• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জুলাই জাগরণ: ফ্যাসিবাদের পতন ও গণতন্ত্রের জয়


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২৪, ০৬:০৮ পিএম
জুলাই জাগরণ: ফ্যাসিবাদের পতন ও গণতন্ত্রের জয়

শেষ পর্যন্ত বিদায় নিলেন শেখ হাসিনা। করুণভাবে। এমন ভাগ্যলিপির রচয়িতা তিনি নিজেই। তাই বলা হয় ক্ষমতার দম্ভ বিপদ ডেকে আনে। যে আন্দোলন নিছক কোটা সংস্কারে আবদ্ধ ছিল, সেই আন্দোলন আজ ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন শুধু নয়, আপামর জনসাধারণের আবেগ ও সংক্ষুব্ধতা নিয়ে হাজির হয়েছে সরকার পতনের আন্দোলনে। এবং তারা সফল হয়েছে। এমন পরিণতির জন্য সরকারও প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করেছেন, পুরো আন্দোলনটাকে বিদ্ধ করেছেন পুরনো দুমুখো তীরে। এই তীরের নাম অতিকথামূলক বা পুরাকল্পীয় তীর। ইংরেজিতে বললে বলা যায় ন্যারেটিভ অব মিথিক পাস্ট। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বাধীনতা অর্জনের এক গৌরবজনক অধ্যায়। কিন্তু সেই ইতিহাসকে নিজেদের হীন স্বার্থে অতি ব্যবহারের কারণে পুরাকল্পীয় বয়ান হাজির হয়, এতে জাতীয়তাবাদের যে জবরদস্তিমূলক চর্চা হয়, সেটি নিঃসন্দেহে ফ্যাসিবাদী সরকারের লক্ষণ।

ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনিকে স্মরণ করে জীবিত দার্শনিক জ্যাসন স্টেনলি ‘হাউ ফ্যাসিজম ওয়ার্কস: দ্য পলিটিকস অব আস অ্যান্ড দেম’ বইতে বলছেন, ফ্যাসিস্ট রাজনীতিতে পুরাকল্পীয় অতীতের কাজ হলো—ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শের কেন্দ্রে থাকা কর্তৃত্ববাদের সাথে স্মৃতিকাতরতা ও আবেগকে জুড়ে দেওয়া। এখন বলা বাহুল্য নয়, বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ভীষণরকম আবেগের বিষয়। মানুষের সামষ্টিক স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ জাগরুক। কিন্তু কোনো দল বা সরকার যখন সেই আবেগকে পুঁজি করে রাজনৈতিক খেলায় নামে তখন সেটা ফ্যাসিবাদী কায়দা হিসেবেই গণ্য করা হয়।

আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিপরীত শক্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক, সেনাবাহিনী ও এদেশের কিছু মানুষ, যারা রাজাকার-আলবদর-আলশামস হিসেবে পরিচিত। এটা ঐতিহাসিক সত্য। আরো সত্য এই যে জামায়াতে ইসলাম কোনোদিনই বাংলাদেশের সুবিধা করতে পারবে না, যতদিন পর্যন্ত মানুষের সম্মিলিত স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে। তাছাড়া সামাজিকভাবে এমনিতেই জামায়াতে ইসলাম কোনঠাসা। খেয়াল করলেই দেখবেন খুব কম লোকই নিজেদের জামায়ত কর্মী বলে প্রকাশ্যে পরিচয় দেন। কাজেই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই ১৯৭১ ও তৎপরবর্তী নানা ন্যাক্কারজনক ভূমিকা ও নৃশংসতার জন্য জামায়াতকে ঘৃণা করে। কিন্তু এই জামায়াতকেই একটি বড় হুমকি হিসেবে হাজির করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চাওয়ার ভেতর অন্য রাজনীতি রয়েছে। সুবিধার রাজনীতি। যেটা আওয়ামী লীগ করে আসছিল।

ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো সে সর্বদা একটি প্রতিপক্ষকে সামনে রেখে জনগণকে জুজুর ভয় দেখাতে চায়। আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে বেছে নিয়েছে জামায়াত ইসলামকে। আওয়ামী লীগও খুব ভালো করে জানে এদেশের সাধারণ জনগণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা প্রকৃত নাগরিক কখনোই জামায়াতকে গ্রহণ করবে না। তারপরও এই জেনোফোবিয়া টিকিয়ে রাখতে হয় তাদের অস্তিত্বের জন্য। এমনকি, যখনই কোনো ভিন্ন মত বা বিরোধী অবস্থান উপস্থিত হয় তখনই আওয়ামী লীগ তাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বা রাজাকার বলে সম্বোধন করে। এটা বিরুদ্ধ মতকে দমন করার একটি নিকৃষ্টমানের কৌশল।

আওয়ামী লীগের সমালোচনা বা তাদের মতের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বটে, কিন্তু তারা স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ মানে জনযুদ্ধ, এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও জনতার সম্মিলিত মুক্তির লড়াই। যে লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে এদেশের মুক্তিকামী মানুষ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এটাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি চেতনা বাস্তবায়নের চাইতে একে নিয়ে ব্যবসা করতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাধারণ মানুষের আবেগ রয়েছে, তাই একে কাজে লাগিয়ে তারা যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছিল তারা। কিন্তু চেতনাকে চাপিয়ে দিতে হয় না, তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। আওয়ামী লীগ চেতনাকে শুধু চাপানো নয়, প্রয়োজনে চেতনানাশক দিয়ে চেতনা গেলানো এবং অতিরিক্ত ক্ষমতার ব্যবহার করতেও পিছপা হয়নি। এটাই এখন বুমেরাং হয়ে তাদের গায়ে বিদ্ধ হয়েছে। জুলাই জাগরণ তাদের শিখিয়ে দিয়েছে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।

শেখ হাসিনা যখন ১৪ জুলাই বললেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?” তখনই ফুঁসে উঠল আন্দোলনকারীরা। তারা জুলাই মাসের শুরু থেকেই রাজপথে ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেদিন মাঝরাতেই হল থেকে বেরিয়ে এসে স্লোগান ধরল: তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই স্লোগানের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কূটখেলাকে ছুড়ে ফেলে দিলো। ছাত্রদের ওই স্লোগানের বিপরীতে, যারা স্বৈরাচার সরকারের পক্ষে অথবা যারা আওয়ামী লীগের ছল ধরতে পারে নি, তারা পাল্টা স্লোগান প্রচার করতে লাগলো: তুমি কে আমি কে, বাঙালি, বাঙালি। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সবাই কি বাঙালি? এই স্লোগানের ভেতর লুকিয়ে থাকা যে জাত্যাভিমান রয়েছে, সেটিও ফ্যাসিবাদের এক মূলমন্ত্র। শিক্ষার্থীদের স্লোগানে ছিল অভিমান। অভিমানের বিপরীতে ফ্যাসিবাদী জাত্যাভিমানকে কাজে লাগিয়ে হাসিনা সরকার ভেবেছিল রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারবে। জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন দমাতে পারবে। কিন্তু জনগণের আর বাকি নেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি বুঝতে। কাজেই তারা শিক্ষার্থীদের অভিমান বুঝে, তাদের যৌক্তিক দাবীর পক্ষেই রইল।

দাবি কি? দাবি হলো সরকারি নিয়োগে ৫৬ শতাংশ যে কোটা ভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থা রয়েছে সেটা পাল্টাতে হবে। এই ৫৬ শতাংশের ভেতর ৩০ শতাংশ হলো মুক্তিযুদ্ধ কোটা। যার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা, তার সন্তান ও নাতিপুতিরাও কোটা সুবিধা পাবে। বাস্তবতা হলো, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের কেউই আর স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর কোটা ব্যবহার করে চাকরি নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। এই সুযোগে আওয়ামী লীগ প্রচুর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বিলি করে চাকরিবাকরির সুযোগ করে দিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বিশাল অর্থ বাণিজ্য। তাছাড়া ১০ শতাংশ যে জেলা কোটা রয়েছে সেটি থাকারও কারণ নেই। তাই আন্দোলকারীরা বলছিল কোটার পরিমাণ কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তাদের বলা হলো তারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। খেয়াল করার বিষয় তাদেরকে কিন্তু নারীবিদ্বেষীও বলা যেত, যেহেতু ৫৬ শতাংশের ভেতর ১০ শতাংশ নারী কোটাও আছে, কিন্তু সেটা না বলে অতিকথনমূলক অতীত ব্যবহারের যে ফ্যাসিবাদী ছাচ, তার ভেতরেই ফেলা হলো। বলা হলো তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী।

পরিতাপের বিষয় সরকারের ইশারায় সর্বোচ্চ আদালত যখন ২১ জুলাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে কোটার পরিমাণ ৭ শতাংশে নামিয়ে আনলো এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য বরাদ্দ করল ৯৩ শতাংশ, ততক্ষণে সরকারের হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের খুনে। এই লাশের উপর দিয়ে ছাত্ররা সরকারের সঙ্গে আলাপ বা সমঝোতার জন্য আর বসতে চাইলেন না। তারা দাবি করলেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত করতে হবে, তাদের উপর যেন হয়রানি না করা হয় ইত্যাদি। সরকার একদিকে তাদের বললেন দাবি মানা হয়েছে, অন্যদিকে কারফিউ দিয়ে আরো মানুষ হত্যা করল, ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রদের গ্রেফতার করল। এমনকি ঘরের ভেতর থাকা শিশুরাও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল। এক সপ্তাহের ভেতর মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল আড়াইশ। সরকারি ঘোষণাতেই রয়েছে দেড়শ। এই পরিমাণ মৃত্যু তো বায়ান্ন বা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও ঘটেনি। ১৭ জুলাই থেকে সরকার ধীরে ধীরে পুরো ইন্টারনেটই বন্ধ করে দেয়। টানা পাঁচদিন জনগণকে অন্ধকারে রেখে সরকার চেয়েছিল তথ্যের প্রবাহকে অন্ধকারে পাঠিয়ে দিতে। এটিও ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য। তারা জনগণকে কোনো সত্য তথ্য দিতে চায় না। সেই সময়টাতে আমরা যেন জর্জ ওরওয়েলের উপন্যাস ‘১৯৮৪’-এর চরিত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। পাঁচদিন পর যাও কিছুটা ইন্টারনেট এলো, তাও সামাজিক যোগাযোগের এপগুলো স্বাভাবিক হলো না। দিনে রাস্তায় তো গুলি চললোই, রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি, গ্রেফতার ও খুনের ঘটনাও ঘটল। মোবাইল ফোন ঘেটে ঘেটে আটক করা হলো শিক্ষার্থীদের।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো ৪ আগস্ট, আওয়ামী লীগ তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে নামিয়ে অযথা শতাধিক মানুষকে মারল। কারফিউ জারি হলো, আবার রাজপথে নামল সেনাবাহিনী। তবে ৫ আগস্ট জনগণের লং মার্চের জোয়ারে ভেসে গেল সব বাধা ও বিপত্তি। এবং ক্ষমতার দম্ভ। এতেই প্রমাণ হয় দমিয়ে রাখা যায় না মানুষের অভ্যুত্থানকে। গণঅভ্যুত্থান দাবানলের মতো। গত ২৯ জুলাই আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম: “গণ অভ্যুত্থান দাবানলের মতো, এর সাথে জেদ দেখানো অথবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বোকামি। তারপরও কেউ যদি রিপ্রেসিভ স্টেট এপারাটাস দিয়ে আগুন দমনের চেষ্টা করে, তারা পুড়ে ভস্ম হয়।” আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত ভস্ম হলো।

