আজ গোটা বিশ্বের খ্রিষ্টভক্তগণ পালন করছে পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের বিজয় উৎসব। খ্রিষ্টের অনুসারীদের সকল ভক্তের অন্তর আজ উৎসবে মুখরিত, আনন্দে উদ্বেলিত। কারণ যিশুখ্রিষ্ট মৃত্যুকে জয় করে আবার বেঁচে উঠে পাপের দাসত্ব থেকে আমাদের মুক্ত করেছেন। এই উৎসবমুখর দিনে সবাইকে জানাই প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা।
খ্রিষ্টের যাতনা ভোগ, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পূর্বে খ্রিষ্টভক্তগণ চল্লিশ দিন উপবাস, দান-দক্ষিণা, আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে নিজেদের পাপময়তা থেকে মুক্ত করার জন্য সাধনা করেছেন। শুধু শারীরিক উপবাসই নয়, মানসিক উপবাসেরও প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেহ-মনের নানা প্রকার চাহিদা পূরণ থেকে নিজেদের বিরত রাখাই হলো মনের উপবাস। বিশেষ করে আমাদের বদভ্যাসগুলো সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা। রাগ, হিংসা, পরচর্চা, কুৎসা রটানো, লোভ-লালসা, অতি মাত্রায় পান-ভোজন এসবই আমাদের ক্ষতিকর অভ্যাস। কু-অভ্যাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজদের পরিশুদ্ধ করে সূচি-শুদ্ধ হয়ে ওঠাই হলো তপস্যাকালের প্রচেষ্টা। এই সময়টিতে যিশুর যাতনা ও ক্রুশ মৃত্যু ধ্যান করে আত্মায় বলশালী হয়ে যিশুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁর সঙ্গে যাত্রা করতে পারি এবং মন্দর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি লাভ করে থাকি।
যে যিশুকে আমরা অনুসরণ করি, সে যিশু কে? কেন তাঁকে এরূপ অকথ্য যাতনা দিয়ে জঘন্যতম পাপীর মত ক্রুশে টাঙ্গিয়ে হত্য করা হল?
যিশুখ্রিষ্ট হলেন একজন প্রবক্তা, মোশীহ, একজন অভিসিক্ত মুক্তিদাতা। তিনি দরিদ্র বেশে, দীন-দরিদ্রদের মাঝে জন্ম নিয়ে তাদের মতো জীবনযাপন করেছেন। তাঁর কর্ম ও সামাজিক জীবন ছিল মাত্র তিন বছর। তাঁর বাণী প্রচার, শিক্ষাদান ও সেবাকর্ম ছিল, ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি উচ্চ পদস্থ, জ্ঞানীগুণী, ধনী, প্রভাবশালীদের মধ্যে নয়, বরং শোষিত-শাষিত, নির্যাতিত-অবহেলিত, হতদরিদ্রদের নিয়েই কাজ করেছন। তিনি তৎকালীন ধর্মীয় নেতা ও সমাজপতিদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এবং অসহায় ও বিধবাদের পক্ষ সমর্থন করেছেন।
তিনি ছিলেন নম্র-বিনীত, উদার ও ভালবাসার মানুষ। তাই তাঁর কথাবার্তা আচার-আচরণে ঝরে পড়ত ভালোবাসার ঝরনাধারা। তাঁর প্রচারের মূল বিষয় ছিল, ‘স্বর্গে তোমাদের একজন পিতা আছেন, যিনি তোমাদের ভালবাসেন, তোমরাও তাঁর মত পবিত্র হও।’ তোমরা মানুষদের নিজের মত ভালোবাস। প্রাচীনকালে বলা হতো, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ। তোমরা কিন্তু প্রতিশোধ নিও না, বরং কেউ যদি তোমার একগালে চড় মারে, তোমার আরেকটি গাল তার দিকে ফিরিয়ে দাও। কেউ যদি তোমার গায়ের জামাটা কেড়ে নেয়, তবে চাদরটাও তাকে দিয়ে দিও।”
তাঁর মুখের মধুর বাণী শোনার জন্য জনতা পাগলের মত ছুটত তাঁর পিছু পিছু। তাঁর সেবা কাজ ছিল প্রেমপূর্ণ সেবা। অসুস্থ, অসহায় ব্যক্তিদের তিনি অশুচি বলে ঘৃণা ভরে দূরে ঠেলে দেননি, বরং তাদের কাছে টেনে নিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। এ জন্যই তো অন্ধ দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেয়েছে, খোঁড়া হেঁটে বেরিয়েছে, মৃতজন পেয়েছে সঞ্জিবনী শক্তি।
তাঁর এই সুন্দর জীবনযাপন, ন্যায় ও শান্তির বাণী, প্রেমপূর্ণ সেবাকাজ ফরিসী (যিশুর সময়ে ইহুদিদের একটি সম্প্রদায়) ও সমাজপতিদের ভাবিয়ে তুলেছিল, পাছে তাঁর বিরাট অনুসারীরা তাঁকে রাজা বানিয়ে ফেলে। এই ভয়ে তাঁর প্রতি বিরুদ্ধচারী হয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে। নানাভাবে তাঁকে ফাঁদে ফেলার সুযোগ খোঁজে। শেষ পর্যন্ত তারা তাঁকে লজ্জাজনকভাবে ক্রুশে টাঙ্গিয়ে মেরে ফেলার সিদ্ধন্ত নেয়। মৃত্যুর পূর্বে যিশু আঠার ঘণ্টা অমানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন; তাঁকে জঘন্য পাপীর মতো মৃত্যুবরণ করতে হয়। বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাঁকে দোষী সাবস্ত করে।
রোমীয় শাসনকর্তা ক্ষমতালোভী, কাপুরুষ পিলাত যিশুকে নির্দোষ জেনেও ক্রুশ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। মৃত্যুর আগের রাত্রে ভাড়া করা একদল সন্ত্রাসী দিয়ে অভিনব উপায়ে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। মাটির নিচে একটি নোংরা কক্ষে নিয়ে তাঁর ওপর শারীরিক, মানসিক ও অনৈতিকভাবে নিপীড়ন চালানো হয়। কাঁটা জড়ানো লতা গাছ দিয়ে ভারী একটি মুকুট তৈরি করে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়ে, হাতে একটি লাঠি দিয়ে তাঁকে নকল রাজা সাজিয়ে মাথায় আঘাত করে রাজা বলে বিদ্রূপ করা হয়। তিনি বধ্যভূমির মেষের মত সমস্তই নীরবে সহ্য করেন।
এবার বৃহৎ ভারী একটা ক্রুশ তৈরি করে তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে, তাঁকে নিয়ে তারা কালভেরীর পথে যাত্রা শুরু করে। সারা রাত অনাহরে, চলমান নির্যাতনে তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে শত্রুরা নিষ্ঠুরতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাঁর ওপর পৈশাচিকভাবে চাবুক মারতে মারতে কালভেরী পর্বতের দিকে এগিয়ে চলে।
অনাহার ও অতি মাত্রায় রক্ত ক্ষরণ হওয়ায় তার দেহের শক্তি প্রায় শেষ হয়ে যায। রাস্তায় তিনি তিনবার পড়ে যান। সৈন্যরা তাঁকে আঘাত করতে করতে, টেনেহিঁচড়ে নিয়ে কালভেরী পর্বতে পৌঁছায়। এবার ক্রুশ কাষ্ঠের ওপর তাঁকে শুইয়ে দিয়ে তাঁর হাতে-পায়ে প্রায় আট কেজি ওজনের চারটা পেরেক নিষ্ঠুর ভবে গেঁথে দেয়। যিশু যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। পেরেক গাঁথার কাজ সমাপ্ত করে ক্রুশটি মাটিতে পুঁতে দাঁড় করিয়ে দেয়। তিনি ব্যথা ও যন্ত্রণায় কাৎরাতে থাকেন। বিরাট জনতার সামনে প্রেমের ঠাকুর, যিশু ক্রুশে ঝুলছেন; দীর্ঘ তিন ঘণ্টা তিনি মৃত্যু যাতনা ভোগ করেছেন।
মৃত্যু মুহূর্তে মানব জাতির উদ্দেশ্য যিশু শেষ বাণী উচ্চারণ করে বলেন, “পিতা এদের ক্ষমা কর, এরা কী করছে, তা এরা জানে না।” এরপর পিতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই সময়ে বিকট ভূমিকম্প হলো, পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে গেল। ক্রুশের নিচে উপস্থিত সকলে ভয়ে চিৎকার করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল। এতক্ষণ যেসব সৈন্যরা দাপট দেখিয়ে যিশুকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে যাচ্ছিল, তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্বীকার করল, ‘এ ব্যক্তি সত্যিই ঈশ্বর পুত্র ছিলেন।’ এরপর যিশু মাথা নত করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
কবরে আটকে রাখা যায়নি যিশুকে। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। আজকের দিনে আমরা পরস্পরের সঙ্গে খ্রিষ্টের শান্তি ও নতুন আশার বাণী ভাগাভাগি করি, শুভেচ্ছা জানাই। যিশুর ক্ষামার বাণীকে ছড়িয়ে দিই। এ কেমন বাণী? সর্বযুগের মহাানায়ক, কালজয়ী যিশু ছাড়া কে কবে তার শত্রুদের জন্য এমনভাবে ক্ষমার বাণী উপহার দিতে পেরেছে? নির্যাতনের পরিবর্তে অভিশাপ বাণী নয়, ক্ষমার বাণী, যে বাণী প্রেমের বাণী, হৃদয় গহীনে নিমজ্জিত ভালবাসার বাণী। এ বাণী পার্থিব নয়, যুগান্তকারী ঐশ্বরিক বাণী। এ বাণীতে কোনো শর্ত নেই, এ যে নির্ভেজাল বাণী। কোনো অর্থের মূল্যে এ বাণী ক্রয় করা যায় না, শুধু হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা থেকে উৎসারিত হয়ে পূণ্য পবিত্র জিহ্বা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
আসুন, যিশুখ্রিষ্টের ভালবাসায় নিঃসৃত এই ক্ষমার বাণী বারবার শোনার চেষ্টা করি, এর শক্তি ও গভীরতায় প্রবেশ করি এবং যিশুর মতো তা বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। তাই আসুন, যেখানে হিংসা, প্রতিশোধ, বিচ্ছিন্নতা, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কোন্দল, সেখানে শুনিয়ে যাই ক্ষমার বাণী; কারণ ক্ষমা করার শক্তিই যে সর্বোচ্চ শক্তি, এতেই নিহিত রয়েছে শান্তি ও প্রেমের বাণী।
সবাইকে জানাই শান্তি, আলোকময় শুভেচ্ছা।
লেখক: সিস্টার , এসএমআরএ।