ঈগলের মতো ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি ছিলেন আপন লক্ষ্যে স্থির, নির্ভীক ও সাহসী। তাঁর নির্ভীকতা, তাঁর সাহস রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করেছেন দৃঢ়চেতা ঈগলের মতোই, বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার প্রস্তাব অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিজের যাপিত জীবনের সব নিয়ম তৈরি করেছেন তিনি নিজেই। নিজের তৈরি করা নিয়মের উচ্চতা স্পর্শ করার মতো আর কেউ ছিল না।
দুই
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আগরতলার মেলাঘরে তার গড়ে তোলা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের ধারাবাহিকতাতেই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতায় সাভারে গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সেখান থেকেই তিনি ‘গরিবের ডাক্তার’ বলে পরিচিত হন। গণস্বাস্থ্য নিয়ে তার অবদান দেশে রোল মডেলের কাজ করে চলেছে। ১৯৭১ সালের সেক্টর-২-এর ফিল্ড হাসপাতালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি স্বল্প ব্যয়ে গণমানুষের চিকিৎসার উদ্যোগ নেন। অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম মেয়েদের সাইকেলে চড়িয়ে মানুষের দোরগোড়ায়, গ্রামে পাঠিয়েছিলেন স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য। ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রান্তিক গরিব কৃষক পরিবারের মেয়েদেরকে গাড়ির চালক হিসেবে এবং নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেন। নিরাপত্তরক্ষী হিসেবে তিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও নিয়োগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যাবশ্যকীয় সে ফিল্ড হাসপাতাল আর বাংলাদেশের ওষুধ নীতি—এ দুটো করতে গিয়ে যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেখানে এ কর্মবীরের তুল্য আর কাউকে পাওয়া যাবে না। পৃথিবী এমন মানুষ একবারই পায়। তাঁর স্বপ্নের রথে সওয়ার হবে এমন সারথীর চেয়ে প্রতিপক্ষের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তিনি তা খুব ভালোভাবেই জানতেন। তাতে আক্ষেপ ছিলো না তার। প্রতিপক্ষের প্রতিও তিনি ছিলেন উদার। প্রত্যাশা করতেন, তাদের মধ্যেও একদিন জন্ম নেবে শুভবোধ।
তিন
একটি মানবিক সমাজ গড়ার অদম্য ইচ্ছেকে আমৃত্যু লালন করেছেন তিনি। মুনাফামুখী নির্মানবিক পৃথিবীর প্রতি বারবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী। নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের দুরূহ কঠিন লক্ষ্যে।
চার
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও বিতর্কে ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি। তাঁর একটা বিষয় আমাকে কষ্ট দিয়েছিল, হয়তো অনেককে পীড়িত করেছিল, তা হলো তিনি রাজনীতির নোংরা পাঁকে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যেটা তার কাছ থেকে আমরা অনেকেই আশা করিনি। যা তার উচ্চতাকে উপহাস-বিদ্রূপ করেছিল বলেই মনে হয়। তার মতো উচ্চতাসম্পন্ন একজন মানুষ কেন বিএনপি বা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের নোংরা নিজের গায়ে মাখবেন তা আমার ভাবনাতীত ছিল। তিনি তো এদের কাছ থেকে কোনো সুযোগ সুবিধা নেননি বলেই জানি। তাঁর মতো মানুষের নেওয়ার কথাও না। তবু তিনি সেই পাঁকে জড়িয়েছেন এবং নানা বেফাঁস কথা বলেছেন অনেক স্পর্শকাতর ইস্যুতে, যা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একদম খাপ খায় না।
তবু তার অবদান অনস্বীকার্য। যা তাকে মৃত্যুর পরও অমর করে দিয়েছে। তিনি মানবকল্যাণের জন্য তার শরীরও হাসপাতালে দান করে গেছেন।
হে বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা আপনার ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক