• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

১৯৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি ও বাঙালি জাতির বেদনা


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৩, ১০:২৪ এএম
১৯৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি ও বাঙালি জাতির বেদনা

২৬ মার্চ দিবসটি আমাদের জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনতার আনন্দ বয়ে আনলেও এর পেছনে অনেক বেদনা লুকিয়ে আছে। বেদনা থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, শৃঙ্খল-দাসত্ব না থাকলে স্বাধীনতার প্রয়োজনই হতো না। বেদনার নানা রূপ আছে; আছে বেদনা প্রশমনেরও নানা উপায়। তবে বেদনা প্রশমনের কোনো উদ্যোগ না দেখাটা আরও অনেক বড় বেদনার। যেমনটা বাঙালিদের ওপর চালানো পাকিস্তানিদের গণহত্যার ক্ষেত্রে দেখা যায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা, ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় লাভের দিন পর্যন্ত সময়কালে অর্থাৎ ৮ হাজার ৮৯১ দিনে আমাদের এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অনেক মর্মান্তিক ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু সেসবের মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সময়টুকুই ছিল সবচেয়ে ভায়াবহ, পৈশাচিক এবং মর্মান্তিক। ২৫ মার্চ রাত ১২টার কিছু পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় শুধু ঢাকা এবং এর আশপাশে অন্তত ৫০ হাজার বেসামরিক বাঙালিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কর্মসূচির মাধ্যমে এবং এর পরবর্তী ৯ মাস ১ লাখ পাকিস্তানি সৈন্য এই ভূখণ্ডজুড়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। প্রাণ বাঁচাতে অন্তত দেড় কোটি বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করার পরে জাতিসংঘ অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার জিওফ্রে ডেভিসের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল পাকিস্তানিদের হাতে ধর্ষণের শিকার বাঙালি নারীদের বিলম্বিত গর্ভপাতের জন্য। পরে জিওফ্রে বলেছিলেন, “আনুমানিক পরিসংখ্যানে ধর্ষণের শিকার হওয়া বাঙালি নারীর সংখ্যা ২ লাখ থেকে ৪ লাখ বলা হয়েছিল, যা সম্ভবত খুব কম ছিল।”

‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে যে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করেছিল, তার মর্মপীড়া আজও আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছরেও ১৯৭১-এ চালানো সেই গণহত্যার বিচার তো দূরের কথা, কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো আমরা পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের শত বাধাবিপত্তি দূরে ঠেলে কয়েক দশক অপেক্ষার পর বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা গেলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনকে এখনো আমরা বিচারের আওতায় আনতে পারিনি। পাকিস্তান এখনো জোর গলায় দাবি করে যে তারা বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা চালায়নি। অথচ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন যুদ্ধ ও সংকটে অসহায়-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর চালানো দমন-পীড়ন ও গণহত্যা যাতে চিরতরে বন্ধ হয়, সে জন্য বাংলাদেশের এই স্বীকৃতি আদায় করা খুবই প্রয়োজন।

ভারতের বেঙ্গালুরু রাজ্যের তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশনের পরিচালক ও সিঙ্গাপুর সরকারের বিশেষ উপদেষ্টা নিতিন পাই ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রাইম স্ট্র্যাটেজি ফোরামে উপস্থাপিত ‘১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তান গণহত্যা: একটি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি সৈন্যদের নিধনযজ্ঞকে গণহত্যার নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে চালানো গবেষণায় তিনি অনেক নতুন ও অকাট্য তথ্য তুলে ধরেন, যাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে পারে। তার গবেষণাসহ বিভিন্ন গবেষণা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যাকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছিল। ২৫ মার্চ শুরু করা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বা আলোর খোঁজে-এর মূল লক্ষ্যই ছিল সম্ভাব্য সর্বোচ্চসংখ্যক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে বাঙালিদের মনে চূড়ান্ত ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া, যাতে করে নিভু নিভু সংযুক্ত পাকিস্তানের আলোক রশ্মিটুকু আবারও দপ্ করে জ্বলে ওঠে। প্রথম পর্যায়ের ওই অভিযান প্রথমে শুরু হয়েছিল শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা এবং বড় বড় শহরে। ভারী কামানের নির্বিচার গোলা এবং যুক্তরাষ্ট্রে থেকে পাওয়া সর্বাধুনিক বন্দুক, স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, মর্টার, আর্টিলারি ট্রাক, সৈন্যবহনকারী সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক নিয়ে চালানো ওই গণহত্যা কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ও মুসলিম ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের (ইপিআর-পুলিশ-সন্দেহভাজন বাঙালি সেনাসদস্য) নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইট এপ্রিল মাসজুড়ে চালু ছিল। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুদ্ধের পদ্ধতিগত ও পরিকল্পিত ছকে চালানো দ্বিতীয় পর্যায়ের গণহত্যার নাম পাকিস্তানিরা দিয়েছিল ‘সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়’ বা খোঁজো এবং নির্মূল করো। দীর্ঘতম এই পর্যায়টিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আরও বেপারোয়া হয়ে উঠেছিল। কারণ, এ সময় বাঙালি বাহিনী একত্র হয়ে ছোট ছোট গ্রুপে পাল্টা লড়াই শুরু করে। তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হত্যাকাণ্ড সম্প্রসারিত করে, যেখানে যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, গানশিপের ব্যাপক ব্যবহার হয়। স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী আঞ্চলিক ভূখণ্ডে উচ্চতর জ্ঞান ব্যবহার করায় গ্রামাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে প্রবল বাধার মুখে পড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী আকাশপথে আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। এতে নির্বিচারে এবং একসঙ্গে বিপুল প্রাণহানি ঘটে। উপরন্তু এটিও সেই পর্যায়, যে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নারীদের ধর্ষণ, অপহরণ ও দাস বানানোর লক্ষ্যবস্তু করেছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিকামী বাঙালি যোদ্ধাদের স্বজনদের সামনে অসহায় মা-বোনদের ধর্ষণ করার যে প্রবণতা এ সময় দেখায়, তাকে যুদ্ধবিষয়ক বিশ্লেষকেরা ‘মানবজাতির চূড়ান্ত বিকৃতি’ বলে অভিহিত করেন। ‘স্ক্রচড আর্থ’ বা ঝলসানো পৃথিবী নামক পাকিস্তানি বাহিনীর তৃতীয় পর্বের গণহত্যা শুরু হয়েছিল ১৫ নভেম্বর থেকে, যা চলেছে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই পর্বের প্রধান কুশীলব ছিলেন পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই সময়েই পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজয় অনেকটা অবধারিত হয়ে উঠছিল। বাংলাপিডিয়ার হিসাব অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশজুড়ে মোট ১ হাজার ১১১ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর বাহিনী, যাদের বেশির ভাগের হত্যার ফরমান নিশ্চিত হয়েছিল নভেম্বর মাসে। স্ক্রচড আর্থ অপারেশনসহ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন শিল্পী ও সাহিত্যিক, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার শিকার হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।

যদিও বাংলাদেশ অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং স্ক্রচর্ড আর্থ নামক পাকিস্তানের পৈশাচিক গণহত্যার কর্মসূচিকে পরাজিত করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫২ বছরে বিশ্বে বাঙালি জাতিকে একটি গর্বিত মানুষের শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের চালানো গণহত্যার কোনো বিচার বা স্বীকৃতি না পাওয়া জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত পরিতাপের ও দুঃখের। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ রক্তস্নাত বাংলাদেশে ফিরে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অশ্রুসিক্ত নয়নে দেওয়া তাঁর ভাষণের সমাপ্তিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে, তার তদন্ত ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।” ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের অপার সম্ভাবনাকে হত্যার পাশাপাশি ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো বাঙালি গণহত্যার বিচার ও স্বীকৃতি প্রাপ্তির দরজাও অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এই দরজা বন্ধে সবচেয়ে বড় প্রভাবকের কাজ করেছে এবং এখনো করছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত ১৯৬৯-১৯৭৪ সময়কালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারই বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি গণহত্যার স্বীকৃতি ও বিচার আদায়ের পথ অনেকটা বন্ধ করে গেছেন। মার্কিন গণমাধ্যম ও আইনপ্রণেতাদের বেশ চাপ থাকলেও নিক্সন সিনেটে সে সময় বাঙালিদের ওপরে চালানো গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়াকে ‘অত্যন্ত জটিল’ বলে মন্তব্য করে বলেছিলেন, “দে আর জাস্ট আ বাঞ্চ অব ব্রাউন গডড্যাম মুসলিম।” অথচ বাংলাদেশে চালানো ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়ে সে সময় মার্কিন পত্রপত্রিকা প্রতিবেদন করেছিল। তখনকার সিনেটর, কংগ্রেসম্যানরা বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফরাসি সাংবাদিক পল ড্রেফাস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “বছরের পর বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা উদ্ধত-অহংকারী অতিথির মতো খারাপ আচরণ করেছে, এই ভূখণ্ডের সেরা খাবার খেয়েছে। আর এখন তারা দেশজুড়ে গণহত্যা চালাচ্ছে। এই সহিংসতার কথা বিশ্ববাসী ভালোভাবেই অবগত।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম হামলাটিকে ‘স্রেফ গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাড এবং ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং উভয়েই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাদের সমর্থন বন্ধ করার আহ্বান জানান। উভয় কূটনীতিককে উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং তাদের এ অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কারণ, তাদের মতে আমেরিকা-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের চলমান উত্তেজনা ছিল বাংলাদেশের গণহত্যার চেয়েও বড়। তারা এই অঞ্চলে পাকিস্তানকে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে মনে করতেন। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছিল এবং পাকিস্তানকে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খোলার গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহার করেছিল। 

১৯৭১ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাড পাকিস্তানিদের হত্যা শুরুর পরপরই, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও প্রাপ্ত তথ্য থেকে তার অভিমত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানিয়েছিলেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা থেকে প্রেরিত টেলেক্স বার্তার শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে অবগত আর্চার কে. ব্লাড হয়তো কিছুটা রক্ষণশীলভাবে ‘সিলেকটিভ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন, তবে ‘জেনোসাইড’ অভিধা তিনি সচেতনভাবেই প্রয়োগ করেছিলেন।

গণহত্যা চালানোর দিনকয়েক আগে ২১ মার্চ ১৯৭১ সকালে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা তৎকালীন পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্টদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানে প্রস্তুত, এমনকি তারা বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতার ব্যবস্থা করে দেবেন। তবে এক শর্তে। শর্তটি হলো: চট্টগ্রাম থেকে ১৫০ মাইল দক্ষিণে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি য্ক্তুরাষ্ট্রের কাছে দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা দিতে হবে। প্রস্তাবটি বঙ্গবন্ধু শোনামাত্র শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, জোসেফ ফারল্যান্ডকে মুখের ওপর বলেছিলেন “মিস্টার ফারল্যান্ড আমি আপনাকে চিনি। ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনায় আপনি সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন, তা-ও আমি জানি। কিন্তু মনে রাখবেন, আমি আমার দেশকে পাকিস্তানি শেয়ালদের হাত থেকে মুক্ত করে আমেরিকার বাঘদের হাতে তুলে দিতে পারি না। আপনাদের এ ধরনের শর্ত আমার কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। হতেও পারে না।”

এই যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চালানো রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার কথা তারা স্বীকার করে না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে শুনানির প্রথম দিনে সে সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের প্রধান তৎকালীন ফার্স্ট মিনিস্টার মিজ অং সান সু চি। আদালতের কৌঁসুলিরা যখন রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সামরিক বাহিনীর চালানো একের পর এক নৃশংসতার ঘটনা তুলে ধরছিলেন, তখন সেখানে পাথরের মতো মুখ করে বসে ছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি। তার পাশেই মাথা নিচু করে বসে ছিলেন মিয়ানমারের অন্য প্রতিনিধিরা। ইতিহাসের কী নির্মম পুনরাভিনয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিধনযজ্ঞের শিকার ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে, বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছে, যাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেছে এবং বিচারও আন্তর্জাতিক আদালতে চলছে। আর বাংলাদেশের বুকে ৩০ লাখ বাঙালিকে গণহারে হত্যার কোনো স্বীকৃতি ৫২ বছর পরও আমরা আদায় করতে পারিনি। এর পেছনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কালো হাত কাজ করছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু আমাদেরও অবহেলা, ঘাটতি ও খামতি রয়েছে। নানা তথ্য-প্রমাণ ও ছবি আমাদের কাছে, যা দিয়ে যুদ্ধপরাধের স্বীকৃতি আদায় করা খুবই সম্ভব। অথচ সম্মিলিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে ১৯৭১-এর যুদ্ধপরাধের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। হিটলারের নেতৃত্বে ইহুদিদের ওপর চালানো জামার্নদের ‘হলোকাস্ট’ গণহত্যার বিচার হয়েছে। জড়িত অপরাধীদের বিশ্বের আনাচে-কানাচে খুঁজে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করা হয়েছে। আর পাকিস্তানের গণহত্যা চালানো ব্যক্তিবর্গকে আমরা আদালতের কাঠগড়া তো দূরের কথা, তাদের অপকর্মের স্বীকৃতি নামক টিকিটিও ছুঁতে পারিনি। এ বড্ড হতাশার বিষয়। যদিও কথায় আছে, ‘চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়ে যায়’ কিংবা ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’। কিন্তু এ কথা তো সত্যি, সভ্য কোনো সমাজে একসঙ্গে নিরস্ত্র লাখো মানুষকে হত্যার ঘটনা, কোনো যুক্তিতেই আড়াল হতে পারে না, অস্বীকৃত থাকতে পারে না। তাই বিশ্বাস করি, বিলম্ব হলেও বাংলাদেশে ১৯৭১ সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করা এখনো সম্ভব। শুধু প্রয়োজন গবেষণা, গণহত্যাসম্পর্কিত প্রকাশনা, কার্যকর কূটনৈতিক ও নাগরিক উদ্যোগ।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি

Link copied!