জ্ঞানপিপাসু মানুষের নিত্যসঙ্গী বই। বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। সেই আলোর উৎসবই হচ্ছে ‘অমর একুশে বইমেলা’। তাই বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। সেই প্রাণের উৎসব শুরু হলো আজ। প্রতিবছরের মতো লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মিলনমেলা শুরু হয়ে গেল। বইমেলা আমাদের আবেগ-অনুভূতি ও অস্তিত্বের সংমিশ্রণে গড়া বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে এই উৎসব আলো ছড়াবে মানুষের হৃদয়ে। কেননা এবারের বইমেলায় থাকছে ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মোট ৯৩৭টি স্টল। প্রতিটি স্টলে থাকবে নতুন-পুরাতন অজস্র বই। যে বইগুলো পাঠকের মাঝে জ্ঞান ছড়াবে।
আমরা জানি, বইয়ের প্রচারের এবং বিক্রির বড় একটি উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে বইমেলা। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই বিদ্যমান। সারা বছর যে বই প্রকাশ হয় না, এমনটা নয়। তবে বেশির ভাগ বই প্রকাশ হয় বইমেলাকে ঘিরে। এ সময় তাড়াহুড়ার কারণে মানহীন বইও প্রকাশ হয়। এ ক্ষেত্রে লেখক-প্রকাশক উভয়েরই অবহেলা রয়েছে। লেখকরা সময়মতো পাণ্ডুলিপি দিতে পারেন না। আবার সময়মতো পাণ্ডুলিপি দিলেও প্রকাশকদের গাফিলতিতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সারা বছর বই প্রকাশ হলে পাণ্ডুলিপি বাছাই, সম্পাদনা ও অন্য কাজে ব্যাপক সময় পাওয়া যায়। সে হিসেবে বইয়ের মান ভালো হওয়ার সুযোগ থাকে। আশা রইল, এ বছর আমরা মানসম্পন্ন বই পাব।
তবে সবকিছুরই ভালো ও মন্দ দুটি দিকই থাকে। একুশে বইমেলা যেহেতু একটি উৎসব। সেই উৎসবে ভালো-মন্দ বিচার করা খুবই কঠিন। এখানে সবাই অংশগ্রহণের সুযোগ পান। সবাই ঘুরতে আসেন। ইচ্ছে হলে বই কেনেন। না হলে বই কিনবেন না। তবে এই এক মাস বইয়ের সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্ক মজবুত হয়। যা সাহিত্যচর্চায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। নবীন লেখকদের অনুপ্রাণিত করে। প্রবীণ লেখকের সম্মানিত করে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বইমেলায় তরুণদের অংশগ্রহণ বেশি থাকে। ফলে তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়। অনেক জনপ্রিয় তরুণ লেখকও বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে থাকেন। এক বইমেলায় যত বই প্রকাশ পায় এবং বিক্রি হয়, তা সারাবছরেও হয় না। আমি বরাবরই নেতিবাচক ধারণার বিরুদ্ধে। কিছু না হওয়ার চেয়ে কিছু হওয়া ভালো। সে হিসেবে বইমেলা তরুণদেরই বেশি উৎসাহিত করে। এক শামিয়ানার নিচে অনেক বই সংগ্রহের সুযোগ তৈরি হয়। অন্তত বই সংগ্রহের ক্ষেত্রে বইমেলা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যা তরুণদের অনেকটা সময় বাঁচিয়ে দেয়।
এ কথা সত্য যে একসময় বই প্রকাশের উপকরণ কিছুটা সহজলভ্য ছিল। এখন আর উপকরণ সহজলভ্য নেই। যে কেউ চাইলেই বই প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছেন না। তারপরও সব শিল্পেই শৌখিন কিছু লোক পাওয়া যায়। যারা লাভ-লসের হিসাব করেন না। কাজের মধ্যে আত্মতৃপ্তি খোঁজেন। বইয়ের পেছনে বিনিয়োগ করেন। তাই বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও ক্ষতির কারণ দেখি না। পাঠকই বেছে নেবেন, কোনটি তিনি গ্রহণ করবেন। আর কোনটি বর্জন করবেন। বই জোর করে গছিয়ে দেওয়ার বস্তু নয়। তবে বইয়ের মান বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলা যায়। সেটি অবশ্যই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত বইও বাজারে আসছে। খুঁজে নেওয়ার দায় ও দায়িত্ব পাঠকের। আমি তো মানহীন বই কিনি না। বইপ্রেমীদের অবশ্যই মান যাচাই করার বোধ-বুদ্ধি রয়েছে। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এটা লেখক-প্রকাশকের হাতেই থাক। দেশ, ব্যক্তি বা ধর্ম বিরোধী হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তো আছেই। নীতিমালা থাকলে কোনো লেখার মাধ্যমেই বিপ্লব বা পরিবর্তন সম্ভব নয়। অতীতেও যেটা হয়নি।
স্পষ্টভাবে বলা যায়—প্রতিবছরই বই বিক্রির হার বাড়ে বা কমে। কিন্তু কথা হচ্ছে—তাতে কারা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন? প্রকাশকরা নাকি লেখকরা? অবশ্যই প্রকাশকরা। লেখকের মধ্যে লাভের আশা বরাবরই কম থাকে। তারা প্রকাশের আনন্দ নিয়ে মাসজুড়ে দিব্যি বগল বাজিয়ে ঘুরে বেড়ান। এমনও অনেক নামকরা প্রকাশনী আছে; যারা বিক্রির শতকরা আট ভাগ লেখককে দিচ্ছেন। আর তাতেই লেখক খুশি। এ যাত্রায় বরাবরই নবীন লেখকরা বঞ্চিত হন। প্রতিষ্ঠিত লেখকরা হয় পাণ্ডুলিপি একেবারে বিক্রি করে দেন; নয়তো চুক্তিনামা করে রয়্যালিটি পেতে থাকেন। আবার কেউ কেউ নিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে বই প্রকাশ করে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, টেলিভিশন এবং রেডিওতে বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন। সব শ্রেণির মানুষই এখানে পাবেন। তাতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
এবার একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যেতে পারে। আমরা জেনেছি, গত বছর নতুন বই এসেছিল ৩ হাজার ৭৩০টি, যা আগের বছর ছিল ৩ হাজার ৪১৬টি। অর্থাৎ ৩১৪টি বই বেশি প্রকাশ হয়েছে গত বছর। তবে বিক্রির ক্ষেত্রে ছিল উল্টো চিত্র। ২০২৩ সালে মোট ৪৭ কোটি টাকার বই কিনেছেন ক্রেতারা। ২০২২ সালে এই অঙ্ক ছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছর বই বিক্রি কমেছিল। তার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এমনকি বিক্রি কমেছিল মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিরও। আগের বছরের চেয়ে ১০ লাখ টাকা কম বিক্রি হয়েছিল সংস্থাটির। ২০২২ সালে তাদের বিক্রি ছিল ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, ২০২৩ সালে তা হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ।
তবে এবার মেলার শুরু থেকেই কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল চালু হওয়ায় পাঠকের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে বইমেলার শুরু থেকেই নতুন নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মেতে উঠবেন তারা। শিশু-কিশোরদের মোহিত করবে নতুন বই। এই একটি মাসের জন্যই তো লেখক-পাঠকরা অপেক্ষা করে থাকেন। বই কেনা, আড্ডা, গল্প, হইচইয়ে মুখর হয়ে উঠবে বইমেলা প্রাঙ্গণ। এই বৃহৎ উৎসব এবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। লেখকে-পাঠকে পারস্পরিক ভাব বিনিময় হবে। প্রাণের এই উৎসব মানুষের মাঝে বইপড়ার আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে। সব রকমের আশঙ্কা নস্যাৎ করে দিয়ে সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে বইমেলা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি উপেক্ষা করেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। আশা রাখি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই বইমেলা অতীত গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখেই ইতি টানতে পারবে। বই কেনার পাশাপাশি লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারবে। মানসম্মত বই উপহার দিয়ে পাঠকসমাজকে উপকৃত করবে। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে আয়োজকরা সার্বজনীন মেলা উপহার দিতে পারবে।
যদিও বরাবরই বইমেলার প্রথমদিকে একটু ভাটা থাকে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকেই অমর একুশে বইমেলা জমে উঠবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শুধু তা-ই নয়, বইমেলা উপলক্ষে আরও নতুন নতুন বই প্রকাশ হবে। প্রয়োজনে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত নতুন বই আসবে। লেখক-পাঠকের সম্পর্কটা আরও গভীর হবে। আশা করবো, প্রকাশক-লেখক-পাঠকে মুখর হয়ে উঠুক বইমেলা প্রাঙ্গণ। বই আসুক নতুন ঘ্রাণ আর আবেগ নিয়ে। পাঠকের উপস্থিতিতে লেখক-প্রকাশক-আয়োজকদের মুখে হাসি ফুটুক। তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে তারা মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করুক। পরবর্তী বছরে আরেকটি সার্থক বইমেলার জন্য অপেক্ষা নিয়ে কাটুক আগামী দিনগুলো। জয়তু বইমেলা।
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক