আজ বিশ্ব নারী দিবস। প্রতি বছরের এই দিনটিকে ঘিরে নারীকে কিছুটা সম্মানিত করে তোলা হয়। নারীর অধিকার, মূল্যবোধ, স্বাবলম্বিতা, সম্মান-শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও কর্মক্ষেত্রে নারীকে যোগ্য সম্মান প্রদান, পরিবারে নারীর মতের মূল্যায়ন, গণপরিবহন থেকে পথে-ঘাটে চলাচলে নারীর নিরাপত্তা প্রভৃতি নানামুখী দিক নিয়ে সরব আওয়াজ ওঠে এ সময়। একটি দিনকে সামনে রেখে এ সমাজ বিশেষভাবে নারীকে মূল্যায়িত করে বলেই মনে হয়। যদিও এ সমাজ গঠনের মূল কারিগর এই নারী। নারী তার আপন শক্তিতে পরিবারকে সুগঠিত করে না তুললে কবেই কালের স্রোতে ভাসতো পরিবার। এসবের গভীরে থেকে গেছে নারীর একান্ত জীবনের যাতনা। আজও আমাদের সমাজে নারীরা নির্যাতিত-অবহেলিত-নিপীড়িত! ঘরের কাজে নারীর মূল্যায়ন নেই, শ্রদ্ধা ও সম্মান নেই। পরিবার-পরিজনের ধারণা তা নারীর নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য। এ জন্য নারীকে বাড়তি কোনো উষ্ণ অভিনন্দন জানানো হয় না।
নারী শক্তির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে পরিবারে নারীর অবস্থান। কন্যা সন্তান জন্মের পর থেকেই পরিবারে বৈষম্যের শিকার হয় সে। একই পরিবারে কন্যা ও পুত্র থাকলে পিতা-মাতা বা অভিভাবকরা আজও কন্যাকে একটু আড় চোখে দেখেন। জানতে বা অজান্তেই তারা কন্যার ক্ষেত্রে বৈষম্য করেন। চাহিদা ও প্রাপ্তির জায়গায় ব্যারিকেড দিয়ে দেন। পুত্রের জন্য সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করার সাধ্যাতীত চেষ্টা করলেও কন্যার ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটে। তিল তিল করে বেড়ে ওঠা কন্যা জানে তাকে তার লক্ষ্যের পথে হাঁটতে কতোটা কাল-ঘাম ছোটাতে হয়েছে। কতোটা বিষের যন্ত্রণা ও কাঁটা বিছানো পথে হাঁটতে হয়েছে।
সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আজও কন্যা সন্তান বেড়ে ওঠে অবহেলায়, অবজ্ঞায়। তবু সংগ্রামের পথে হার না মানা লড়াকু নারী একদিন জীবন প্রদীপ জ্বালার গল্পে অংশ নেয়। সমাজের প্রতিবন্ধকতাকে রুখে দিয়ে আপন তরী ভাসানোর গল্প বলে জাতিকে। আজ জাতি এমন অসংখ্য নারীর স্বপ্ন জয়ের গল্প শুনছে। যাদের শত বন্ধুরতার পথ থাকলেও তারা প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করেছে। পরিবারে, সমাজে নারীর জন্য কোনোই সুস্থ ও সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ, মূল্যায়ন না থাকলেও মনোবলের কাছে হার মানেনি এ সব নারী। যদিও সে অংশ যে খুব বেশি তা নয়। আজও গ্রামাঞ্চলে নারীরা একটু আশ্রয়ের জন্য স্বামী-শ্বশুর বাড়ির নির্যাতনকে মুখ বুজে সহ্যও করছে। যৌতুক, বাল্যবিয়ের জ্বালা সইতে না পেরে কেউ না কেউ আত্মহননের পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন।
আজকের নারীরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে একমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে। অর্থের সঙ্গে নারীর সুখ-সমৃদ্ধি-স্বস্তি-স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বিতা জড়িত। নারী আজ তার গল্প অন্যকে শোনাচ্ছে। সেখানেও অর্থের যোগ রয়েছে। অর্থহীন গল্প কেউ শোনে না। সেই অর্থ যেমন টাকা-ধন-সম্পদ তেমনই অর্থবহ জীবনের গল্প। তারা গল্প বলছেন জীবন জয়ের। সবই নারীর উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে নারীর পায়ের নিচে মাটি নেই, তার ওপর যতো নির্যাতনই হোক তিনি শক্ত অবস্থানে যেতে পারেন না। দৃঢ়তার সঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেন না। তাই নারীর মুক্তি অর্থের ওপর নির্ভরশীল।
সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে নারীর জন্য অর্থই প্রকৃত মুক্তির পথ। অর্থের যোগান যখন নারী দিতে পারবেন, তখন তিনি অন্যের ওপর পরগাছা না হয়ে নিজেকে মূল্যায়ন করতে শিখবেন বিশেষভাবে। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করে বরং অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠবেন। সত্যের পথে হাঁটতে শিখবেন। আজ নারীরা নিজেকে প্রাধান্য দিতে শিখেছে কিঞ্চিৎ হলেও। নারীরা আগের মতো সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেন না। যার কারণে সমাজে বিচ্ছেদ বেড়েছে। অনেক মহাজ্ঞানী এ জন্য নারীকে দোষারোপ করেন। বলেন, নারীর স্বাবলম্বিতা, উচ্চশিক্ষা নাকি এর জন্য দায়ী। কিন্তু এই মহারথীরা এটা বলেন না, যে অন্যায় হলে অত্যাচার-নিপীড়ন হলে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে। সোচ্চার হতে হবে। লড়তে হবে। থেমে যাওয়া জীবন নয়। তাই আজ নারীরা যে অবস্থানে আছেন, তার জন্য তাদের আরও বেশি সম্মানিত করা উচিত।
নারীকে জাগ্রত করতে হলে, নারীর কর্ম-ধ্যানে-জ্ঞানে-চেতনার সম্মিলন ঘটাতে হবে। নারীর যোগ্যতা-দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার জন্যও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। যদি তা না হয় তাহলে নারীর জন্য কালবৈশাখী অপেক্ষা করে। করোনার সময় দেখা গেছে বাল্যবিবাহের হিড়িক। ছোট ছোট কন্যাসন্তানকে একপ্রকার বলি দিয়েছে অনেক পরিবার। তারা সংসারের চাপ কমাতে সন্তানের গলায় ছুরি ধরেছে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট কন্যা সন্তানকে পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। যার ফল যে কতো বেশি ভয়াবহ, তা সচেতন মানুষ মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।
পত্রিকার পাতা উল্টাতেই প্রতিদিন চোখের সামনে মানুষের নোংরামি-কদর্যতা ও বীভৎসতার সাক্ষাৎ মেলে। যৌতুকের দাবিতে নারী হত্যা, প্রেমের ফাঁদ পেতে নারীকে কৌশলে করায়ত্ত, হত্যা-আত্মহত্যা সবই ঘটছে। সচেতনতার পাশাপাশি নারীর আর্থিক মুক্তি নারীকে সঠিক পথ দেখাতে পারে। নারী তার সব বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে সফলতার মুখ দেখতে পারে।
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হবে বিনিয়োগ।’ কিন্তু আজ অবধি নারী সমঅধিকার প্রাপ্ত নয়। সমসুযোগের কথা তো বাদই গেলো। কন্যা সন্তান যেদিন পরিবার থেকে সমঅধিকার প্রাপ্ত হবে, সেদিন হয়তো বাইরেও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে বা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু যার ঘরেই মূল্যায়ন নেই, তিনি বাইরে মূল্যায়িত হবেন কীভাবে। আজও গণপরিবহনে নারীকে সমঅধিকার দেওয়া যায়নি। সমঅধিকার দূরে থাক নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীর জন্য বরাদ্দ ৯টা আসন অধিকাংশ সময় পুরুষ দখল করে রাখেন। খুব হাস্যকর তাদের যুক্তি ও কথাবার্তা। নারী তার অধিকারের পথে হাঁটতে গেলে তাকেই কটুবাক্য শুনতে হয়। একটি দিনে তাই বিশেষ কোনো পরিবর্তন করানো সম্ভব নয়। সমঅধিকার, সমসুযোগ, নিরাপত্তা সবই আসবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে। মানবিকবোধ ছাড়া নারীর ওপর শ্রদ্ধা আসবে না। সমঅধিকার প্রাপ্তি ঘটবে না। তাই কোনো বিশেষ দিন নয়, প্রতিদিন হোক নারীর। প্রতিটি দিনে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন-পরিমার্জন আসুক এ সমাজে। নারীর প্রতি রূঢ়তার অবসান ঘটুক।
দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীর মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। এ লক্ষ্যে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক নিরাপত্তা জরুরি। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা জরুরি। নতুবা একটি নারী দিবসেই ‘নারী’ সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, জীবনের ধারাপাতে নারীর মলিনত্ব কমবে না। সব বাধা-ব্যবধান ঘুচে যাক। নারী হোক আপন আলোর সহযাত্রী।
লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়