অথচ ছাত্রজনতার ফুঁসে ওঠা দেখে সরকার সেই পুরনো রেকর্ড বাজানো শুরু করেছিল, বলা হচ্ছিল তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপিই এই আন্দোলন ও সহিংসতার সাথে জড়িত। মূলত এটা যে ছাত্রজনতার জাগরণ সেটি স্বীকার করলে যে বিপদ! গণতন্ত্রের যে লোকদেখানো মন্ত্র আওড়ানো হয়, সেটি আর ধোপে টেকে না। এই আন্দোলনে যদি তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েই, সেই তৃতীয় পক্ষের ভেতর বিএনপি-জামায়াত যেমন আছে, তেমনি আছে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ। কারণ আন্দোলনটা সাধারণ মানুষের হাতেই শুরু। এবং সাধারণের দ্বারাই পরিচালিত। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকেও তা প্রমাণিত হয়। শুধু মাত্র ঢাকাতেই শুরুর দিকে আন্দোলন চলাকালে ২৪৩ মামলায় গ্রেফতার হয় ২ হাজার ৬শ ৩০ জন। তাদের ভেতর ২ হাজার ২শ ৮৪ জনের রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আর মাত্র ২৬৯ জন বিএনপির কর্মী ও জামায়াত-শিবিরের ৭৩ জন। (সূত্র: প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০২৪)

প্রশ্ন হলো বিশাল আয়োজন করে যে তৃতীয় পক্ষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হলো, তাদের এত কম কর্মী গ্রেফতার হলো কেন? ৮৭ শতাংশেরই তো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এতেই প্রমাণ হয় এই জুলাই জাগরণে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। আর তৃতীয় পক্ষের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে সরকারের সাথে কি তৃতীয় পক্ষ কেউ নেই? ভারত, চায়না বা রাশিয়া? সেই আলাপ এখানে করার আর প্রয়োজন নেই।

শুরু থেকে যদি এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী দম্ভের কারণে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসভিত্তিক আন্দোলনকে, হল বন্ধ করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সারা দেশে। এই জুলাই জাগরণ যে ঘটতে যাচ্ছে তার কিছু আলামত আসলে আন্দোলনের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছিল। যেমন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে যখন ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা চালালো, তখন পাল্টা হামলায় প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন হল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর বাংলা ব্লকেড কর্মসূচীতে অংশ নেয় স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও। বাধ্য হয়ে সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কারফিউ দিয়েও মানুষকে ভয় দেখানো যায়নি। তারা রাস্তায় বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেছে, বুক পেতে গুলি ও মৃত্যুকে বরণ করেছে। জনস্রোত দমনে সরকারকে এই প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়েছে।

প্রশ্ন হলো এত ক্ষোভ কেন জমে উঠেছিল জনগণের ভেতর? এর উত্তর জমা আছে বিগত দেড় দশকে, আওয়ামী লীগের টানা শাসন আমলে। তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ তো করেছেই, এছাড়া ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন লুটপাট, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বে-নজির দুর্নীতি এবং সবচেয়ে বড় যে ঘটনা, তা হলো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি মানুষকে ক্ষুব্ধ ও অসহায় করে তুলেছিল। এর ভেতর লেখক ও ব্লগার হত্যা, সরকারের সমালোচকদের উপর দমন-পীড়ন এসব মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। এ সরকারের শুরু থেকেই অসন্তোষ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল: বিডিআর বিদ্রোহ, শাহবাগ আন্দোলন, রাস্তা সংস্কার আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইতি ও আদি। তো সকল কিছুর পুঞ্জীভূত রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই ঘটল ২০২৪ সালের জুলাইতে এসে, বিশেষ করে যখন তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে, তখন ক্ষোভ আসলে দাবানলেই পরিণত হয়েছে। একে আর শত চেষ্টা করেও দমানো সম্ভব হয়নি। বেড়েছে আন্তর্জাতিক চাপ। এসব চাপেই নতি স্বীকার করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।

সরকার ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছিল। তারা পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল জুলাইয়ের এত সংঘাতের পেছনে জামায়াতই আসল হোতা। পরিহাসের বিষয় হলো যে জামায়াতের সামাজিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল এবং যার এই মাপের আন্দোলন সংগঠিত করা ও পরিচালনা করার কোনো শক্তিই নেই, আওয়ামী লীগ সেই অমিত শক্তির আন্দোলনের পুরো কৃতিত্ব দিয়ে দিলো জামায়াতকে, তাদের নিষিদ্ধ করে। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে জামায়াতও একই রকম মেরুকরণের খেলা খেলে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মত গেলেই তারা সবাইকে ‘নাস্তিক’ বলে দেগে দেয়। আওয়ামী লীগ যেমন মতের অমিল হলেই ‘রাজাকার’ বলে গালি দেয়। এসব করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করে দিয়েছে বলে আমার মত। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধকে প্রথমে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তারপর যত অপকর্ম সব করেছে, তাও আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ভাঙিয়ে। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের ঝাণ্ডা ধরে থাকা আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের কাছে একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় ক্ষতি যদি কেউ করে থাকে, তাহলে সেটি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ করেছে, আর কেউ নয়। রাষ্ট্র থেকে বিরোধী দলকে নির্মূল করে গণতন্ত্রের ক্ষতি তো তারা করেছে অনেক আগেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও তার দলের এমন পরিণতি, ফ্যাসিস্ট উপাধি নিয়ে এমন করুণ বিদায় অকল্পনীয় ছিল জুন মাসেও। কিন্তু এই ঘটনা বাংলাদেশে ঘটল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ফ্যাসিবাদি হয়ে ওঠার কারণেই। ইতালিয় ভাষায় fascio শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘আঁটি বাঁধা’, এই কথাটি রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, রূপকের মানে ক্ষমতার প্রতীক। ফ্যাসিস্ট নেতৃত্ব আসলে সকল ক্ষমতা আঁটি বেঁধে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। আর একারণেই ফ্যাসিস্ট নেতার বিদায়ঘন্টা বেজে যায়। সেটাই হয়েছে ২০২৪ সালের বাংলাদেশে।

এদেশের জনগণ যারা মুক্তিযুদ্ধ ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন, তারা এদেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ভেতর যা যা রয়েছে: বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ, মানবিক মর্যাদা এসকল কিছুর চর্চা করতে চান। আওয়ামী লীগের আমলে মানুষ এসবের চর্চা পুরোপুরি করতে পারেনি। আগের আমলেও যে পেরেছে তাও নয়। এদেশের সকল সরকার বরাবরই রিপ্রেসিভ স্টেট এপারাটাস ব্যবহার করেছে। তারা জোরজবরদস্তি করেছে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিয়েছে। আর সেজন্যই বারবার এই ভূ-খণ্ডের মানুষ সমুদ্রের মতো গর্জে উঠে গণজোয়ার তৈরি করে আছড়ে পড়েছে অন্যায় ও অত্যাচারের উপর। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সকল ফ্যাসিবাদকে, ভবিষ্যতের সুদিনের আশায়। যতদিন অন্যায় ও অবিচার থাকবে, ততদিন এই জোয়ার ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে ফিরে আসবে। 

তরুণদের অকুতোভয় ভূমিকার কারণে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, এখন আমাদের নজর দিতে হবে রাষ্ট্রে যেন প্রতিহিংসা ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে না পড়ে। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে সংযত আচরণ দেখাতে হবে, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র চাইলে এই মুহুর্তে সকলকে স্থির ও শান্ত হয়ে বসতে হবে। এরপর সকলকে নিয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে। জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছুতে সকলপক্ষকে নিয়ে আলাপের কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংবাদ প্রকাশ

Link copied!