পর্দায় অভিনীত নেতিবাচক চরিত্রকে মানুষ কখনো তার আদর্শ বানায় না। চলচ্চিত্রে যে ভিলেন, নায়িকাকে তুলে নিয়ে যায়, অশ্লীল ইঙ্গিত করে, মানুষ কখনো সেই নেতিবাচক ভিলেন ব্যক্তিটি হতে চায় না। মানুষ হতে চায় নায়ক। যে নায়ক আরেকজন মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, রক্ষা করবে। বাংলা চলচ্চিত্রে নেতিবাচক ও ইতিবাচক পৌরুষত্বের ছড়াছড়ি। যেহেতু সমাজ পুরুষপ্রধান, তাই চলচ্চিত্রের সব ক্ষেত্রেও এর প্রতিফলন রয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, পর্দায় ইতিবাচক তথা নায়ক চরিত্রে অভিনয় করা একজন তারকার ব্যক্তিজীবনে নেতিবাচক চরিত্র দেখে হতাশ হতে হয়। বাংলাদেশে, চলচ্চিত্র জগতের তারকা শিল্পীরা সাধারণ মানুষের জীবনে নানা ভূমিকা রাখেন। শুধু বাংলাদেশ কেন বলছি, বিশ্বের সব জায়গায়, সাধারণ মানুষ যাদের মতো হয়ে উঠতে চান, যাদের মতো জীবনযাপন করতে চান, যাদের অনুসরণ করেন, তাদেরকেই তো তারকা বলে।
পশ্চিমে আম্বার হার্ডের বিরুদ্ধে জনি ডেপের করা মানহানির মামলা নিয়ে পৃথিবীর মানুষের উত্তেজনা দেখলে বুঝতে পারা যায়, তারকাদের ব্যক্তিজীবন, আদতে শুধু ব্যক্তিগত থাকে না। আপনি যখন তারকা, তখন সাধারণ মানুষের কাছে আপনার দায়বদ্ধতা আছে। আর সেটি হলো, মানুষ হিসেবে আপনি কতটুকু মানুষ।
একজন তারকা গোপনে বিয়ে করতেই পারেন। তারকার ব্যক্তিজীবন কি থাকবে না? আলবত থাকবে, কিন্তু বিষয় হচ্ছে, আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, একই ধরনের কাজ পুরুষ করলে সেটা পুরুষের ‘ব্যাটাগিরি’ আর নারী করলে সেই নারী দুশ্চরিত্রা, ছলনাময়ী। যেহেতু একটি সুনির্দিষ্ট ধর্ম পুরুষকে একাধিক বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে, এবং যেকোনো সময় স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার দিয়েছে, যেকোনো পুরুষই নায়ক হোক বা না হোক, নিজের ব্যাটাগিরি ফলাতে ইচ্ছেমতো বিয়েও করে থাকেন, আবার তালাকও দিয়ে থাকেন। এটি খুবই নীচু মানসিকতা। এই মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই একটি অংশ।
অনেকেই হয়তো বলতে পারেন যে উনি তো বিয়ে না করেই এত কিছু করতে পারতেন, বিয়ে যেহেতু করেছেন, অন্তত সম্মানটুকু তো দিয়েছেন। যিনি নেতিবাচক পৌরুষত্ব নিজের মননে মগজে আচরণে ধারণ করেন, তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তিনি যেমন ইচ্ছেমতো বিয়ে করতে পারবেন, তেমনি তালাকও দিতে পারবেন। আমাদের সমাজে, পুরুষ বিয়ে করে, আর মেয়েদের বিয়ে হয়, বা আরও বাজেভাবে বললে, মেয়েরা বিয়ে বসে। এই ‘বিয়ে করা’ বিষয়টি পুরুষকে কর্তা বানায়, স্বামী বানায়। তাই পুরুষ বিয়ে করে, তারা মনে করে বিয়ের মাধ্যমে একটি নারীকে সে উদ্ধার করে ফেলেছে, বা তাকে ‘স্ত্রীর পরিচয়’ দিয়ে সম্মান দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, পুরুষকে ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, নারীকে ‘সম্মানিত’ বানানোর।
পুরুষতন্ত্রের ভাইরাস শুধু পুরুষ বহন করে না, নারীও বহন করে। তাই একজন পুরুষতান্ত্রিক নারী মনে করেন, পুরুষ তাকে বিয়ে করে সম্মান দিয়েছেন, একজন পুরুষ তার ‘দায়িত্ব’ নিয়েছেন, বিয়ের মাধ্যমে। নারীকে ঊনমানুষ করে রাখে তার ভাবনা, তার মানসিকতা। তাই এখনো, নারীর কাছে সঙ্গী পাওয়ার চাইতেও, বিয়ে হচ্ছে সম্মানজনক পদবি, সন্তানের জনকের নাম এবং তথাকথিত দায়িত্বের একটা লাইসেন্স। ‘খ’ নামক নায়িকা, ‘ক’ নামক নায়িকার মিডিয়াতে সন্তানের পরিচয়ের দাবি নিয়ে আসার ঘটনা জেনেও, ‘গ’ নামক তারকার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে গেছেন। কিন্তু দিন শেষে তার সঙ্গে একই ঘটনা ঘটে। আর ‘গ’ নামক তারকা, মিডিয়ার কাছে বলেন যে “আমার ইচ্ছা ছিল সময়মতো সুন্দর আয়োজনের মাধ্যমে ঘটা করে বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে, সবার সঙ্গে একসঙ্গে আনন্দ করব। কিন্তু ক এবং খ কেউই আমাকে সেই সুযোগ দেয়নি। আমার অপছন্দের কাজ করে সবার কাছে আমাকে ছোট করার পরও কি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যায়?”
যেখানে দুটি শিশুসন্তান এবং তাদের জীবন জড়িত, সেখানে এই ‘গ’ নামক তারকার সুন্দর আয়োজন করে আনন্দ করার কথা শুনে মনে হয় ওই দুটি শিশু আদতে কোনো বাস্তব চরিত্র নয়, তারা কাল্পনিক। এই ‘ক’ এবং ‘খ’ দুজন নারী আদতে মানুষ নয়, আনন্দ উদযাপনের বস্তু। প্রাচীন যুগে রাজা-বাদশাহ-জমিদার যারা ছিলেন, তাদের জীবনযাপনে এমন অমানবিক অসভ্য চিন্তা ও আচরণ ছিল। বর্তমান সময়ে আমরা যখন কথা বলছি আরও বেশি সভ্য হওয়া নিয়ে, জেন্ডার সমতা নিয়ে, বৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে, তখন দেখি গণমাধ্যমে, নিজের পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে, তারকার দাম্ভিক উক্তি।
এই যে বলছি ‘তারকা’, বড্ড বিবমিষা জাগছে। ছি!
লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী