• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নূর হোসেন দিবস ও গণতন্ত্রের মুক্তি


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২২, ০১:৫৮ পিএম
নূর হোসেন দিবস ও গণতন্ত্রের মুক্তি

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন তখনকার সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ। তারপর টানা নয় বছর জোর করে ক্ষমতায় ছিলেন এরশাদ। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগের আগপর্যন্ত বাংলাদেশে কায়েম করেছিলেন স্বৈরতন্ত্র এবং কেড়ে নিয়েছিলেন গণতন্ত্র। তবে নয় বছরের শাসনামলের বেশির ভাগই তাকে রাজপথের আন্দোলন সামাল দিতে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আর এরশাদ আন্দোলন দমন করতেন নিষ্ঠুর কায়দায়, গুলি করে, মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটি হয়েছিল ‍‍’৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। আর চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদকে হত্যার পর। 

শহীদ জেহাদের লাশ সামনে রেখে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২৭ নভেম্বর এরশাদের ভাড়াটে খুনিরা ডা. মিলনকে হত্যা করলে গোটা দেশ অচল হয়ে যায়। ডা. মিলনের মৃত্যু মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয় এরশাদেরও। তবে একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আমার বিবেচনায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিন ছিল ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে রাজপথে নামা নূর হোসেনের আত্মদান লাখো মানুষকে সাহসী করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। আমি তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। পড়াশোনার চেয়ে আন্দোলনে বেশি সময় দিই। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দিতে আমারও ঢাকা আসার কথা ছিল। জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আসতে পারিনি। তবে সহযোদ্ধাদের বিদায় দিতে আগের রাতে কুমিল্লা রেলস্টেশনে গিয়েছিলাম। 

সেদিন ঢাকা আসাটাও এক যুদ্ধ ছিল। পুরো স্টেশন ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। অবস্থা দেখে আমরা সবাই স্টেশনের আগে-পিছে রেললাইনের পাশে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলাম। যখনই ট্রেন ছাড়ার হুইসেল বাজে, তখনই সবাই অসহায় পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে। তাদের নিরাপদে বিদায় করে ফিরি ‘টমছম’ ব্রিজের নিউ হোস্টেলে। পরদিন আমরা কুমিল্লায় কর্মসূচি পালন করেছি। আর ঢাকার খবর রেখেছি। অনেক পরে জানলাম নূর হোসেনের কথা। বুকে ‍‍‘স্বৈরাচার নীপাত যাক‍‍’,  পিঠে ‍‍‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক‍‍’ লিখে জীবন্ত পোস্টার হয়ে, পুলিশের সহজ টার্গেট হয়ে মাঠে নেমেছিলেন যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। গাড়িতে যেতে যেতে জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেনকে তার চোখে পড়ে। পরে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “মনে পড়ে আমি তাকে বলেছিলাম, জামাটা গায়ে দাও, একি সর্বনাশ করছো, ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে।” নূর হোসেন মাথাটা এগিয়ে দিল আমার কাছে। বলল, “জান দিয়া দিমু আপা, আপনে শুধু মাথায় হাত বুলাইয়্যা দেন।” শেখ হাসিনা লিখেছেন, “আমার হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ নূর হোসেন গাড়ির পাশে হাঁটল। তারপর কখন যেন জনতার স্রোতে হারিয়ে গেল।”

শেখ হাসিনার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। পুলিশের গুলির সহজতম টার্গেট হন নূর হোসেন। তার মৃত্যু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভিন্নমাত্রা আনে। দেশজুড়ে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল নূর হোসেনের মৃত্যু। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন—

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে
রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,
বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ
শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা
নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়
ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ
বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার
বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।‍‍

৮৭-তে না হলেও নূর হোসেনদের দেখানো পথ ধরে ১৯৯০ সালে নিপাত যায় স্বৈরাচার, মুক্তি পায় গণতন্ত্র। কিন্তু ৩৫ বছর পরে এসে আজ নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন, সত্যিই কি মুক্তি পেয়েছে গণতন্ত্র? সেদিন রাজপথে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা দল আজ ক্ষমতায়। কিন্তু এখনো গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা, ভোটাধিকারের জন্য আক্ষেপ, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে অনাস্থা, নির্বাচন নিয়ে সংশয় আমাদের বেদনার্ত করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলনে পতন ঘটেছিল প্রবল স্বৈরাচার এরশাদের। আমরা ভেবেছিলাম গণতন্ত্র পেয়ে গেছি, আমাদের আর ভাবনা নেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুই প্রধান দলের মধ্যে অবিশ্বাস, অনাস্থা ক্রমশ বাড়তে থাকে। দুই দলের অবস্থান এখন দুই মেরুতে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে বিএনপি সেই দূরত্বকে অলঙ্ঘনীয় করে ফেলেছে। দুই প্রধান দলের অবিশ্বাস-অনাস্থার ফাঁক গলে গণতন্ত্রের লেবাস ধরে স্বৈরাচার মিশে গিয়েছিলেন রাজনীতির মূলধারায়। 

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর কেউ কি ভেবেছিলেন এরশাদ এমপি হবেন, রাজনীতি করবেন, মন্ত্রীর পদমর্যাদা পাবেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হবেন? পতনের পরের পাঁচ বছরই এরশাদ কারাগারে ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে সময় নেননি। বিএনপির সঙ্গে মিলে চারদলীয় জোট করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। এভাবে শোচনীয় পতনের বছর সাতেকের মধ্যে এরশাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেকে জায়েজ করে নিয়েছেন। মৃত্যুর আগে এরশাদ ছিলেন সরকারের অংশ। তার দল জাতীয় পার্টি আজ সংসদে ‘স্বপক্ষীয়’ বিরোধী দল। আশির দশকে আন্দোলনটা স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে ছিল বটে, তবে এখন আর আমি এরশাদ বা জাতীয় পার্টিকে অত দোষ দিই না। এরশাদ একজন ব্যক্তি মাত্র। পতনের পর নানান কিছু করেছেন বটে, তবে পতিত স্বৈরাচার এরশাদ শেষের দিকে লোকই হাসিয়েছেন শুধু। 

আমার দুঃখ এত রক্ত, এত সংগ্রাম করেও আমরা পূর্ণ গণতন্ত্রের স্বাদ পাইনি। নূর হোসেন জীবন দিয়েছে ৩৫ বছর আগে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। নূর হোসেনের বুকে-পিঠের দুটি স্লোগানই ভুল বানানে লেখা ছিল। আমরা কী তাহলে ভুল আন্দোলনে অপচয় করেছি আমাদের উজ্জ্বল যৌবন? যতবার প্রশ্ন করি, ততবারই জবাব পাই—না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আমাদের যৌবনকে মহিমান্বিত করেছে। রাজনীতিবিদদের আপসের চোরাবালিতে হয়তো হারাতে বসেছে আমাদের মহৎ অর্জন। কিন্তু তাতে অর্জনের মাহাত্ম্য ম্লান হয় না। খেটে খাওয়া যুবক নূর হোসেনের কাছে বানানটা মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল গণতন্ত্রের মুক্তি।

নূর হোসেন দিবসে ভোটাধিকারের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের তৃষ্ণা আরও বাড়ে। ‍‍‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক‍‍’ এই স্লোগান এখনো প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এটা মানতেই হবে, গত এক যুগে বাংলাদেশে চোখধাঁধানো উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। আশির দশকে আমরা ভাবিইনি, বাংলাদেশ আজকের জায়গায় পৌঁছাবে। উন্নয়ন আমরাও চাই, তবে তার আগে চাই গণতন্ত্র।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!