। পপুলার ভোট এবং ইলেকটোরাল ভোট—দুটোতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প চমক দেখিয়েছিলেন।
অনেক আশা করে ওয়াশিংটন কলেজ কমলাকে নিয়ে উদযাপনের প্রস্তুতি রেখেছিল। অথচ সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমলা নির্বাচনের দিন কোনো মন্তব্য করবেন না। এই নির্বাচনের ফল নিয়ে তাই তার মতামত জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সে মতামত আর কী হবে? নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই তার।
ট্রাম্পের এই প্রত্যাবর্তন যেকোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের জন্য একটি বড় চমক। আদৌ কি তা-ই? এমনটি বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্প যেন বরাবরই ক্লাসের দুষ্ট ছেলেটির মতোই। এর আগে বাইডেনের কাছে পরাজয়ের পর ২০২২ সালের মিডটার্মেও ট্রাম্পকে পরাজয় বরণ করতে হয়। শুধু কি তাই? ট্রাম্প ‘স্টুপিড’, ‘বোকা’ ইত্যাদি সম্ভাষণ পেয়ে এসেছেন। এরপর এসেছে করোনা মহামারি এবং গোটা বিশ্ব যে মাল্টিপোলার গতিতে এগিয়েছে সেখানে ট্রাম্পের অবস্থান ছিল দেশের অভ্যন্তরেই। দীর্ঘদিন ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা কমলা হ্যারিস বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক বিষয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ট্রাম্প সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন, ২০১৬ সালের বাস্তবতা এবং ২০২৪ সালের বাস্তবতা এক নয়। এক্ষেত্রে তার সৌভাগ্যও কিছুটা কাজে এসেছে। প্রথমবার তাকে হত্যাচেষ্টা করার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সহিংসতা এবং মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে ট্রাম্প মানুষের কাছে রাতারাতি একজন বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। এমনকি ট্রাম্পের কটূক্তি যেকোনো সুশীল সমাজের কাছে মন্দ মনে হলেও সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক এবং পূর্বতন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হয়েছে। এজন্যই এবারের নির্বাচন ছিল অস্বস্তির। কারণ সংবাদমাধ্যমে আমরা যে জরিপ পেয়েছি, সেগুলো সীমাবদ্ধ কয়েকজন ভোটারদের নির্ধারণ করেই যাচাই করা হয়। বাস্তবে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো এমনকি মধ্যবিত্ত মার্কিনীরা অপেক্ষায় ছিলেন ভোটের, অন্তত তেমনটিই মনে হচ্ছে।
ট্রাম্পের কাছে কমলার এই হারকে অবধারিত এখন মনে হচ্ছে যদি আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ভোটকে বিচার না করি। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো এতটাই স্থিতিশীল যে গোটা বিশ্ব এখনও এই ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাই ট্রাম্পের জয়কে গণতন্ত্রের অন্ধকার বলে লাভ হবে না। কমলা হ্যারিস তার বিজ্ঞাপনী প্রচারে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ দুটো বিষয়েই আলোচনা করেছেন। কিন্তু তার প্রচারের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় লক্ষ্য করতে হবে সাংস্কৃতিক আঙ্গিকে। নিজের বিজ্ঞাপনী প্রচারে কমলা হ্যারিস প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা প্রাথমিকভাবে উদ্বেগ জানিয়েছেন। নিজের সমাবেশে তিনি টেইলর সুইফট, বিয়ন্সে এমনকি লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে উপস্থাপন করেছেন। ফলত কমলা হ্যারিস পপুলার প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। অনেকটা ফ্যাশনেবল ও বাণিজ্যিক আবহ থাকায় এ নির্বাচনের সমাবেশগুলোয় তার বার্তা আমেরিকানদের কাছে কিভাবে পৌঁছেছে? আধুনিক দেশ হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখনও রক্ষণশীল এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন, রোনাল্ড রিগ্যান কিংবা ওবামার মতো উচ্ছ্বাসের যুগ তার নয়। বরং তার নির্বাচনী সময়টি অস্বস্তির। দেশটির উচ্চবিত্ত শ্রমিকশ্রেণি এবং নিম্নমধ্যবিত্তরা মূল্যস্ফীতির চাপে-তাপে পিষ্ট হয়ে সামাজিক গুরুত্ব হারাতে বসেছেন। তাদের দরকার আর্থিক নিরাপত্তা। যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্মের একাংশ যদিও উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ কিন্তু তারাও অনুধাবন করতে পারে পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি গড়ারও সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই ট্রাম্পকে পুঁজির লেজুড় বলে দাবি করেন। কিন্তু এমন ধারনা ভুল। ট্রাম্পের কটূক্তি ও