• ঢাকা
  • বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এনআইডি কার্ডে মুখচ্ছবি থাকা না-থাকা প্রসঙ্গে


তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৩, ০৮:৪৮ এএম
এনআইডি কার্ডে মুখচ্ছবি থাকা না-থাকা প্রসঙ্গে

মহিলা আঞ্জুমান দরবার শরিফ নামের একটি সংগঠন হঠাৎ দাবি করছে, তারা জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) মুখচ্ছবি দেবে না, তাতে নাকি পর্দার লঙ্ঘন হয়। আপাতদৃষ্টে ধর্মের নামে এসব পর্দানশীন নারীদের বক্তব্য যৌক্তিক মনে হতে পারে। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও মূর্খতার সুযোগ নিয়েই তারা এসব অযৌক্তিক বক্তব্য দিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সঙ্গে করল ধর্মের নামে মিথ্যাচার। কথায় কথায় ওরা ধর্মের রেফারেন্স দেয়! অথচ কোরআন শরিফের সুরা আহজাবে (৫৯) নারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, শুধু চাদর দিয়ে মাথা ও বক্ষদেশ ঢেকে রাখার। এর বাড়তি কিছু তো বলা হয়নি। আবার ওরা বলছে, হাদিসে নাকি ছবি তোলা নিষেধ আছে। এটা নাকি সম্পূর্ণ হারাম। জানতে চাই, ক্যামেরা কবে আবিষ্কার হয়েছে আর হজে যেতে হলেও পাসপোর্টে ছবি সংযুক্ত করতে হয় কি না। যদি হজে গেলে ছবি তোলা যায়, তাহলে রাষ্ট্রের স্বার্থে এনআইডির জন্য ছবি তোলা যাবে না কেন? ধর্মের কারণে রাষ্ট্র কি এতই গুরুত্বহীন হয়ে গেল? এটা তো তাহলে রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। 

ওরা আবার বলছে, এখন এনআইডিতে ছবি না দেওয়ার জন্য তারা দাবি তুলেছে, সময় হলে ভবিষ্যতে হজের পাসপোর্টেও যেন ছবি দিতে না হয়, সে জন্যও দাবি তুলবে। রীতিমতো মামাবাড়ির আবদার! তার চেয়ে যে রাষ্ট্রের এনআইডিতে, পাসপোর্টে, ছবি লাগে না, তারা বরং সেই সব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করুক। ব্যাংকের একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে, স্কুল কলেজে ভর্তি হতে, এমনকি শিক্ষার্থীদের অভিভাবক শনাক্ত করতেও তো ছবি প্রয়োজন হয়। আপনি নিশ্চয়ই চান না, অভিভাবক ঠিকমতো শনাক্ত না করতে পারায় আপনার সন্তানকে আরেকজন অপহরণ করে নিয়ে যাক।

এ ছাড়া এ সংগঠন বলেছে, এনআইডির ছবি দিয়েও জালিয়াতি হয়। চেহারা দেখিয়েও তো অপরাধ কমছে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, চেহারা/ছবি শো করিয়েও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। চেহারা না দেখালে এরপর অবস্থা কী হবে? নিশ্চয়ই বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী বইটা পড়েনি ওরা। পুরুষেরাও বোরকা পরে নারী সেজে পরীক্ষার হলে জালিয়াতি করতে যান, মাদক পাচার করে। শুধু চেহারা না দেখানোর সুযোগ থাকায় এসব হয়, হতে পারে।

এ ছাড়া তিনি শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েই সব সমস্যা সমাধান করে ফেলতে চেয়েছেন। সবাইকে তিনি নিজের মতোই অজ্ঞ ভাবছেন।
হঠাৎ করে কোনো বোরকাধারী যখন বোমা ফেলে যাবে, তখন ওই মুহূর্তে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট কে নিতে যাবে? সব সময় ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই করার মতো পরিস্থিতি কি থাকে? তা ছাড়া চেহারা তো লুকায় অপরাধীরা।

বারবার তারা একটা খোঁড়া যুক্তি দেখাচ্ছে, একই চেহারার যমজদের বেলাতে শনাক্তকরণে তো ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েই করা হয়। তাহলে আঞ্জুমান শরিফের এই নারীরা কি বলতে চান, তারা সবাই একই চেহারাবিশিষ্ট?

যে অপরাধ করতে জানে, সে কি ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করেও অপরাধ করতে পারবে না? এখন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নেই বলে কি রাষ্ট্র নাগরিক শনাক্তকরণের পদ্ধতি বদলে প্রাচীন পদ্ধতিতে যাবে নাকি আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করবে?  

একজন ব্যক্তিকে এখন শনাক্তকরণে শুধু ফিঙ্গারপ্রিন্ট যথেষ্ট নয়। এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। মজার ব্যাপারে, আঞ্জুমান শরিফের নারীরা দাবি তুলেছেন, তাদের যেন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতেই শনাক্ত করা হয়। অথচ বায়োমেট্রিক পদ্ধতি সম্পর্কেই তাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। দেখুন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে কী কী দেখে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়।

শারীরবৃত্তীয় (গঠনগত) বৈশিষ্ট্য

১। ফেস (Face)
২। আইরিস এবং রেটিনা (Iris & Retina)
৩। ফিঙ্গারপ্রিন্ট (Finger Print)
৪। হ্যান্ড জিওমেট্রি ( Hand Geometry)
৫। ডিএনএ (DNA)

আচরণগত বৈশিষ্ট্য

১। ভয়েস (Voice)
২। সিগনেচার (Signature)
৩। টাইপিং কিস্ট্রোক (Typing Keystroke)

ধর্মের নাম করে, পোশাক বা ব্যক্তিস্বাধীনতার নাম করে রাষ্ট্রের আইন যদি কেউ লঙ্ঘন করতে চায়, তবে তাদের আইনের মাধ্যমেই বিচার করা উচিত। মোরাল পুলিশিং করে নয়। একটি রাষ্ট্রে সব নাগরিকের জন্য একই নিয়ন ও আইন থাকবে, একইভাবে আইনের প্রয়োগ হওয়া দরকার। কারো এনআইডিতে ছবি থাকবে, আবার কারোটাতে ছবি থাকবে না, তা তো হতে পারে না। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে সংগঠনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ীই আমরা দেখি যে, যেসব সংগঠন নাগরিকের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, সেসব সংগঠন করার কোনো অধিকার থাকবে না। তাহলে এই ভুইফোঁড় সংগঠন এত মামাবাড়ির আবদার করার স্পর্ধা কোথায় পায়?

এই সব পর্দানশীন নারী রাষ্ট্রের নিয়ম লঙ্ঘন করে এনআইডি করছেন না, ভোট দিচ্ছেন না, এর দায় সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজের। রাষ্ট্রের নয়। ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুলে তারা শুধু জল ঘোলা করছেন। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষদের নানা রকম মিথ্যাচার করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। এগুলো কি অপরাধ নয়? রাষ্ট্রের উচিত এদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। 

Link copied!