• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২৪, ০১:৫১ পিএম
বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি

‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হবেন। তাঁকে অবলম্বন করেই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশি সমাজকে ভক্তি করবো, সেবা করবো। তাঁর সঙ্গে যোগ রেখেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হবে’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘স্বদেশী সমাজ’, রবীন্দ্রনাথ-রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বিশ্বভারতী ১৩৯৩, পৃষ্টা ৬৩৪)। রবীন্দ্রনাথ যেমন মানুষটির খোঁজ করেছিলেন তাঁর সন্ধান পেতে আমাদের একটা লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন থেকে শত বছর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম ‘খোকা’। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তিপাগল সংগ্রামী মানুষ। যাঁর তর্জনী হেলনে একদা বাংলার মানুষ জীবন দিতেও কার্পণ্য করেনি।

দুই.
শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বলেছিলেন—‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।’ তাঁর সেই সাহস ছিল, মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তোলার মতো দৃঢ়-প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বের জোর ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু—বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগেই তিনি এই নামটির সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব এক করেছিলেন। তাঁকে আড়ালে রেখে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। এই অর্থে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন-অবিচ্ছেদ্য। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তাঁকে কেন্দ্র করে এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

চর্যাপদের কবিদের দ্রোহ থেকে কৈবর্ত্য বিদ্রোহ। ফকির বিদ্রোহ থেকে ফরায়েজী আন্দোলন। বাঁশের কেল্লা নিয়ে রুখে দাঁড়ানো তিতুমীর। কলের বোমা হাতে ক্ষুদিরাম বসু। চট্টগ্রামের বীরপতি সূর্যসেন, প্রীতিলতা। ব্যারাকপুরে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মঙ্গল পান্ডে। বিনয়-বাদল-দিনেশ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুঁড়ে ফেলে নাইট পদক আর নজরুলের দ্রোহ। সব সাহসের সমস্বরের উচ্চারণ—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তারকাসুলভ রাজনৈতিক নেতা খুব বেশি তো পায়নি বাঙালি, তার সমগ্র ইতিহাস জুড়ে। এই মানুষটি নিঃসন্দেহে সেই গৌরবময় অভিধার অন্যতম দাবিদার, নেতাজির পরে। এ নেতাজিরই অনুপ্রাণিত বাঙালি তিনি। 

সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই নেতা কিংবা নায়কের স্থান করে নিতে পারে না, হতে পারে না, হাতেগোনা কিছু মানুষের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব হয়। মাঝে মাঝে অসাধারণ ক্যারিশমাসম্পন্নরা অবশ্যই ‘বড় নেতা’ অথবা ‘মহানায়কের’ আখ্যায়ও ভূষিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তারা অবশ্যই সম-সাময়িক কালের নেতা, চলতি পারিপার্শ্বিকতারর প্রেক্ষাপেট নায়ক। কিন্তু ‘ইতিহাসের নায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদেই তার ‘নায়কের’ উদ্ভব ঘটায়, আর সেই ইতিহাসের নায়ক-ই হয়ে ওঠেন ইতিহাসের প্রধান কারিগর। বঙ্গবন্ধু দেশের একজন বড় নেতা ও রাজনীতির একজন মহানায়কই শুধু ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইতিহাসের নায়ক। 

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই ‘জাতির জনক ছিলেন না। কিংবা তাঁর ওপর এ অভিধা চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শুরুতে তিনি ছিলেন দুরন্ত কিশোর মুজিবুর। অনেকের কাছে মুজিব ভাই। তারপর মুজিবুর রহমান, অথবা শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর বহুদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে তাঁর নাম ছিল শেখ সাহেব। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু’। একাত্তরের পর তিনিই স্বাধীন দেশের স্থপতি, জাতির জনক। তিন দশক সময়কালের মধ্যে এভাবেই তাঁর অবস্থানের উত্তরণ।

তিন.
৬৯ বছর আগের কথা। ১৯৫৫ সাল তখন। আগস্ট মাসে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে করাচিতে। তারিখটি ছিল ২৫ আগস্ট। এক পর্যায়ে সংসদে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর গমগমে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে স্পিকারকে বললেন, ‘স্যার আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ববাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব-পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এ দেশটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।’

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত এ দেশের নাম ছিল ‘পূর্ববাংলা’। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পূর্ববাংলার নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান। সুতরাং এটা পরিষ্কার, পূর্ববাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তান করার যে চক্রান্ত চলছিল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় সংসদে তার প্রতিবাদ করেন। তিনি যে এই ভূখণ্ডের নামের ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন, এটাই তার প্রমাণ।

১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। তাদের অভিযোগ ছিল, শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চাইছেন। এই মামলা দাঁড় করানোর জন্য যে কাগজপত্র প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তার মধ্যে ছিল বেনামে লেখা কতগুলো চিঠি ও একটি চিরকুট। ওই চিরকুটে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশ’। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন।

চার.
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তিনি বুঝতে পারেন যে, এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য জোরেসোরে নামার সময় এসেছে। তিনি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে আন্দোলনে নেমে পড়েন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো বিশিষ্ট নেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি দৃঢ়চেতাভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন। একটি কমিউনাল পার্টিকে ন্যাশনাল পার্টিতে রূপান্তরিত করে ফেলেন। দলের কর্মীরা শুধু নয়, সমগ্র দেশবাসী ওই ৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর পেছনে সমবেত হতে থাকে।

সরকার মরিয়া হয়ে তার বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দিয়ে তাকে সবদিক থেকে  ‘শেষ করে দেওয়ার’ চেষ্টায় নামে। কিন্তু ‘শেখ সাহেব’ ছিলেন ইতিহাসের পক্ষে এবং ইতিহাস সৃষ্টির মতো প্রজ্ঞা, জেদ, প্রত্যয় ও দক্ষতাসম্পন্ন। পাক-সরকারের প্রতিটি আঘাত তাঁর জন্য বীরমাল্য হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তার জনপ্রিয়তা অসামান্য উঁচু স্তরে পৌঁছে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। ৬ দফাকে প্রগতিশীল কর্মসূচিতে সমৃদ্ধ করে রচিত হয় ঐতিহাসিক ১১ দফা। সংগঠিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। মুক্ত হয়ে আসেন মহানায়ক। শেখ সাহেব হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

পাঁচ.
তিন দশকের রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও জীবন দর্শনেরও উত্তরণ ঘটেছিল। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটি ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্র-কর্মী হিসেবে, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর সেøাগানধারী জঙ্গিকর্মী হিসেবে। কিন্তু সে সময়ও মুসলিম লীগের মধ্যে উদারনৈতিক ও কিছুটা গণমুখীন যে প্রবণতা ও অংশ ছিল, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আবুল হাশেম-সোহরাওয়ার্দীর অংশের অনুগামী এবং ঢাকার নবাবদের নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরোধিতাকারী। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট—এই তিন দলের ঝাণ্ডা নিয়ে কলকাতায় ‘রশিদ আলী দিবস’ পালনসহ নানা কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন একজন উৎসাহী যৌবনদীপ্ত অংশগ্রহণকারী। মুসলিম লীগের কর্মী হলেও তখন থেকেই তিনি ছিলেন গণমুখী ধারার লোক। একই সঙ্গে তার মাঝে প্রবিষ্ট হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বোধের উন্মেষ। 

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে গণমানুষের ক্রোধ ও স্বাধিকারের প্রত্যয়কে ধারণ করে জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে নেন। ওই ভাষণে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’ ... ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার পথে বাঙালি পথযাত্রার শীর্ষ পর্যায়ের ও প্রত্যক্ষ অধ্যায়ের সূচনা সেখান থেকেই। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো’—এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের।’ তিনি পার্টির নেতা-কর্মীদের বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়।

ছয়.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন, এই দারিদ্রলাঞ্ছিত দেশে এক পরিত্রাণকর্তার দেখা পাবেন, যিনি মানুষকে পরম আশ্বাসের কথা শোনাবেন। যে পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলো বলেন, সেটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু এই কথাও আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি আমাদের যেভাবে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, মানুষ হিসেবে মানুষকে যে আশ্বাসের কথা শোনাতে চেয়েছিলেন, এ দেশে এমন আর কে চেয়েছেন!

যত দিন বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে হবে। চেষ্টা করেও তাঁকে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এ দুঃসাহস যদি কেউ দেখায়, সে ক্ষতি তাদের, গোটা জাতির। 

ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের একটি উক্তির উদ্ধৃতি দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘সত্য হতে একটি সমাজ যত বেশি দূরে সরে যাবে তত বেশি যারা সত্য বলেন তারা ঘৃণার পাত্র হবেন।’ (The further a society drifts from truth the more it will hate those who speak it.) বঙ্গবন্ধুর ভুল অথবা দুর্বলতা সীমাবদ্ধতা নেই, এইভাবে ভাবা ঠিক নয়। তেমনি তার শক্তি, অবদান ও ভূমিকাকে খাটো করে দেখা ঠিক নয়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন তাঁর ‘রক্তাক্ত দিনগুলো: ১৯৭৫-৮১: অভ্যুত্থান-পাল্টাঅভ্যুত্থান: প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা’ বইয়ে লিখেছেন—“এককথায় যাঁর জীবনের সুন্দর সময়গুলোই কেটেছে কারাগারে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আর এসব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য। একটা জাতির জীবনে এ ধরনের নেতার জন্ম বারবার হয় না।” ইতিহাসের মরালিটি এটাই, বঙ্গবন্ধুকে পাশ কাটিয়ে ইতিহাস কাটাছেঁড়া করা যাবে না। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অপরাপর চরিত্রগুলোকেও পুনঃস্থাপন দরকার। বঙ্গবন্ধুকে বাইরে রেখে যেমন ইতিহাসের অন্যান্য চরিত্র নির্মাণ করা যায় না, তেমনি অপরাপর চরিত্রগুলোকে বাদ দিয়েও ইতিহাস নির্মোহ হবে না।
 

Link copied!