বক্তব্যের ভাষাই বলে দেয় তিনি এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধেই বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি নিজেই তো বলেছেন, তার মনে যা আসে তা-ই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেন। এমনকি এলিট ও সুশীল সমাজ তাকে নিয়ে কী ভাবে তা নিয়ে ট্রাম্পের কিছু আসে যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প একজন সাংস্কৃতিক যোদ্ধা হয়ে এসেছেন। বিগত একযুগ ধরেই তিনি আমেরিকার পরিচয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। বর্ণবাদের সহিংস বাতাবরণের ঘাত-প্রতিঘাতের সময় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর রক্ষণশীল, খ্রিষ্টান ও শ্বেতাঙ্গরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তারা বরং নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবতে শুরু করেন। তাছাড়া কমলা হ্যারিসের বিজ্ঞাপনে ট্রান্সজেন্ডার ও এলজিবিটিকিউ প্লাস আন্দোলনে সমর্থনের বিষয়টি গোটা দেশের এই ভোটারদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। ট্রাম্পের জন্য আরেকটি বড় সুবিধা ছিল ইলন মাস্কের সমর্থন। যদিও বিষয়টি বিতর্কিত কিন্তু শিগগিরই তা ফল এনে দিয়েছে।
ট্রাম্পের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনে আমাদের দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তেমন বড় পরিবর্তন আসবে না। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা যে মত দিয়েছেন সেগুলোই পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আদর্শের ভিত্তিতে কিছু নীতি অবশ্যই আসবে। সেগুলোর প্রভাব পড়বে বিশ্বে। প্রথমত, ইসরায়েলের প্রতি তার যে বড় সমর্থন তা বজায় থাকবে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির উন্নতি আসলে কেমন হবে তা জানা যাচ্ছে না। তবে ট্রাম্প এই নির্বাচনে যতগুলো সমাবেশ করেছেন সেগুলো থেকে কয়েকটি আভাস পাওয়া গেছে। অন্তত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণের সুযোগটি ট্রাম্প ছাড়বেন না। কারণ তার ওপর আসা ফৌজদারি অভিযোগ তো আছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্থিতিশীল ও দ্বিধাবিভক্ত সমাজ। অভিবাসীদের জন্য এবার সত্যিই শঙ্কা বেড়েছে এমনকি অভিবাসনপ্রত্যাশীরাও দুশ্চিন্তায়। আধুনিক বিশ্বে বাণিজ্যযুদ্ধের একটি আভাসও পাওয়া গেছে। অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি কমাতে ট্রাম্প জানিয়েছিল, আমদানিপণ্যে শুল্ক আরোপ করবে ১০-২০ শতাংশ। চীনের ক্ষেত্রে তা ৬০-২০০ শতাংশ। অর্থাৎ চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার এখন প্রতিষ্ঠিতই। চীন থেকে ইউক্রেন পর্যন্ত ট্রাম্পের অনেক নীতিই যে অস্থিতিশীলতা আনবে তাও অনেকাংশে অনুমান করে নেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তার গতিতে চললেও প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় ন্যাটো, ইউরোপীয় বাণিজ্য বিপাকে পড়বে। এমনকি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এবার ঘন ঘন আন্দোলনও দেখা যেতে পারে। এসব কিছুর প্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত হতে পারবো না। এর পরোক্ষ প্রভাব যে আমাদের ওপরও পড়বে তা অনেকটাই নিশ্চিত। তারপরও বড় ধরনের দ্বিপাক্ষিক পরিবর্তন অন্তত আমাদের দেশে পড়ছে না। এক্ষেত্রে আমাদের কূটনীতিকদের তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। বিশ্ব ক্রমশ পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছে। যুক্তরাষ্ট্র সেদিকে মোড় নিলো এবার।
ট্রাম্পের অফিসে সময়কালে করোনা মহামারির সময় সারা দেশে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু সে দোষ তার গায়ে চাপেনি। এই ব্যর্থতার পরও ট্রাম্পের গায়ে এমন অভিযোগ আসেনি। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প মফস্বল থেকে শুরু করে বিভিন্ন টিভিতেও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পুরুষ ভোটারদের গ্যাপটাও এবার ছিল বিশাল। প্রায় ৫২ শতাংশের বিপরীতে ৪৯ শতাংশ নারী। তবুও জয় যেকোনো দিকেই যেতে পারতো। মূল বিষয় হলো, ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন তিনি অস্বস্তির যুগের প্রেসিডেন্ট হবেন। সেভাবেই তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ডেমোক্র্যাটরা অনেকভাবেই ট্রাম্পকে ঠেকাতে পারতেন। ব্যর্থ হয়েছেন। সেসব নিয়ে তাই আলোচনা না করাই শ্রেয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী