বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসে দুইজন সিরাজের কথা জানি। প্রথমজন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। অন্যজন সিরাজুল আলম খান—দাদাভাই হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত। ইতিহাসের নানা বাঁকে তাদের নামটি প্রায়ই উঠে আসে।
ইতিহাসের শেষতম চুম্বন দাদাভাই, ‘বিদায়’ নিলেন তিনি। তবে একে কি বিদায় বলা যাবে? ইতিহাসে ব্যক্তির প্রস্থান ঘটে বিভিন্ন সময়ে, তার নায়ক বা প্রতিনায়কের বিদায় হয় না কখনো। দাদাভাইয়ের মৃত্যুটাকে বিদায় বলা যাবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। তবে বহু সময়ের এক নীরব নক্ষত্রের বিদায় অভিবাদন বলা যেতে পারে। কিছু মানুষ থাকে, সব সময় তারা অভিবাদন। এ মৃত্যু তাঁকে উজ্জ্বল করে তোলে।
দাদাভাই ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্নসংগ্রাম ও স্বাধীনতা-পরবর্তী মেরুকরণের প্রধানতম নিয়ামক। তিনি যেভাবে চেয়েছেন, যা করতে চেয়েছেন, তাই করেননি—করিয়েছেন, ঠিক এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে-তার রাজনৈতিক জীবনে দুটো পর্ব আছে। প্রথম পর্বটি নিয়ে খুব একটা দ্বিমত না থাকলেও একটা আলোর পরত ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে একটা অন্ধকার আছে। যে অন্ধকার কখনো সিরাজুল আলম খানকে উজ্জ্বল করতে পারেনি।
দুই
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দাদাভাইয়ের পরিচিতি ‘রহস্য পুরুষ’ আর তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে বহুল। স্বাধীনতাসংগ্রাম—মুক্তির সংগ্রামে দাদাভাই ছিলেন জীবন্ত সূতিকাগার। এটা অস্বীকার হয়তো করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এটা নানাভাবে পাওয়া যায়। আবার বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে জাসদ গড়ে তোলা এবং সর্বশেষ সেনাবাহিনীতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠনের মতো ইতিহাসের নানা টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেও দাদাভাইয়ের নাম জোরালোভাবে উঠে আসে। জাসদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না রেখেও তিনিই উঠেছিলেন রাজনীতির একজন নেপথ্য নিয়ন্ত্রক, এটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ।
একটা জায়গায় আমার প্রায়ই ধারণা, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসীদের যে ব্যাপক উত্থান হচ্ছিল, তা যাতে বিকশিত হতে না পারে, সে জন্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে জাসদ গঠন করেছিলেন, তার দল তাকে পেছনে রেখে সেই কাজটি করেছিলেন। সমাজতন্ত্র নিজেই একটা বিজ্ঞান। তাকে আলাদা করে ‘বৈজ্ঞানিক’ সম্বোধনটা ছিল তরুণ মনে একটা ‘প্রহেলিকা’ ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে প্রকৃত সমাজতন্ত্রী প্রগতিশীল বাম ধারার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
একটা জায়গায় দাদাভাইয়ের ভূমিকাকে বড় করে দেখা জরুরি। স্বাধীনতা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা মীমাংসার জন্য করেছিলেন, সিরাজুল আলম খান ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার জন্য তিনি তার দলের নেতৃত্বের ওপরে প্রধানত তরুণদের সংগঠিত করে একটি চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি যারা করেছিলেন, তাদের বিপরীতে একটি স্রোত তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন।
তিন
বাংলাদেশের উত্থান হলো একটি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে জেগে ওঠার মহাকাব্য। এর পরতে পরতে রয়েছে বিভিন্ন পরিভ্রমণ, বাঁকবদলের ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু এর পথ নির্মাণে জনমানুষের যূথবদ্ধ প্রয়াসে আছে অনেক কারিগর, অনেক বীর। সিরাজুল আলম খান তেমনই একজন। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তিনি, যিনি শ্রম-ঘাম আর মেধা দিয়ে বাংলাদেশের উত্থানপর্বে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। অনেকে তাকে প্রতিনায়কের আখ্যা দিতে চান, আমার কাছে তার চাইতে মনে হয় ইতিহাসে সমর্পিত নায়ক। যে নায়ক হয়ে উঠেছিলেন তরুণ মনের স্বপ্নকারিগর। তিনি নিজেই বলেছিলেন—শেখ মুজিবের ছয় দফা তার বুকে আগুন লাগিয়েছিল। উনসত্তরে মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, দেখলেন তার জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে, যার ওপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়।
জমি তৈরির এ কাজটা করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই তিনি এটা করেছেন। এখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নন। বরং আস্থাভাজন শিষ্য ও সহযাত্রী ছিলেন। অনেকে হয়তো জানেন, আবার জানলেও সেটা প্রকাশ করতে চান না, শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করার পেছনে দাদাভাই ছিলেন প্রধানতম কুশীলব।
জাসদ গঠনের মধ্য দিয়ে তরুণদের, যাদের অংশটা নেহাত কম ছিল না, তাদের তিনি মোটিভেটেড করতে পেরেছিলেন, স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন, এটা তার সফলতা। হয়তো সেটা ভুল ছিল, ছিল কি না সেটা ইতিহাসের দায়, ইতিহাস নিশ্চয়ই পূর্ণাঙ্গভাবে তার রায় দেবে।
আমি ইতিহাসবিদ নই, ভুল কিংবা ঠিক নির্ণয় করা যথেচ্ছারিত নয়। তবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে একটা বাঁশি বাজিয়েছিলেন তিনি, সেই বাঁশিতে মোহাবিষ্ট হয়ে একদল তরুণ, একটা স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে একটা সময়ে অনেকে হারিয়ে গেছেন। অনেকটা পেছনে চলে গেছে কিংবা কেউ কেউ বিপথগামী হয়েছেন। দাদা ভাইয়ের এ মাধ্যাকর্ষণটাকে অনেকটা ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’র মতো। রাজার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা রাজ্যের সব শিশুকে নিয়ে চলে গেলেন।
দাদাভাইয়ের প্রেক্ষাপটটা তার চাইতে আলাদা করা কঠিন, হয়তোবা সেই গল্পের স্থান—কালের পার্থক্য থাকতে পারে, চরিত্রগত জায়গাটা তো একই। দাদাভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ, তিনি তরুণ একটা প্রজন্মকে ভুল পথে নিয়ে গেছেন। এ অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রে যারা একসময় জাসদ করেছেন, যারা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু-বন্দনা, অন্যদিকে জিয়া-জিকির করছেন, তাদের কাছ থেকে শোনা যায় এটা। দাদাভাই নিশ্চয়ই জোর করে কাউকে ঘর থেকে বের করে আনেননি—স্বপ্নবাজ তরুণরা তার মধ্যে নিজেদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখেছিলেন। সেটাকে দাদাভাই ছড়িয়েছেন।
চার
ইতিহাসের পাঠ নির্মোহ হওয়া জরুরি, কাটাকাটি নয়। কোনো কোনো ইতিহাস তার পূর্বতন ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নকশাল আন্দোলনের কথা আজও নানা আলোচনায় উঠে আসে। নানা গবেষণায় প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু এসব আলোচনা কোনোটাই আজও মীমাংসিত নয়। কোনো গবেষকই তার গবেষণাকে চূড়ান্ত করতে পারেননি।
এখনো চলছে এ আলোচনা চলছে চারু মজুমদার ভুল ছিল, ছিল না; সেই রহস্যভেদ এখনো করা সম্ভব করা যায়নি। বহু দৃষ্টিকোণ থেকে একে দেখা হচ্ছে। তেমনই দাদাভাইয়ের জীবন, তার রাজনৈতিক চিন্তা বা দর্শন অনেকটাই অস্পষ্ট। কোথাও তিনি স্পষ্ট করেননি। তিনি কখনো গণমাধ্যমে সামনে আসেননি, আসতেও চাননি। অনেকটা নীরবে ছিলেন, আড়াল থাকতে চেয়েছেন।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের বইতে সে অর্থে দাদাভাইকে পাওয়া যায়নি। সূত্র পাওয়া গেছে। মহিউদ্দিন আহমদের ‘প্রতিনায়ক’ বইটিতে লেখক অনেক প্রশ্ন ও রহস্য উদঘাটনে চেষ্টা করেছেন। তিনি দাদাভাইয়ের সঙ্গে বারবার কথা বলেছেন, প্রশ্ন করেছেন। সেসব প্রশ্নে কখনো দু-এক বাক্যে অসম্পূর্ণ উত্তর দিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি এড়িয়ে গেছেন। উত্তর দেননি। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি কোনো উত্তর দেব না। তোমরা খুঁজে বের করো।’
তার রহস্য মানবের বীজটা তিনি ধারণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতে অবস্থানকালীনই। তার জীবনযাপন, ঘুমানো বা না ঘুমানো, খাওয়া ও না খেয়ে থাকা শিক্ষাজীবনই তার রহস্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যে রহস্যময় রাজনীতি ও জীবন বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে রহস্য তিনি নিজে থেকে উন্মোচিত করতে চাননি। প্রশ্ন বিষয়ে নীরব থেকেছেন। হয়তো তিনি চেয়েছেন, তাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা হোক।
দাদাভাই ছিলেন অন্তর্মুখী। সাধারণ মানুষকে একটা ধারণা দেওয়া হতো, তিনি প্রচারবিমুখ। শেষ দিকে অবস্থা পাল্টেছে, তিনি তার নিউক্লিয়াস তত্ত্ব প্রচার করেছেন, নিজে লেখেননি কিছু। তবে ডিকটেশন দিয়ে অন্যকে দিয়ে লিখিয়েছেন। ইতোমধ্যে অনেক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে, বেশির ভাগই সেগুলো আধা ফর্মার কিংবা এক ফর্মা। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ‘নিউক্লিয়ার্সে’র বিবরণ। এসব পুস্তিকায় তার বয়ানটি পড়ে মনে হয় এটা শুধু একটি প্রক্রিয়া ছিল না, বাস্তবিক অর্থেই ছিল একটি সংগঠন, যে সংগঠনটি গোপন রাজনৈতিক দলের অংশ।
পাঁচ
গল্পের মানুষ ছিলেন দাদাভাই—গল্প হয়ে উঠেছিলেন মানুষের কাছে। অধিকাংশ মানুষই তাকে কোনো দিন দেখেননি। কিন্তু তার গল্প শুনে শুনে বড় উঠেছেন। সত্য-মিথ্যা মিশেল গল্পে দাদাভাইয়ের প্রতি মোহ তৈরি হয়। তরুণরা সেই মোহে আকৃষ্ট হতেন। সেই গল্পে সেই তরুণরা বেড়ে উঠেছেন তার সঙ্গে।
সিরাজুল আলম খানের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অজানা অধ্যায়গুলো অজানাই থেকে গেল। তিনি বলে গেলে বা লিখে গেলেই সেটা হয়তো দালিলিক শক্তি হিসেবে কার্যকর থাকত। এরপর হয়তো অনেক গল্প থাকবে, মিথ থাকবে, অনেক রকমের ঘটনা আসবে, তার কাছের মানুষ নানা গল্প বলবেন। কিন্তু সেগুলো কেবলই গল্পই থাকবে। ইতিহাসে জায়গা পাবে বলে মনে হয় না। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পেছনে যে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে থেকে যাবেন তিনি। তিনি খুব বড় পরিসরে বা গুরুত্বপূর্ণভাবে সাধারণ মানুষ হিসেবে স্থান করে থাকবেন, তেমনটি হবে না। ‘রহস্য পুরুষ’. ‘দাদাভাই’ রহস্য হিসেবে থাকবেন তার চাইতে বেশি। তার অধিকাংশ বিষয়েই মানুষের জানা থাকবে না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক