• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রকৃতির ভারসাম্যে রাসেলস ভাইপার


সৈয়দা বদরুন নেসা
প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৪, ১১:৩৩ এএম
প্রকৃতির ভারসাম্যে রাসেলস ভাইপার

রাজধানীতে ঈদুল আজহার ছুটি কাটিয়ে ফিরছি কর্মস্থল বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীতে। ভেতরে ভেতরে কিছুটা কৌতুহল, একইসঙ্গে দুশ্চিন্তাও বোধ করছি। সম্প্রতি যে রাসেলস ভাইপার নিয়ে সারা দেশে আতঙ্ক, সেই চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া সাপের স্থায়ী আবাস মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলে। দশকের পর দশক ধরে সেটাই দেখে আসছি। এমনকি প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০০২ সালে সাপটিকে বিলুপ্তও ঘোষণা করে। অনেক দিন ধরে সাপটি নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।

অথচ সেই ঘটনার প্রায় দুই দশক পর বিলুপ্ত প্রায় রাসেলস ভাইপারের ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে আসাটা সত্যিই বিস্ময়ের। সম্প্রতি দেশজুড়ে হৈচৈ পড়ে গেছে সাপটির ছড়িয়ে পড়া নিয়ে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে দেশের ২৭টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে রাসেলস ভাইপার। যা কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্টদের জন্য ভয়ের বার্তা দিচ্ছে। যদিও বিষধর এই সাপের আক্রমণ শুধু যে প্রান্তিক মানুষের জীবকেই আতঙ্ক আর ঝুঁকিতে ফেলছে তা নয়, কৃষি অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাণ ধারনের উপযোগী উত্তরের সেই শুষ্ক ভূমি ছেড়ে প্রাণীটি কীভাবে, কেন অন্যান্য আর্দ্র, জলমগ্ন অঞ্চলে ছুটছে? বিষয়টি নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তা হওয়ারই কথা। অনেক বিশেষজ্ঞ, প্রাণী ও পরিবেশবিদ ঘটনাটির নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তবে প্রকৃত কারণ বা ব্যাখ্যা নিয়ে কৌতুহল থেকেই যচ্ছে। এটাই সত্য যে, বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের অন্যতম ভয়ঙ্কর বিষধর রাসেলস ভাইপারের বাস্তুচ্যুতির আসল কারণ জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতে আতঙ্কের অবসান বা সমস্যার সমাধান সহজ হবে।

আলোচিত সাপটির বাস্তুচ্যুতির কারণ জানতে সবার আগে প্রাণীজগতের পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, খাদ্যশৃঙ্খল, শস্যাবর্তনের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে। পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুযায়ী, গেল কয়েক দশক ধরে প্রাণীজগতের বাস্তুসংস্থানে অস্থিরতা চলছে। যার পেছনে প্রভাব হিসেবে কাজ করছে প্রকৃতির ওপর মানুষের আগ্রাসন আর জলবায়ু পরিবর্তন।

বরেন্দ্র অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা রাসেলস ভাইপারের পদ্মা তীরবর্তী জেলা বা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে যতগুলো কারণ থাকতে পারে তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্যতম হিসেবে ধরা যায়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শুষ্ক ও উঁচু অঞ্চল সাপটির বসবাসের জন্য কয়েক দশক ধরেই অনুকূল। অথচ সেই উপযোগী পরিবেশ ছেড়ে ভাটি ও নিম্নভূমি অঞ্চলে প্রাণীটির ছড়িয়ে পড়ার পেছনে তাপপ্রবাহ বা উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব থাকতে পারে। যে কারণে অন্য অঞ্চলগুলোতে বিষধর সাপটির আনাগোনা ও বিচরণ ব্যাপকহারে বেড়েছে।

বলা বাহুল্য, গত কয়েক দশক ধরেই মানবসৃষ্ট কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের বদল ঘটে চলেছে। বিশেষত উত্তরাঞ্চলে পদ্মা অববাহিকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাপপ্রবাহ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজার হচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার জন্য শস্যাবর্তনে এসেছে নেতিবাচক পরিবর্তন। উন্মুক্ত বা পরিত্যক্ত জমি চলে আসছে কৃষির আওতায়। যেসব কারণে সাপের প্রাকৃতিক আবাসস্থল দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। টিকে থাকতে বহু ফসলি কৃষিজমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে এসব প্রাণী।

প্রতিকূল তথা বৈরী পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে অবশ্য কিছু প্রাণী অভিযোজন ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে। যাদের মধ্যে অন্যতম রাসেলস ভাইপার। যে কারণে প্রাণীটি নিম্ন ও জলাভূমিতেও নিজেদের খাপ খেয়ে নিতে পারছে। তাছাড়া বহু ফসলি জমি থেকে ফসল কাটার পর অবশিষ্টাংশ বা নাড়া ছোট প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। এতে সাপের খাদ্যের জোগান বেড়ে যায়। আবার অন্যদিকে, কৃষিতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান যেমন কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যাপক ব্যবহারে ছোট ছোট বহু প্রাণী মারাও পড়ে। এতে খাদ্যসংকটে পড়ে সাপ প্রজাতি।

বলা সঙ্গত যে, বদলে যাওয়া বৈরী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে শুধু ছোট প্রাণী বা পোকামাকড়ই বিলুপ্ত হচ্ছে না, সেই সঙ্গে খাদ্যশৃঙ্খলে থাকা মাঝারি প্রাণীরাও মারা পড়ছে। যার মধ্যে রয়েছে সাপ প্রজাতিকে শিকার করা বেজি, বাজপাখির মতো প্রাণীও। এভাবে একদিকে সাপের খাদ্যের জোগান কমে যাওয়া অন্যদিকে শত্রু প্রাণীদের বিলুপ্তিতে খাদ্যশৃঙ্খল বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় অনেক প্রাণীর মতো রাসেলস ভাইপাররাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। খাদ্য আর উপযোগী আবাসস্থলের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠছে বাস্তুচ্যুতি। ফলে তারা অনুকূল পরিবেশের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে, রাসেলস ভাইপার প্রজাতির সাপের প্রজনন ক্ষমতা অত্যন্ত উর্বর। অন্যান্য প্রজাতির সাপের মতো এরা ডিম না দিয়ে সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। একটি মাদি সাপ একবারে ২০-৪০টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করতে পারে। কোনো কোনো সময় এরা ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। এসব বাচ্চা ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে জন্মায়। আর জন্মের পর থেকেই বিষধর। এদের দ্রুত বংশবিস্তার তাদের সংখ্যা বাড়াতে সহায়তা করে। ফলে কৃষক তথা প্রান্তিক মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সাপের কামড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতি বছর যে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায় তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশেও। ‘জার্নাল অব ট্রপিকাল মেডিসিন’ এর ২০১০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬-৮ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে প্রাণ হারায়। গত প্রায় দেড় দশকে এই হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। স্থানীয় গবেষণা ও হাসপাতালের তথ্য তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

তবে অন্যান্য সাপ প্রজাতির মতো রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়াও আমাদের প্রাণ প্রকৃতি আর বাস্তুসংস্থানের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খল সুরক্ষায় সাপের অবদান কম নয়। যেজন্য সাপ সংরক্ষণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিকারি হিসেবে রাসেলস ভাইপার ইঁদুর, ব্যাঙ, পাখি ও অন্যান্য ছোট প্রাণীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

ক্ষতিকারক অনেক প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে সাপ কৃষির জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটা খাদ্যশৃঙ্খলকে সুরক্ষা দেয়। আবার নিজে যেমন শিকার করে তেমনি বড় শিকারি যেমন মঙ্গুজ, বাজপাখি, বেজির মতো প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এভাবে খাদ্য শৃঙ্খলের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অন্যান্য সাপের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে রাসেলস ভাইপার।

শুধু তাই নয়, অন্যান্য বিষধর সাপের মতোই রাসেলস ভাইপার নিয়ে গবেষণা করলে সাপের কামড়ের বিষনাশক বা অ্যান্টিভেনম তৈরিসহ জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। যা সাপের দংশনের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। সেজন্য আতঙ্ক ছড়িয়ে ব্যাপকহারে সাপ নিধন না করে সাপের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণে ‘বিশেষ সংরক্ষণ অঞ্চল’ তৈরি করা দরকার।

মূলত, রাসেলস ভাইপার একদিকে যেমন কৃষক ও কৃষি অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি তেমনি বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য সুরক্ষায় অনিবার্যও। দ্বিমুখী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যা সাপ ও মানুষের মধ্যে সংঘাত কমিয়ে এনে নিরাপদ সহাবস্থানে ভালো ভূমিকা রাখবে। পদক্ষেপগুলো হচ্ছে:

সাপের আবাসস্থল
বন জঙ্গল না কেটে তাদের নিজস্ব জায়গা বা বিশেষ সংরক্ষণ অঞ্চলে’ রাখতে হবে। তাহলে তারা কৃষি জমি বা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়বে না।

সচেতনতা বৃদ্ধি
কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে তারা সাপের সঙ্গে কীভাবে সহাবস্থান করতে পারে ও সাপের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারে তা শিখতে পারে। গ্রামাঞ্চলে সাপ সম্পর্কে সচেতনতা কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে।

প্রাকৃতিক শত্রুদের পুনঃপ্রবর্তন
রাসেলস ভাইপারের প্রাকৃতিক শত্রু যেমন বেজি, বাজপাখি ইত্যাদি পুনঃপ্রবর্তন করা যেতে পারে। এটি সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করে সাপের প্রাকৃতিক শত্রুদের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান তৈরি করতে হবে।

পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ
জমিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক নালা-নর্দমার ব্যবস্থা করে জলাবদ্ধতা রোধ করা গেলে সাপের আবাসস্থল কমে যাবে। রেটুন ফসল না রেখে জমি পতিত রাখা গেলে সাপের জন্য উপযুক্ত আবাসস্থল কমে যাবে।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা
কৃষকরা ফসলের জমিতে কাজ করার সময় গামবুট বা লম্বা বুট ব্যবহার করতে পারেন। এতে সাপের কামড় থেকে পা সুরক্ষিত থাকবে। প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে সাপের কামড়ের চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে যেখানে অ্যান্টিভেনম এবং অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সুবিধা থাকবে।

প্রশিক্ষণ ও প্রতিরোধ
স্থানীয় জনগণকে সাপ ধরার জন্য প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রশিক্ষিত সাপ ধরার দল তৈরি করে সাপ ধরা এবং নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে কী করতে হবে এবং কীভাবে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ
সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। প্রাণিবিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে সাপের জীবনচক্র, আচার-আচরণ, তাদের প্রাকৃতিক শত্রুদের ওপর গবেষণা চালিয়ে সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা।

সম্পর্কিত গবেষণা
প্রাণিবিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে রাসেলস ভাইপারসহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপের জীবনচক্র, আচার-আচরণ এবং প্রাকৃতিক শত্রুদের উপর গবেষণা চালানো জরুরি। এর মাধ্যমে সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা যেতে পারে।

মূলত, শুষ্ক অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা রাসেলস ভাইপারের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ও আক্রমণ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা কৃষকদের জন্য বড় ঝুঁকি। ফলে বাস্তুসংস্থানের বিষয় মাথায় রেখে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

লেখক: কৃষিবিদ ও গবেষক

Link copied!