বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতার লক্ষণ দেশের অর্থনীতি ও উন্নতির সম্ভাবনাকে আবারও গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে জীবন দুর্বিষহ হওয়ার আশঙ্কা-আতঙ্ক ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছে। তীব্র মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ-সংকট ও বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতার এই আশঙ্কা সবার মনে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে, তা বিবেকবান কোনো মানুষের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা দখল করার প্রতিযোগিতায় সৃষ্ট এই রাজনৈতিক অস্থিরতা বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে যে আরও বড় ধরনের ক্ষতি ও দুর্ভোগ-দুর্দশা বয়ে আনবে, সে কথা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বড় হয়ে ওঠা আজকালকার শিশুরাও বুঝতে পারছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষের এই যুগে এসে নিষ্পাপ শিশুসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মনে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে ক্ষমতার জন্য মরণপণ লড়াইয়ের ভীতি সঞ্চারিত হওয়া আমাদের কারও কাছেই কাম্য নয়।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংঘাত ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ জীবনের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, এতে করে তাদের অর্থনৈতিক জীবনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে বেশ কয়েকবার এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, যেসব বছরগুলোয় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা ছিল, সেসব বছরে দেশের অর্থনীতি সব পরিসংখ্যানেই খারাপ প্রবণতা দেখিয়েছে। আবার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বছরগুলোয় আর্থিক অবস্থা ছিল ভালোর ঘরে। সাধারণত একটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা বাড়া বা কমার মধ্য দিয়েই সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়টি বোঝা যায়, যা পরিমাপ করা হয় জাতীয় আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা এখন মোটেও ভালো নেই। জুলাইয়ের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে প্রকাশ করা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৩৫৬ কোটি বা ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ৩ মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে। অন্যদিকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও চাল-আটার মূল্যও আবার বাড়তির দিকে। এমন অবস্থায় দেশে নির্বাচনকে ঘিরে সরকার ও বিরোধীদের মারমুখী আন্দোলনের প্রকাশ দেশের অর্থনীতির জন্য নিশ্চিতভাবেই অশনি সংকেত বয়ে আনছে।
গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে জানায়, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ১ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থাও একই ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, বেশির ভাগ দেশে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, যা পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় কম, ফলে আগামী মাসগুলোতে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় প্রভাব পড়তে পারে। এ ছাড়া বেশির ভাগ বড় অর্থনীতির দেশে খাদ্যের দাম ঐতিহাসিকভাবে এখন বেশি এবং আবহাওয়ার এল নিনোর প্রভাবে বেশ কিছু দেশে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপে ৮৫ শতাংশের বেশি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, উন্নত বিশ্বের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক, দেশীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও প্রযুক্তির কারণে আগামী ছয় মাস-এক বছর অস্থিরতায় দিন কাটাবে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ নয়, দেশের অভ্যন্তরে ধর্মঘট ও দাঙ্গাসহ সহিংসতার কারণে আগামী এক বছর সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক কর্মকাণ্ড চাপের মধ্যে থাকবে। এ সময় বিশ্বের অনেক দেশে সাধারণ নির্বাচন ও শাসনক্ষমতার পটপরিবর্তন হতে পারে। যেহেতু মুক্তবাজার ও তথাকথিত উদারনৈতক বাজারব্যবস্থায় বিশ্বের সব দেশই এখন একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত, সেহেতু এক দেশের সমস্যা অন্য দেশের অর্থনীতিকেও সমস্যার আবর্তে ফেলে দিতে পারে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দেশের আর্থিক হিসাবে কয়েক বছর পর প্রথমবারের মতো ঘাটতির কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, “আমাদের মূল কাজ এখন এটিকে উদ্বৃত্ত করা। এ জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়ে গেলে আমাদের রিজার্ভও বাড়তে থাকবে।” গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল। তবে প্রথম চার মাসে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা সংশয়ে ছিলেন। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিনিয়োগ ও অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল। এ রকমই এক অবস্থায় সম্প্রতি ঋণমান যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে দুটি বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্প্রতি নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান সরাসরিই বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। আরেকটি ঋণমানের পূর্বাভাস নেতিবাচকে নামিয়ে বার্তা দিয়ে বলেছে, বহিঃস্থ পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে বাংলাদেশের ঋণমান কমানো হতে পারে। বিশ্বের অন্যতম ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর গ্লোবাল (এসঅ্যান্ডপি) জানিয়েছে, বাংলাদেশবিষয়ক ঋণমান আভাস বা রেটিং পূর্বাভাস কমিয়ে ‘নেতিবাচক’ করা হয়েছে। আগে এই পূর্বাভাস ছিল ‘স্থিতিশীল’। এর আগে মে মাসের শেষে মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ ৩ থেকে বি ১-এ নামানোর ঘোষণা দিয়েছিল। ঋণমান কমে যাওয়ার কারণে এখন বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করার খরচও বেড়ে যাবে।
অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলে কোন কোন খাত গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে চলে পর্যালোচনা। নীতিকাঠামোর ধারাবাহিকতা থাকা নিয়েও দেখা দেয় একধরনের অনিশ্চয়তা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের জন্য ধীরগতিতে চলার নীতি অনুসরণ করে থাকেন উদ্যোক্তারা। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনেও ‘তহবিল’ জোগানোর রীতিও আমাদের দেশে বিদ্যমান। এ সময় অনেক উদ্যোক্তার ব্যয় বাড়ে, তবে তা উৎপাদনশীল খাতে নয়, অনুৎপাদনশীল খাতে। সে কারণে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধারা থমকে যায়। সম্প্রতি দেশে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে ঋণ বাজারে। ব্যাংকঋণে সুদের হার বৃদ্ধি বেসরকারি বিনিয়োগকে চাপে ফেলেছে। অসুস্থ সংস্কৃতির জেরে ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপির সংখ্যাও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বাড়ছে। আমদানি খরচ বৃদ্ধি আর ডলারের বিপরীতে টাকার দাম এমনিতেই ক্রমশই কমছে। তার ওপর শিল্পের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা চলছে। সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবেই আমাদের অর্থনীতি এখন ভীষণ চাপে রয়েছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে, নির্বাচনী বছরের অর্থনীতির ওপর নানাবিধ চাপ, যার স্পষ্ট প্রতিফলন পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতির বিভিন্ন অঙ্গনে। অনেক উদ্যোক্তাই এখন নির্বাচন ও রাজনৈতিক অবস্থা দেখে তারপর ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছেন। দেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজেও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ চলছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এসব প্রকল্পের সময়মতো বাস্তবায়নকেও অনিশ্চয়তায় ফেলেছে।
গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবে ঘাটতির সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেখা গেছে, যেসব বছরে আমাদের দেশে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল, সেসব বছরের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অর্থবছরের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। ২০০১ সালের নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির চিত্রও অনেকটা এমনই। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরম আকার নিয়েছিল। ওই অর্থবছরে বিনিয়োগ খাতে মন্দার প্রভাবে দেশের আর্থিক হিসাবেও ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটেও ঘাটতি ছিল। ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, দুই নেত্রীকে কারাবন্দীকরণ ও জাতীয় নির্বাচন এসব ইস্যুতে বড় একধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে দেশ। এ সময় আর্থিক হিসাবে ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটেও ঘাটতি ছিল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বিডিআর বিদ্রোহ এবং দেশের শেয়ারবাজারে ধসের মতো বিষয়গুলো সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতার জের পরিবহন খাতে যে বিনাশী-দশা সৃষ্টি করেছিল, তার তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি এখনো সাধারণ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অসংখ্য বাস, মিনিবাস, লেগুনা, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ সব রকম যানবাহনে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে এনেছিল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় কেবল পরিবহন সেক্টরেই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে সময় ১০ হাজারের বেশি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ৫ হাজার বাস, ভাঙচুর হয়েছে ৫ হাজারের মতো যাত্রীবাহী গাড়ি। পেট্রলবোমা মেরে, গান পাউডারের আগুন দিয়ে এমনকি নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৫৬ যানবাহন চালককে। ওই সময়ে দুই দফায় ৫০ দিনের বেশি সময় ধরে পরিবহন সেক্টরে চলা অরাজকতায় যানবাহন ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির অর্থমূল্য নির্ধারণ করা কোনো গাণিতিক হিসেবেই সম্ভব নয়। জ্বালাও-পোড়াওয়ের বলি হওয়া অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নিঃস্ব হয়ে পরে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও পরিবহন খাতসহ অর্থনীতির অন্য খাতগুলোও গভীর শঙ্কায় পড়েছিল। চলতি ২০২৩ সালের নির্ধারিত আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধ আবারও চরম পর্যায়ে উঠেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে শোডাউন, সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা শুরু হয়েছে। পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক-উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। সবার মনেই একধরনের ভীতি সঞ্চারিত হচ্ছে। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনী ইস্যুতে বিদেশি কূটনীতিকদের অপতৎপরতা। গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি-মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের মতো ইস্যুগুলোর সঙ্গে নতুন যোগ হওয়া ইস্যুগুলো সঙ্গত কারণেই সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশের অর্থনীতির গভীর সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার বর্তমান আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে, যারা ‘দিনে এনে দিনে খায়’ পরিস্থিতি নিয়ে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার ছায়া বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে গভীর অনিশ্চয়তার পাশাপাশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বড় ধরনের আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। এমনিতে যেকোনো বিপর্যয় মোকাবিলা করে আমাদের দেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা সুবিদিত। তবে বর্তমান সময়ে চারদিক থেকে ক্রমশই ঘিরে ধরা সংকট সবাইকে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত করাই স্বাভাবিক। এই অবস্থা নিত্যদিনের সব কষ্ট নীরবে সহ্য করে যাওয়া দেশের আপামর মানুষের কাছে কখনোই কাম্য নয়। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের ধারা অব্যাহত রেখে দেশের মানুষের কষ্ট লাঘবের পরিবর্তে আমাদের রাজনীতিকেরা যদি আপামর মানুষের জীবনে আরও বড় ধরনের সমস্যা বয়ে আনেন, তাহলে অনাগত প্রজন্ম নিশ্চিতভাবেই তাদের ক্ষমা করবে না, সে কথা উপলব্ধি করা আমাদের রাজনীতির চালকদের জন্য এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি