• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ ও পরিত্রাণের উপায়


অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দীন
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ ও পরিত্রাণের উপায়

এ কথা সত্য যে মানুষ আত্মহত্যা করে। ফ্রয়েডিয়ান মনস্তত্ত্ব¡ অনুযায়ী মানুষের মনের গভীরে (অবচেতন মনে) দুই রকম পরস্পরবিরোধী শক্তি (psychic energy) সব সময় কাজ করে। এ দুটি হলো erros ও thanatos। এরসের কাজ হলো জীবনকে ধনাত্মকভাবে পরিচালিত করা আর থ্যানাটসের কাজ হলো জীবনকে ঋণাত্মকভাবে পরিচালিত করা। মানুষের সব আচরণ এই দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির লব্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। থ্যানাটস সবকিছু ধ্বংস করতে চায় এবং হত্যা করতে চায়। এই হত্যার প্রবণতা দুইভাবে কাজ করতে পারে। একটা হলো অন্যকে হত্যা করার প্রবণতা (genocidal), আরেকটি হলো নিজেকে হত্যা করার প্রবণতা (homicidal)। এই প্রবণতা যখন বেশি মাত্রায় কাজ করে বা কার্যকর হয়, তখনই ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।

উল্লেখ্য, কেবল বাংলাদেশেই আত্মহত্যা করে, তা নয়। সব দেশে ও সব সমাজেই আত্মহত্যা কমবেশি আছে। উন্নত দেশগুলোতেও এর হার অনেক বেশি। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয়েছে এমন দশটি দেশ ক্রমনুসারে ১. লেসেথো, ২. গায়ানা, ৩. এসওয়াতিনি, ৪. দক্ষিণ কোরিয়া, ৫. কিরিবাতি, ৬. মাইক্রোনেশিয়া, ৭. লিথুয়ানিয়া, ৮. সুরিনাম, ৯. রাশিয়া, ১০. দক্ষিণ আফ্রিকা। এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা দেশভেদে মাঝামাঝি পর্যায়ের।
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকেই সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও লকডাউন শুরু হয় বিশেষ করে কোভিড-১৯ নামের এক অতিমারির (pandemic) প্রকোপের জন্য। শহর-বন্দর, রাস্তাঘাট, গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার, দোকানপাট, অফিস-আদালত সবকিছুই জনশূন্য হয়ে পড়ে। আর এর ফলে দেখা দেয় নানা রকমের মানসিক সমস্যার প্রকোপ। এ সময় পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায়, দাম্পত্য কলহ বেড়ে যায়, হতাশা ও অবসাদগ্রস্ততা বৃদ্ধি পায়। এমনকি আত্মহত্যাও বেড়ে যায়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা আগের হিসাবের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক গবেষণা চলছে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে Biopsychosocial Model কাজ করে। অর্থাৎ আত্মহত্যার জন্য মূলত দায়ী তার biological (genetic) psychological I social factors-গুলোর সম্মিলিত প্রভাব। এ ক্ষেত্রে biological বা genetic factor বলতে এমন ৪টি জিনকে বোঝানো হয়, যারা আত্মহত্যার করার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। এসব জিন হলো APH1B, AGBL2, SP11O ও SUCLA2। যাদের মধ্যে এসব জিনের তীব্রতা বেশি, তারা সহজেই কম গুরুত্বপূর্ণ psychological I social factors দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আত্মহত্মা ঘটায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মধ্যে এই জিনগত প্রবণতা তেমন একটা নেই, তারা অতিপ্রতিকূল মানসিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতেও আত্মহত্যা করে। করোনাকালীন পারিবারিক দ্বন্দ্ব, অপউপযোজন এবং পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তারাই আত্মহত্যা করেছিল, যাদের মধ্যে এ বিশেষ ধরনের ৪টি জিনের তীব্র প্রবণতা আছে বা ছিল। অর্থাৎ দেখা যায়, যাদের দৈহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আত্মহত্যার জন্য দায়ী জিনগুলো কর্মরত থাকে, তাদের সঙ্গে যদি প্রতিকূল মানসিক বা সামাজিক অবস্থা কার্যকরী হয়, তাহলে সেসব ব্যক্তি সহজেই আত্মহত্যা করে।
এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই আত্মহত্যাকে প্রতিরোধ বা আংশিক প্রতিরোধ বা আপেক্ষিক প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়। আমাদের সমাজে এই আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে হলে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা নিম্নরূপ।

১. সামাজিকভাবে সবাইকে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে আত্মহত্যার লক্ষণগুলো সমাজে প্রচার করতে হবে, যাতে ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিলে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে পরিবারের সদস্য, কর্মস্থলের লোকজন এবং বন্ধুদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

২. আত্মহত্যাকারীদের প্রতি অনুকম্পা দেখানো হয়, এমন সব প্রচারণা, কর্মকা- ও মানসিকতা দূর করতে হবে। আত্মহত্যার কাজটি যে গর্হিত একটি কাজ, তা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।

৩. ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা পাপ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এ ক্ষেত্রে ধর্মের কথা বলে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে।

৪. বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন অনুযায়ী কাউন্সেলর (suicide preventing) নিয়োগ দিতে হবে। বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন এবং কয়েকটি ছোটগুলোতে একসঙ্গে একজন কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া যায়।

৫. উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এবং বড় শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক community counselor নিয়োগ দিয়ে সারা দেশকে এর নেটওয়ার্কের আওতায় আনা উচিত।

৬. সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচুর পরিমাণে পেশাগত কাউন্সেলর তৈরি ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

এভাবে দেশব্যাপী পেশাগত কাউন্সেলর নিয়োগ দিয়ে Mental Safety Net তৈরি করতে পারলে শুধু আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো নয় বরং ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো যাবে। ফলে এটা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

 

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Link copied!