নানাবিধ সংকটে পড়ে দুই বছর ধরে দেশের অর্থনীতি বেশ চাপে। সংকট কাটাতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও একের পর এক সমস্যা অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগই দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত সপ্তাহে ডলারের দর একদিনে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে এক দিনের ব্যবধানে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরের পুরো ৭ মাসে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের টাকার এই অবমূল্যায়নের কারণে তেল, মসুর ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার ও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় স্বভাবতই বেড়ে গেছে। সিন্ডিকেটের স্বর্গরাজ্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়াকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দেবেন। অর্থাৎ বাড়বে মূল্যস্ফীতি। পাশাপাশি সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, টাকার বিপরীতে ডলারের এই শক্তিশালী অবস্থানে বাংলাদেশের রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও, তা স্বল্পসংখ্যক মানুষের উপকার বয়ে আনবে। তবে টাকার অবমূল্যায়নে অবধারিতভাবে দেশে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়বে, যা কষ্টে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আরও চাপ বাড়াবে। পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝাও বাড়বে। টাকার দাম ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণের পরিমাণ একদিনের মধ্যে ১০৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ কোনো ঋণ না নিয়েও বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৭০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
এতদিন কাগজে-কলমে ১১০ টাকায় প্রতি ডলার বিক্রি হলেও খোলবাজারে তা ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় কেনাবেচা হতো। এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ১ ডলারের বিপরীতে খোলাবাজারে দাম বেড়েছে অন্তত ১২৮-১৩০ টাকায় পৌঁছাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণার পর খোলাবাজারে নগদ ডলারের দর একলাফে ১২৫ টাকায় উঠেছে। তার ওপর আরও বেশি দামেও ডলার পাচ্ছেন না বলে অনেকে বলছেন। ব্যবসায়ীদের পণ্য, বিশেষ করে ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও চিনি-পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য আনতে এলসি খোলার জন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে বেশি খরচ করতে হয়। এখন তা স্বভাবতই আরও বাড়বে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি খরচ ছিল ৬ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে খরচ আরও বাড়বে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, ডলারের শক্তিশালী রূপ যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে চাপে পড়া অর্থনীতির দেশের জন্য ডলারের তেজী ভাব পরিকল্পিতভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে, তা অর্থনীতিকে আরও পতনের দিকে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে কম-বেশি সুদ বাংলাদেশকে শোধ করতে হচ্ছে। সরকারের যেহেতু নিজস্ব কোনো আয় নেই, সেহেতু সুদ পরিশোধের অর্থ সরকারকে দেশের ভেতর থেকে রাজস্ব, কর, শুল্কসহ নানাভাবে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সব দেশে এটাই রীতি। উপরন্তু বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশে। প্রতিবছর বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ তুলা, ডিজেল, স্ক্র্যাপ জাহাজ, ফার্নেস অয়েল, পাম অয়েল, সিমেন্ট ক্লিংকার, গম, অপরিশোধিত তেল, সার, সয়াবিন, হট রোল্ড ইস্পাত, মসুর ডাল, লোহা ও ইস্পাত কাঠামো, ভাঙা পাথর, মটর, শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার পার্টস ও ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম, যানবাহন প্রভৃতি আমাদনি করতে হয়। বিশ্ববাজারের উল্লিখিত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশকে বাড়তি মূল্যে পণ্য কিনতে হয়। ফলে দেশের ভেতরে আমদাকিৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়লে সৃষ্টি হয় মূল্যস্ফীতি। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিদেশি ঋণের সুদ কিংবা পণ্যের মূল্য, যা-ই হোক না কেন বাংলাদেশকে সেসব পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ঋণ দেয়, তখন সুদ নেওয়ার পাশাপাশি ঋণ নেওয়া সরকারের আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও নানা শর্ত জুড়ে দেয়। এসব শর্তের অনেক কিছুই প্রয়োজনীয় হলেও চাপে পড়ে শর্তপূরণ করতে গিয়ে কোণঠাসা সরকারকে তখন আরও বেশি চাপের মুখে পড়তে হয়। কম সুদ হারের কারণে দ্রুত ঋণ নেওয়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এখন এমনটাই হচ্ছে। সদ্য নেওয়া সুদের গ্রেস পিরিয়ড থাকলেও আগের নেওয়া ঋণের অর্থ ও সুদ সরকারকে প্রদান করতে হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিপালন করতে হচ্ছে নানা শর্ত। বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হলেও একদিনের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৭ টাকা কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, ডলারের মূল্য নির্ধারণে তড়িঘড়ি করে আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে ক্রলিং পেগ পদ্ধতির প্রবর্তন করা (মুদ্রা বিনিময়ের এমন পদ্ধতি, যেখানে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে তা একবারেই খুব বেশি বাড়তে বা কমতেও পারে না)। বাংলাদেশে গত বুধবার সকালেও ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ক্রলিং পেগ পদ্ধতির কারণে ১ ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ১১৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
বিশ্বজুড়ে সরকার ও সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিকীকরণ বিশ্বব্যবস্থার কারণে আমদানি ও রপ্তানি লেনদেনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল বিবেচনায় মার্কিন ডলারকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার মার্কিন ডলারের এই আধিপত্য পছন্দ না করলেও অনেকটাই বাধ্য হয়েই ডলারকে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার করে থাকে। অন্যান্য অনেক মুদ্রার সাথে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের পরিবর্তন ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মূল্যকে নাড়া দিতে শুরু করে। এতে করে বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, যার ধকল করোনা ভাইরাসের মতো অভূতপূর্ব বিপর্যয় সামাল দেওয়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তবে সবসময় মুদ্রার দাম পড়ে যাওয়া দুশ্চিন্তার কারণ নাও হতে পারে। কোনো কোনো দেশ অর্থনৈতিক সামগ্রিক লাভের জন্যেও নিজেদের মুদ্রার দাম কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি কারণেও মুদ্রা কর্তৃপক্ষ তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাতে পারে। যেমন তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে রপ্তানি বাড়ানো। কারণ, বিভিন্ন দেশের পণ্যের সাথে অন্য দেশের পণ্যের প্রতিনিয়ত বাজার দখলের লড়াই চলে। আমেরিকার গাড়ি নির্মাতাদের যেমন প্রতিযোগিতা করতে হয় ইউরোপ ও জাপানের সাথে। তেমনি বাংলাদেশের পোশাকেরও প্রতিযোগিতা করতে হয় চীন, ভিয়েতনামসহ আফ্রিকার অনেক উদীয়মান দেশের সঙ্গে। ডলারের বিপরীতে ইউরো বা জাপানি ইয়েনের দরপতন হলে, ইউরোপ বা জাপানে তৈরি গাড়ির দাম ডলারের মাপকাঠিতে কমে যাবে। অধিকন্তু, যে দেশের মুদ্রা বেশি শক্তিশালী, সে দেশের রপ্তানিকৃত জিনিসের দাম অন্য দেশের বাজারে বেশি হয়। যেমন, ডলার অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত পণ্য অবমূল্যায়িত মুদ্রায় কিনতে গেলে, সেটি বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যায়। অর্থাৎ, দুর্বল মুদ্রার দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। আইএমএফের হিসাবে মুদ্রার দর ১০ শতাংশ কমালে রপ্তানির পরিমাণ জিডিপির দেড় শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়, যা রপ্তানিকে শক্তি ও সাহস জোগায় আর নিরুৎসাহিত করে আমদানিকে।
তবে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতাও অবশ্যই অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন বিশ্বব্যাপী কোনো দেশের পণ্যের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সেসবের মূল্যও বাড়তে শুরু করে। তখন অবমূল্যায়নের শুরুর দিকে উপকারটুকু পেতে কষ্ট হয়। এ ছাড়া সমপর্যায়ের অন্যান্য দেশ যখন একটি দেশের মুদ্রার এই কারসাজি প্রভাব অনুভব করতে শুরু করে, তখন তারাও নিজেদের মুদ্রামান নিচে নামাতে চেষ্টা করতে পারে। ফলে মুদ্রাযুদ্ধের আশঙ্কা থাকে। মুদ্রার অবমূল্যায়নের আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা। কারণ মুদ্রার অবমূল্যায়নে রপ্তানি উৎসাহিত হয়, আমদানি নিরুৎসাহিত হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যে ঘাটতি হ্রাস পায়। সবচেয়ে বড় কথা, যখন একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা কম আসে, কিন্তু দেশ থেকে বেশি হারে বিদেশি মুদ্রা অন্য দেশে চলে; তখন মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হয়।
পক্ষান্তরে ডলারের অবমূল্যায়নের ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা রোধে সরকারকে যেকোনো উপায়ে বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে।। নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গকে এখন সুশাসনের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি ততটা বৃদ্ধি পাবে না। সরকারকে এখন অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি রোধে দৃষ্টিগ্রাহ্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আর ব্যাংকগুলো যদি চাহিদামতো ডলারের জোগান দিতে পারে, তাহলে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির খুব বেশি সমস্যা হবে না। রিজার্ভ বাড়ার যে সম্ভাবনা এখন সৃষ্টি হয়েছে, সরকারকে তা খুব পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে নতুন করে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। কারণ বৈদেশিক রিজার্ভের ৫২ শতাংশ যাচ্ছে পুরোনো ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে। ডলারের আরও শক্তি অর্জনের ফলে এসব ঋণের ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। আশা করা যায়, নীতিনির্ধারকেরা খুব সন্তর্পণে ও পরিকল্পিতভাবে বুঝেশুনে পদক্ষেপ নিলে অর্থনীতি খুব বেশি সমস্যায় পড়বে না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি