ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকার উৎখাতে রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তারা দেশে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন। তারা বলেছেন, দেশে আমাদের ভাইদের বুকে গুলি চালানোর জন্য আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের তহবিলে টাকা পাঠাতে পারি না। কেবল তা-ই নয়, বিদেশে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। কোথাও কোথাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাকরির মায়া ত্যাগ করে বিক্ষোভ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেখে দেখে দেশে প্রবাসীদের বাড়িঘরে পুলিশ হানা দিতে আমরা দেখেছি। এই সব উপেক্ষা করে প্রবাসীরা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে অবিচল ছিলেন।
এই সরকার এসে তাদের সেই সংগ্রামের মর্যাদা রেখেছে। আরব আমিরাতে বিক্ষোভের দায়ে যে ৫৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছিল, তাদের ফিরিয়ে এনেছে এই সরকার। বিমানবন্দরে অভিবাসীদের যে হয়রানি করা হয়, সেটা বন্ধ হয়েছে। প্রবাসীদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জ স্থাপন করা হয়েছে।
ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর রেমিট্যান্স-যোদ্ধারা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেছেন, এর মধ্যে তলানিতে নেমে যাওয়া রিজার্ভের ভান্ডার আবার ভরতে শুরু করেছে। তাদের অবদানে ধসে যাওয়া ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অধিক হারে কর্মী পাঠাতে কাজ করে যাচ্ছে। অক্টোবর মাসে কর্মী প্রেরণ এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু এই সেক্টরে পর্বতসমান সমস্যা। এর অন্যতম হচ্ছে আমাদের দেশের মতো উচ্চ অভিবাসন ব্যয় পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। যে কারণে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর পেছনে পড়ে যাচ্ছি আমরা। অন্যদিকে আমাদের প্রবাসী আয় তুলনামূলকভাবে কম। এ কারণে কর্মীদের বিরাট অংশের দারিদ্র্যের বিমোচন হচ্ছে না। এই ব্যয় বৃদ্ধির অনেক কারণ আছে। মোটাদাগে যে ভিসার কোনো দাম থাকার কথা নয়, সেই ভিসা উভয় প্রান্তে হাতবদল হতে হতে যখন একজন কর্মীর হাতে পৌঁছায়, তখন এর দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। এর সঙ্গে বিমানের টিকিট সিন্ডিকেট আছে, আছে আরও অনেক কারণ।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসেসিং টাইম অনেক বেশি। এখানেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
এর পরে আছে দক্ষতার সমস্যা। দুনিয়াব্যাপী দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। দক্ষ হয়ে বিদেশ গেলে আয় যেমন বাড়ে, তেমনি কাজের নিশ্চয়তা থাকে। কর্মীদের দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে আছি, যে কারণে আমাদের কর্মী যাচ্ছে অনেক, রেমিট্যান্স আসছে তুলনামূলক কম।
আমাদের শ্রমবাজার কিছু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। বন্ধ শ্রমবাজার খোলা, চালু শ্রমবাজারের সমস্যা দূর করা, নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করার কোনো উদ্যোগ নেই। এই রকম অনেক সমস্যা আছে।
এই সব সমস্যা দেখার জন্য যে প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের কাজ কী, তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বায়রার কেউ কেউ বিগত সরকারের সময় সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে মিলেমিশে সিন্ডিকেট করে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, এমন তথ্য পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা গেছে।
সরকার চাইলে এ সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। অভিবাসন ব্যয় শূন্যে নিয়ে আসা যায়। শ্রমিকবান্ধব প্রতিযোগিতমূলক জনশক্তি রপ্তানি খাত গড়ে তোলা যায়। নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা যায়। দেশের বিরাট বেকার জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। রেমিট্যান্স দিয়ে আমাদের অর্থনীতির একটা উল্লম্ফন ঘটানো যায়।
কিন্তু এর জন্য দরকার এই সেক্টরের সংস্কার। সরকারের দৃঢ়তা। আমরা জানি, সরকার সংস্কারে আন্তরিক। কেননা, এই সরকার এসেছে বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের মাধ্যমে খাদে ফেলে দেওয়া বিভিন্ন সেক্টরকে টেনে তুলে নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
কিন্তু এই সেক্টরের সংস্কারের কোনো খবর নেই, এর মধ্যে একদল শুরু করেছে নির্বাচন দিতে হবে।
নির্বাচন অবশ্যই দিতে হবে, তার আগে দরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার। সংস্কারের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করার পথ বন্ধ করতে হবে।
জমিজমা বিক্রি করে বিদেশ থেকে খালি হাতে শ্রমিকরা ফিরে আসবেন, এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে হবে।
রেমিট্যান্স-যোদ্ধারা এই সেক্টরের সংস্কারের আওয়াজ তুলুন। এই সরকার আপনাদের সংগ্রামের ফসল। সংস্কারে সরকারকে বাধ্য করুন। ফ্যাসিস্ট সরকারকে ফেলে দেওয়ার গুরু দায়িত্ব আপনারা নিয়েছেন, পুনর্গঠনের জন্যও এগিয়ে আসুন। প্রবাসে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখবেন প্রবাসীরা আর দেশের একদল দুর্বৃত্ত লুটপাট করে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করবে, এই খেলা আর খেলতে দেওয়া হবে না। তবে সেই পুরোনো ব্যবস্থাই যদি চলতে থাকবে, তাহলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথার মানে কী?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট