নব্বই দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমার এক বন্ধু তখন প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভুগছিল। ওই বন্ধুর মা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা ওকে (বন্ধুকে) একটু বোঝাও যেন বাজে কোনো চিন্তা না করে।’ আমি বন্ধুকে একদিন চা খেতে ডাকলাম। ওর সব কথা শোনে ওকে জাস্ট মানসিকভাবে চাঙা করার চেষ্টা করলাম। একটা কথাই বলছিলাম ওকে, হেরে গেলে সবই গেল, কিন্তু সবকিছু পজিটিভ নে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপর বন্ধু ঠিকই চেঞ্জ হয়ে গেল। হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক বলছিলাম আত্মহত্যা নিয়ে উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের কথা। গণমাধ্যমে খবরটি দেখে আরও যারপরনাই হতাশ হলাম। এই প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে এখনও এত আত্মহত্যা— বিষয়টি মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার। এ বছরের (২০২২) প্রথম আট মাসে গড়ে ৪৫ জনের বেশি করে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। প্রেমঘটিত কারণে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার ১৯৪ জনই স্কুল শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৬ জন আত্মহত্যা করেছে কলেজের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৫০টি। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৪ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও আছে। আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি পাওয়া গেছে ১৪-১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে। এই বয়সী ১৬০ জন আত্মহত্যা করেছে। এমনকি ৭ বছরের এক শিশুও আত্মহত্যা করেছে বলে জানানো হয়। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা।
।শুধু কী তাই! আরেকটি শিরোনাম দেখে চমকে উঠলাম। ‘৪৯ দিনে ১১ আত্মহত্যা, কারণ পারিবারিক কলহ ও বিষণ্ণতা’।এটা আবার ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জের ঘটনা। আপনি গুগলে আত্মহত্যা দিয়ে সার্চ দিলে দেখবেন অসংখ্য খবরের লিংক। এবার ভাবুন, আত্মহত্যা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপদের কারণ হয়ে উঠছে।
এই ব্যাধি দূর করতে এখনই সবার পদক্ষেপ নিতে হবে। কী আচরণ করলে সন্তানদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তার প্রসার ঘটবে—এ নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের। আত্মহত্যা করা পাপ—এই শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও শিক্ষার্থীদের মনে মোটিভেটেড করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে, মাথায় বিষয়টি এমনভাবে দিতে হবে যে আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। সমস্যা, সংকট, বিষাদ, দুঃখ এসব থাকবেই। কিন্তু আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। সব বিষণ্ণতাকে দূরে ঠেলে তাকাতে হবে সামনে। একটা দুঃখ আসবে তাতে কি! সেই দুঃখকে কাটিয়ে নতুন করে চলতে হবে। কারণ একটাই জীবন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বন্ধে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিতে না পারলে সেটি আমাদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এর থেকে আমাদের বের হতে শিক্ষার্থী ছাড়াও অভিভাবকদেরও কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন আছে।এসব আত্মহত্যায় পরিবার দায় এড়াতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমানের মতে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্বের কারণে মানসিক সমস্যা বেড়েছে আর এই মানসিক সমস্যায় বেড়েছে আত্মহত্যা। এ ধরনের কেস থেকে বের করতে হবে মানুষ ভালো আছে কি না? মৃত্যুর চিন্তা কেন আসে? আর এজন্য পলিসি ঠিক করা দরকার। এ প্রবণতা দূর করতে মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্র ও পরিবার সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরেকটি বিষয় আলোকপাত করছি তা হলো ছেলেমেয়েদের যথাযথ দেখভাল করতে হবে। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ—এই বিষয়গুলো পরিবার তথা বাবা-মায়ের দেখাশোনা করতে হবে। একজন বাবা কিংবা মা হওয়ার পরে কীভাবে অভিভাবক হয়ে উঠবেন, সেই শিক্ষা নেওয়া জরুরি। আমরা শহুরে জীবনে অনেকটাই একঘরে কাটাই। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আশপাশে যারা থাকে অর্থাৎ যাদের সঙ্গে আপনারা বসবাস করছেন— প্রতিবেশীর সঙ্গে মিশতে হবে। ভার্চুয়াল জীবন থেকে দূরে থেকে পরিবার, স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেশা এখন সময়ের দাবি। পরিশেষে একটা কথা বলবো, আত্মহত্যা প্রতিরোধে এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়াবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক