বাঙালি জাতির সঙ্গে নববর্ষের একটা আত্মিক যোগ আছে। যার ভিত্তিতে এই দিনটিকে ঘিরে বাঙালির প্রাণের হিল্লোল দেখা দেয়। এটি একটি উৎসবমুখর দিনের সূচনাকারী। ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত ভুলে সবাই এক ও অভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। এই দিনটিকে ঘিরে বাংলা বছরের যেমন শুভারম্ভ, তেমনই পেছনের জরাজীর্ণতা মুছে নব উদ্যমে নতুনের পথে যাত্রাও করে বাঙালি। প্রত্যেকেই তার জীবনকে সামনের দিনে আরও একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে যাপনের প্রচেষ্টায় রত হয়।
তবে বর্তমানে উদ্যাপিত নববর্ষ বাঙালি জনগোষ্ঠী একদিনে পায়নি। বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের গোড়াপত্তন হয়েছে বেশ আগে। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, বাংলা সনের প্রবর্তক মুঘল সম্রাট আকবর। সিংহাসন আরোহণের বেশ কিছু পরে তিনি অনুধাবন করেন খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ ঠিক করা বাঞ্ছনীয়। এ লক্ষ্যে তিনি বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তাঁরই আদেশে হিজরি সনের সঙ্গে মিল রেখে বাংলা সন প্রচলন করা হয়। আর বাংলা বারো মাসের নাম গৃহীত হয়েছে নক্ষত্রের নামানুযায়ী। মূলত বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নামক নক্ষত্র থেকে।
মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের নবরত্নের অন্যতম শেখ আবুল ফজল ইবনে মুবারক। তাঁর রচিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘আইন-ই-আকবরি’। এটি ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম প্রামাণিক দলিল। এই গ্রন্থে বিক্রমাদিত্য নামে একজন প্রাচীন ভারতীয় নরপতির নাম পাওয়া যায়। তাঁর সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে তিনি একটি নতুন অব্দ প্রচলন করেছিলেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বের ৪০তম বর্ষে ওই সালটির ১৫১৭তম অব্দ চলছিল। ধারণা করা হয়, এই প্রাচীন সাল অনুসারেই বাংলা সনের উদ্ভব।
প্রকৃতার্থে বাংলা নবর্ষের সূচনা হয়েছিল মুসলমানদের হাত ধরেই। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) শাসনামলে বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সন অনুযায়ী এই দিনটির উদ্ভব। ১৬১০ সালে ঢাকা সর্বপ্রথম বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত হয়। তখন রাজস্ব আদায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য সম্রাট আকবরের অনুকরণেই সুবেদার ইসলাম খান চিশতী তার বাসভবনের সামনে প্রজাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। যার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে মিষ্টি বিতরণ। এভাবেই তখন পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের সূচনা হয়। মূলত বর্তমানে পালিত নববর্ষ তারই আধুনিক রূপায়ণ।
এ প্রসঙ্গে কিছু ভিন্ন মতও পাওয়া যায়। ইতিহাসে দেখা মেলে, আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বাংলা সন প্রবর্তনের ভিত্তি ছিল শক বর্ষপঞ্জি বা শকাব্দ। এই পঞ্জিকা অনুসারে বাংলায় ১২ মাস আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরিতে ফতেহউল্লাহ সিরাজীর বর্ষপঞ্জি সংস্করণের সময় চন্দ্র সনের প্রথম মাস মোহররম ছিল এবং বাংলায় সেটি বৈশাখ মাস। আর তখন থেকেই বৈশাখকে বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা শুরু হয়।
যদিও ইংরেজি ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দ ও হিজরি ৯৬৩ থেকে বাংলা সন চালু হয়। কিন্তু মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়। তবে সে সময় এটি ছিল প্রধানত খাজনা আদায়ের উৎসব। তাই ১৯৬৭ সালের আগে নববর্ষ পালনের রীতি ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনামলে সর্বপ্রথম সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীকালে আইয়ুব খানের রাজত্বকালে নববর্ষ পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে ১৯৬৪ সালে বাঙালির কঠিন তোপের মুখে পড়ে পুনরায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। অধিকন্তু ১৯৬৮ সাল থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও শোষণের প্রতিবাদে ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়, যা জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত।
এদিন বাঙালি জাতি আনন্দঘন সময় পার করে। আগে গ্রামেই বেশি নববর্ষ উদযাপিত হলেও বর্তমানে গ্রামীণ জীবনের ছোঁয়া পেরিয়ে নববর্ষ এখন শহুরে জীবনেও হানা দিয়েছে। সম্প্রতি নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজিত আনন্দ শোভাযাত্রা উদযাপিত হয়। যা পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে প্রতিবছর পালিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির নানা প্রতীকী শিল্পকর্ম তুলে ধরা হয়। রংবেরঙের মুখোশ, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি উপস্থাপনের মাধ্যমে সবাই আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতে সক্ষম হন।
এই শোভাযাত্রায় অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, বর্তমানে প্রায় সব স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা এই বিশেষ দিনটি উদ্যাপন করেন। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয় এদিনটিকে ঘিরে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলো একযোগে ঢাবির মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। তবে এই দিনটির বিশেষ আকর্ষণ পান্তা, ইলিশ। অনেক ব্যবসায়ী পুরোনো দিনের হিসাব- নিকাশ চুকিয়ে নতুন করে হিসেবের খাতা খোলে। এ লক্ষ্যে তারা ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করার মাধ্যমে তাদের বাকি পাওনার টাকা ঘরে তোলে। সর্বোপরি পুরো দিনটিই বাঙালি জাতির জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। গ্রামাঞ্চালে এখনো এই দিনটিকে ঘিরে মেলার আয়োজন করা হয়। শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ সবার জন্যই পহেলা বৈশাখ এক আনন্দময় দিন।
শুধু আনন্দ-অনুষ্ঠান, ক্রেতা- বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্কের হিসেব-নিকেশ চুকানোই মুখ্য নয় বরং এই অনুষ্ঠান বাঙালির সংস্কৃতি-সম্প্রীতির রক্ষক। যান্ত্রিক জীবনে মানুষ ক্রমাগত একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পাশাপাশি থেকেও দুজন ব্যক্তির মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে উঠছে না। সবাই এক অদৃশ্য জালে বন্দি। তবে পয়লা বৈশাখ বাঙালিকে নতুনভাবে এক প্রাণে আবদ্ধ করে। বিগত বছরের দুঃখ-কষ্ট ভুলে নতুনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। আজ ১৪ এপ্রিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! বাঙালি জাতি নব প্রাণের আলোক সঞ্চার করে উদ্বেলিত হোক জীবনের জয়গানে। ব্যথা-বেদনা-হতাশা-গ্লানির পাহাড় ডিঙিয়ে প্রতি মুহূর্তকে রাঙিয়ে তুলুক জয়-পরাজয়ের গল্পে। কারণ, পরাজয়কে স্বীকার করতে না জানলে জয়ের দেখা পাওয়া দুষ্কর। জাগুক প্রাণ নতুন আলোয়, যে আলো ছড়িয়ে যাবে সব মানুষের কল্যাণালোকে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতেই হয়—এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক