আজ আপনি অনায়াসে তাকে বলতে পারেন ‘বার্থডে বয়’। কিন্তু কুড়ি বছর পর আপনাকে লিখতে হতে পারে, ‘আজ স্যার সাকিব আল হাসানের জন্মদিন।’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিশাল বায়ুমণ্ডলে যেসব তথ্যকণিকা যোগ করছেন তিনি, তাতে ঘুরপাক খেতে খেতে যে নির্যাস পাওয়া যায়, তাতে ভবিষ্যতে ‘নাইট’ উপাধি তিনি পেতেই পারেন। পাবেনই সেটা বলা হচ্ছে না। বলা যাচ্ছে না। কেউই সেটা বলতে পারবেন না, এমনকি ক্রিকেট নিয়ে যিনি লেখেন, সেই ক্রিকেট-লিখিয়েও না। এর কারণ, ক্রিকেট-লিখিয়ে আবহাওয়া অফিসের বড় স্যার নন যে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য তার হাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আছে। তিনি জ্যোতিষীও নন যে জন্ম তারিখ, দিন, ক্ষণ অনুযায়ী গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিবেচনা করে কী হতে যাচ্ছে, তা আপনাকে বলে দেবেন। তিনি ম্যাচ ফিক্সারও নন, যে অনেক কিছু তার কথামতো হবে। ক্রিকেট-লিখিয়ে বাইরে থেকে যা দেখেন, পরিসংখ্যানের পাতা উল্টে যা পান, আর অতীতের কিছু উদাহরণ দেখে কিছুটা আভাস দিতে পারেন শুধু। সেই অনুযায়ী বলা, সাকিব আল হাসান ভবিষ্যতে নাইট উপাধি পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি!
খুব জোর দিয়ে বলছি থাকবে। এ দেশে বহু লোক পাবেন, যারা বলবেন: সাকিব কীভাবে এটা পেলেন! ও কী এমন করেছেন যে ওর নামের আগে স্যার বসবে! বরং সাকিব যেসব কাজ করে বিতর্কিত হয়েছেন, সেই ফিরিস্তি তুলে ধরা হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের এত এত সাফল্য, রেকর্ড সব মূল্যহীন করার চেষ্টা হবে। যারা বলতে চান, তাদের জন্য একটা উদাহরণ যথেষ্ট হওয়া উচিত। স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান রিচার্ডস! নীতি-নৈতিকতা নিয়ে যারা বেশি উঁচু স্বর তোলেন, তাদের জন্য ছোট্ট একটা তথ্য দিই। ১৯৮৭ সালে ভারত সফরে এসে বলিউডের এক অভিনেত্রীকে বিয়ে না করেও তার কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছিলেন ভিভ। পরে অবশ্য কন্যার স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করেননি তিনি। তাতে আটকেও থাকেনি ভিভের নাইট উপাধি পাওয়া। আমাদেরও বলতে কোনো জড়তা নেই স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস।
সাকিব আল হাসান বড় ক্রিকেটার। ইস্পাতের মতো কঠিন তার মানসিকতা। কিন্তু তিনি সিংহ হৃদয়ের মানুষ, সে কথা তার পরম হিতৈষীও বলতে পারবেন না। তাতে অবশ্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের অর্জনগুলো কি বিসর্জন দিতে পারবে ক্রিকেট বিশ্ব! আবার জীবনে যদি নাইট উপাধি না-ও পান তাতে তার কিছু এসে যাবে না।
তবে সাকিব আল হাসান যে খেলাটা খেলেন তার নাম ক্রিকেট। এই মজার খেলা যে কাউকে, যেকোনো দিন বেকুব বানাতে পারে। যুগ যুগ ধরে বানিয়েও এসেছে। কিন্তু সাকিব আল হাসান এ দেশের বহু মানুষকে বিনোদন দিয়েছেন। দিচ্ছেন। হয়তো আগামীতে আরও কয়েক বছর দেবেন। অনেক ক্রিকেটপ্রেমী ফ্ল্যাশব্যাকে নিজের সেরা স্মৃতি খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশের এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারকে পাবেন। আবার অনেকে তাকে বলবেন লোভী, রাগী, বদমেজাজি,বেয়াদব ইত্যাদি ইত্যাদি! কোনো পক্ষের যুক্তিকেই অসার মনে হবে না।
সম্প্রতি আরব আমিরাতে এক সোনার দোকান উদ্বোধন করতে গিয়ে সাকিব আল হাসানের সৌজন্যে দেশের মানুষ জানলেন ‘আরাভ খান’ নামের এক তরুণকে। এক পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার নাম জড়িত। এ দেশে স্যার ডাকটা শোনার জন্য যারা ব্যাকুল হয়ে থাকেন, তারা কী করলেন এত দিন! ওই তরুণ কীভাবে দেশ ছাড়লেন! কীভাবে কানাডার পাসপোর্ট পেলেন! কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড পেলেন! কোন জাদু বলে দুবাইয়ে এত বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন! আর সাকিব আল হাসানকেই-বা তারা কীভাবে এই বিতর্কিত ব্যক্তির দোকান উদ্বোধন করতে যাওয়ার অনুমতি দিলেন! নাকি ‘স্যার’, ‘স্যার’ ডাকেই ম্যানেজ হয়ে যায়!
সাকিব অর্থের জন্য ছুটবেন। আরাভ খানের সোনার দোকান উদ্বোধন করবেন। তিনি অর্থ পেয়েছেন। ট্যাক্স দিয়ে দেশে আনলে সেটা বৈধ। কিন্তু নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা যে সাকিব বুঝতে পারেন না, সেই সাকিবকে বলা উচিত ‘সলিড গোল্ড বাট আনপলিশড ডায়মন্ড’। তিনি যে ক্রিকেটে সলিড গোল্ড তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সাকিব যদি নিজের জন্মদিনে তার আগামী দিনের ক্যারিয়ার ও করণীয় নিয়ে নতুন পরিকল্পনা না করেন, তাহলে সেটা হবে দুঃখজনক।
আগামীর পরিকল্পনা এমন হতে হবে, যাতে তার জন্মদিন স্যার সাকিব আল হাসান হিসেবে উদ্যাপন করা যায়। আলোচিত, সমালোচিত যা-ই হোক না, জনমানসকে উদ্দীপ্ত করার আগুন তার মধ্যে আছে। এত নাটক, এত সাসপেন্স, এত চাপের মুখে দুর্ধর্ষভাবে পারফর্ম করা বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারে আছে?
নানামুখী সংকটে এ দেশের মানুষের কাছে স্থির থাকার জলজ্যান্ত উদাহরণ সাকিব আল হাসান। বিপদের মুখে, বিপর্যয়ের মুখে, বিশ্বসমক্ষে তিনি বারবার দেখিয়েছেন বাঙালি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সাকিব অবশ্য এ দেশের ‘এলিট’ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না। সাকিবের ভেতর যেন আগামীতে ‘স্যার’ ডাক শোনার ব্যাকুলতা সঞ্চার না হয়, ওটাই আমজনতার চাওয়া। শুভ জন্মদিন সাকিব!
লেখক: সাংবাদিক