• ঢাকা
  • রবিবার, ০৯ মার্চ, ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩০, ৭ রমজান ১৪৪৫

ঠেকান মিডিয়া ট্রায়াল, বাঁচান গণমাধ্যম


মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৫, ০৩:১৯ পিএম
ঠেকান মিডিয়া ট্রায়াল, বাঁচান গণমাধ্যম

বেশ কয়েকবছর ধরে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণের মতো অপরাধের সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষতা হারাতে দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার সংবাদ প্রচারের সময় গণমাধ্যমগুলো প্রায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সরাসরি খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজসহ বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করছে। ফলে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহ যাদের অভিযুক্ত  করা হচ্ছে, তদন্ত-সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই গণমাধ্যম তাদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে দিচ্ছে। অথচ কারও বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে তাকে খুনি-ধর্ষক-দুর্নীতিবাজ বলতে নিষেধ করে আইন। এমনকি তাকে অপরাধী বলতেও সায় নেই আইনের। তাহলে কোনো কোনো গণমাধ্যম কেন ঘটনা জানার সঙ্গে-সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে বেশ কিছু অনুষঙ্গের মীমাংসা জরুরি। 
বর্তমান সময়কে প্রতিযোগিতার সময় বললে অত্যুক্তি হবে না। এই প্রতিযোগিতা সমাজের অন্যান্য খাতের মতো গণমাধ্যমকেও গ্রাস করেছে। ফলে অপরিণামদর্শী-নৈতিকজ্ঞান বিবর্জিত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও অতি-উৎসাহী অপেশাদার মনোভাবাপন্ন সংবাদকর্মীদের মধ্যে এই ধরনের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। কে কার আগে কোনো বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য বা সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করতে পারবেন, তার প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত হয়ে পড়েন। অথচ তাদের ধর্ম হওয়া উচিত এর বিপরীত। অর্থাৎ তাদের কর্ম হওয়া উচিত, ঘটনার নেপথ্যে কী আছে, তা নির্মোহ-নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তার মোহে অন্ধ হয়ে পড়ে এই অপেশাদাররা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিবদমান প্রতিপক্ষের সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি, অভিযোগকেই দলিল জ্ঞান করে সেভাবে নিজের প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেই প্রতিবেদন সাব এডিটর বা নিউজ এডিটররা কোনো রকম নিরীক্ষা ও মান যাচাই না করেই প্রিন্ট পত্রিকায় ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এক্ষেত্রে তারা পত্রিকার কাটতি ও পোর্টালের ভিজিটের দিকে যত মনোযোগী থাকেন, নৈতিক অবক্ষয় ও আইনের লঙ্ঘনের দিকে ততটা ভ্রূক্ষেপ করেন না। তাদের এই ‘হামবড়া’ ভাবের জন্য একান্তভাবে তারা দায়ী নন। দায়ী দেশের সিস্টেম। 

একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, বর্তমানে মিডিয়ায় যা কিছু প্রকাশিত-প্রচারিত হয়, সমাজের সিংহভাগ মানুষই তাকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা প্রকাশিত-প্রচারিত সংবাদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন না। এমনকি সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্নও তোলেন না।  এভাবে গণমাধ্যমগুলো আরও আরও ভুলকে শুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করার পাশাপাশি মিডিয়া ট্রায়ালের মতো গর্হিত কাজকে বৈধতা দিতে শুরু করে। ফলে গণমাধ্যমকে যাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, আদালত তাকে নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস দিলে জনমনে বিরূপ ধারণা জন্মে। তারা ভাবেন, আদালত ভুল রায় দিয়েছেন, পক্ষপাত করেছেন। তারা গণমাধ্যমের ভুল দেখতে পান না।  আর জনগণের মধ্যে এই ধরনের ধারণা সঞ্চারের কাজটি করে দেয় গণমাধ্যমই। গণমাধ্যমগুলো শিরোনাম দেওয়ার ক্ষেত্রে এই মিডিয়া ট্রায়ালের কাজটি সবচেয়ে বেশি করে। মিডিয়া ট্রায়ালে পর্যবসিত হওয়া বেশকয়েকটি শিরোনাম এমন,  ‘‘স্বামীকে হত্যা করে লাশের পেটে স্ত্রী লিখে দিলেন ‘সরি জান আই লাভ ইউ’’; ‘কিশোর গ্যাংয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুবক খুন’; ‘রাজধানীতে ছেলের হাতে মা খুন’, ‘র্যাবের-সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ডাকাত-নিহত’। আপত এই কটি শিরোনাম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলো। এই শিরোনামগুলো প্রমাণ করে, স্ত্রীই তার স্বামীকে হত্যা করেছেন, যুবককে হত্যা করেছে কিশোর গ্যাং, মাকে তার ছেলেই হত্যা করেছে এবং র্যাবের সঙ্গে কারও বন্দুক যুদ্ধই হয়েছে,  আর সেই বন্দুকযুদ্ধে যে নিহত হয়েছে, সে ডাকাত। গণমাধ্যমগুলো যদি এভাবে সিদ্ধান্তই দিয়ে দেয়, তাহলে এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ গৌণই হয়ে যায়। আদালতে প্রসিকিউশনকে আর কষ্ট করে সাক্ষী হাজির করতে হয় না, তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও আর তদন্ত করতে হয় না। ময়নাতদন্ত করে রিপোর্ট দিতে হয় না চিকিৎসককে। এছাড়া প্রসিকিউশনকেও আর আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হয় না। বাস্তবে কি গণমাধ্যমের দেওয়ার শিরোনামই শেষ কথা? একথা সচেতন নাগরিক মাত্রই স্বীকার করবেন, গণমাধ্যম যে শিরোনাম দেয়, সেগুলো  হয় অজ্ঞতাজনিত, নয়তো পক্ষপাতদুষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিরোনাম। তাহলে এখন প্রশ্ন উঠছে, গণমাধ্যম কেন এমন বেআইনি-অনৈতিক কাজ করে?  এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের মান ও সম্পাদনার মান পরীক্ষা করে বেশ কিছু ধারণা পাওয়া গেছে। এগুলো হলো:    

১. সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতা-বিষয়ক ধারণার অভাব
২. সংবাদকর্মীর নৈতিক জ্ঞানের অভাব
৩. সংবাদকর্মীর আইনি পরিভাষা না জানা  
৪. অল্প বয়সে স্বল্পবেতনে নিয়োগ পাওয়া, প্রশিক্ষণহীনতা
৫. বার্তা কক্ষে সিনিয়র-জুনিয়রের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয় ও পরিভাষা সংক্রান্ত জ্ঞান-ধারণার আদান-প্রদানের অভাব
৬. কপি পেস্টপ্রবণতা।

সংবাদকর্মীকে মনে রাখতে হয়, ‘তথ্য’ সংবাদের প্রাণ হলেও ‘তথ্যমাত্রই’ সংবাদ নয়। তথ্যকে সংবাদ হয়ে ওঠার জন্য আরও কিছু অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয়। সংবাদকর্মীকে তথ্য যেমন সংগ্রহ করতে হয়, তেমনি তার বিন্যাসও করতে হয়। একইসঙ্গে তথ্যকে নির্বাচন করার পাশাপাশি যাচাই-বাছাই করতে হয়। এসব প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই তথ্যকে করে তুলতে হয় ‘বস্তুনিষ্ঠ’। অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ তথ্যই হলো সংবাদের প্রধান অনুষঙ্গ। ওই তথ্যকে সংবাদ করে তোলার জন্য সংবাদকর্মীকে তার নৈতিকজ্ঞান, আইনিজ্ঞান ও ঘটনাসম্পর্কিত পরিভাষার যথাযথ প্রয়োগ করতে জানতে হয়। তবেই তথ্য-বক্তব্য-ঘটনার বিন্যাস সংবাদে উন্নীত হতে পারে। সুতরাং তথ্য পাওয়া মাত্রই তা পত্রস্থ করা সংবাদকর্মীর ধর্ম হতে পারে না। এই সব শর্তের অপপ্রয়োগ ও শৈথল্যই ব্যক্তিকে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার করে। এর জন্য প্রথম দায় সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতা-বিষয়ক বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও পরিভাষার সংক্রান্ত ধারণার অভাব। 

এরপর রয়েছে সংবাদ-সংক্রান্ত নৈতিক জ্ঞান ও আইনি পরিভাষাবিষয়ক জ্ঞানের অভাব। বর্তমানে এই পেশায় স্বল্পবেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রাথমিকভাবে উভয়পক্ষ লাভবান হচ্ছে। যে শিক্ষার্থী তার ছাত্রজীবনে টিউশনি করে মাসে ৫ হাজার টাকা উপার্জন করতে বেগ পেতেন, সেই  তিনিই গণমাধ্যমে খণ্ডকালীন কাজ করে পাচ্ছেন ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এতে উভয়পক্ষই সন্তুষ্ট। একপক্ষের অর্থ সাশ্রয়, অন্যপক্ষের যোগ্যতার চেয়ে বেশি আয়। মাঝখানে সাংবাদিকতার শ্রাদ্ধ। 

আপাত সবশেষে রয়েছে, এই অল্পবয়সী স্বল্পবেতনে নিয়োগ পাওয়া সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা। ফলে বার্তাকক্ষে তারা কোনো একটি বিষয়ে সিনিয়র ও অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেন না। বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে যেভাবে  যে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তারাও হুবহু সেভাবে নিজ নিজে নিউজ পোর্টালে সেভাবে নিউজ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। প্রিন্ট পত্রিকায় কখনো কখনো হয়তো এর ব্যত্যয় ঘটে। এভাবেই না জেনে কিংবা সামান্য জেনেই সংবাদ লেখা ও সম্পাদনায় বসে যাওয়ায় এমন সংকট তৈরি হচ্ছে। এই ধরনের সংবাদ প্রকাশের কারণে সমাজে ভুক্তভোগীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের  সংকট সৃষ্টি আশঙ্কা তৈরি হয়। মোটা দাগে ক্ষতিগুলো হলো:  
১. অপরাধ প্রমাণের আগেই অপরাধী আখ্যা  
২. সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া
৩. শারীরিক-আর্থিক-সামাজিকভাবে ক্ষতির শিকার হওয়া
৪. বিচারকাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়া

আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে কেউ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে মিডিয়ায় যখন তাকে খুনি-ছিনতাইকারী-ধর্ষক-প্রতারক বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখন জনমনে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সমাজের একাংশ অপরাধী হিসেবেই গণ্য করে। ফলে তিনি সমাজে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। কেবল বিদ্রূপ মন্তব্য-কটাক্ষেরই শিকার হন না, কখনো কখনো শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হন। সর্বোপরি প্রকাশিত সংবাদকে তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করে বাদীপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতকে ভুলও বুঝিয়ে থাকে। এতে  বিচারকাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকট আকার ধারণ করে।

সাক্ষ্য-প্রমাণের আগে বিনা বিচারে যখন কেউ ‘অপরাধী’ হিসেবে সমাজের কাছে ধিকৃত হতে থাকেন, তখন তিনি  অপমান-অসম্মানে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন। কারণ তখন তার মনে হতে পারে, এই সমাজে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ন্যায়বিচারের আশা ক্ষীণ, সম্মানহানিও হচ্ছে, সেহেতু বেঁচে থাকাটাই তার কাছে অনর্থক মনে হতে পারে।  তবে, ভুক্তভোগী যদি আত্মহত্যার পথ বেছে না-ও নেন, সমাজের অতি-উৎসাহীরা তাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন। এমনকি গণপিটুনিতে তিনি নিহতও হতে পারেন। উল্লিখিত দুটি ঘটনা না ঘটলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মতো গুরুতর ঘটনা যে ঘটবে না, তার নিশ্চয় কে দিতে পারে? 

সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে, আদালতের রায়ের আগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধের স্বার্থে মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।  মিডিয়া ট্রায়ালের মতো অনিয়ম যদি সমাজে নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে জাতির সামনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। রিপোর্টারের চেয়ে ফেক ইনফর্মার, সংবাদের চেয়ে গুজব, গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দৌরাত্ম্য বাড়বে। তখন গণমাধ্যম গুরুত্বহীন পড়বে। কেউ কাউকে সম্মান করবে না, বিশ্বাস করবে না। এতে ধীরে ধীরে গণমাধ্যমের সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে যাবে। অতএব গণমাধ্যমকে এই ধরনের আশু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হলে অনতিবিলম্বে মিডিয়া ট্রায়ালের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ করার জন্য সুশিক্ষিত-রুচিশীল প্রশিক্ষিত সংবাদকর্মীর ওপর ভরসা রাখতে হবে। বার্তাকক্ষকে স্বল্পবেতনের অল্পবয়সী অদূরদর্শী অ-প্রশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের দৌরাত্ম্যমুক্ত করতে হবে। এই কাজগুলো করার সময় এখনই। আগেই বলেছি, দেরি হলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আর আস্থা থাকবে না। তাই  মনে রাখতে হবে লালনের এই কথাটি, ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’   

লেখক: কবি-গবেষক-সাংবাদিক

Link copied!