• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ সংঘাতের পূর্বাপর


শিল্পী নাজনীন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩, ১২:০০ পিএম
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ সংঘাতের পূর্বাপর

গাজা উপত্যকায় সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শুরু থেকেই ইসরায়েলের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। প্রায় প্রতিদিনই ইসরাইলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছেন হিজবুল্লাহর সেনারা। ২০০৬ সালে ইসরায়েল-লেবানন দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে গত ১৭ বছর এই দুটি দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাটি তুলনামূলকভাবে শান্তই ছিল। যদিও ওই বছরই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ১৭০১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী শান্তির গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী লিতানি নদী থেকে অন্তত ২০ মাইল দূরে সরে যাওয়ার কথা ছিল হিজবুল্লাহর। প্রস্তাবে নিরস্ত্রীকরণের কথাও ছিল। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো ইরানের সহায়তায় একটি ভয়ঙ্কর অস্ত্রাগার গড়ে তুলেছে হিজবুল্লাহ। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের কাছে এক লাখের বেশি রকেট আছে। এসব রকেট ইসরায়েলের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন শহরে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে পারে।

গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ ও ইসরাইল পরস্পরের সীমান্তবর্তী লক্ষ্যস্থলগুলোতে পাল্টাপাল্টি হামলা চালাচ্ছে। ২০০৬ সালে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে হওয়া মাসব্যাপী যুদ্ধের পর থেকে এটিই দুপক্ষের মধ্যে শুরু হওয়া সবচেয়ে তীব্র হামলা। তবে এ হামলা মূলত দুই দেশের সীমান্ত এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

গত রোববার দিনের শুরুতে লেবানন সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি বসতি কিবুতজ লক্ষ্য করে একটি কামান-বিধ্বংসী মিসাইল ছুঁড়েছে হিজবুল্লাহ। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও সেখানকার একটি অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে আল জাজিরার খবর থেকে জানা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, হিজবুল্লাহর ছোঁড়া মিসাইলের আঘাতে কিবুতজের একটি অডিটোরিয়ামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই হামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন সরকার। তবে আইডিএফ বলেছে, উত্তর ইসরায়েলে হামলার পর দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর একটি ঘাঁটি লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে। কামানের গোলা ছুড়ে হিজবুল্লাহকে জবাব দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে আইডিএফ দাবি করেছে, হিজবুল্লাহর একটি মিসাইল সীমান্ত অতিক্রম করেছে, বাকিগুলো করেনি। ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর উপস্থিতি আর সহ্য করা হবে না, এমন হুমকি দিয়ে আসলেও তেল আবিব আদতে এই মুহূর্তে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে চাইছে না।

হিজবুল্লাহর অন্যতম মুখপাত্র হাজি মোহাম্মদ আফিফ বলেন, ‘আমরা এই যুদ্ধের অংশ হয়ে গেছি। হিজবুল্লাহ তার মোট শক্তির মাত্র পাঁচ শতাংশ ব্যবহার করছে। এমনকি হামাসও এখন পর্যন্ত তার পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করছে না। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানিয়ে যুদ্ধের বর্তমান গতির সঙ্গে আমরা তাল রেখে চলছি’।

ইসরায়েলে গেল ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যোদ্ধাদের সাঁড়াশি হামলার প্রশংসা করেছিলেন হিজবুল্লাহ প্রধান শেখ হাসান নাসরাল্লাহ। এরপর হামাস–ইসরায়েলের সংঘাতের পর থেকে প্রায়ই ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট হামলা চালাচ্ছে গোষ্ঠীটি।

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে হিজবুল্লাহ বেশ শক্তিশালী। ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে গত শতকের আশির দশকে হিজবুল্লাহ বাহিনী গড়ে তোলে ইরান। লেবাননে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বাহিনীর ওপর বিভিন্ন সময়ে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। লেবানন থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের কৃতিত্ব দাবি করে গোষ্ঠীটি।

দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর হাজার হাজার যোদ্ধা ও ক্ষেপণাস্ত্রের বড় ভাণ্ডার রয়েছে। লেবানন–ইসরায়েল সীমান্তে বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোয় ইসরায়েলের উপস্থিতির বিরোধিতা করে আসছে গোষ্ঠীটি। অন্যদিকে, হিজবুল্লাহকে নির্মূল করতে বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

গত ৭ অক্টোবর সকালে হামাসের হামলার খবর যখন প্রথম প্রকাশ হয়, ইতাই রুভেনি ও অন্য আপৎকালীন প্যারাট্রুপাররা তাদের ব্যাগ গুছিয়ে সেনাবাহিনী থেকে ডাক পড়ার আগেই জমায়েত স্থানে গিয়ে দক্ষিণে গাজা সীমান্তে না গিয়ে উত্তর দিকের সীমান্তে যান। তাদের বিশ্বাস ছিল, সেখানে হামাসের চেয়ে বড় হুমকি তেহরান-সমর্থিত লেবাননের শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছে। ৪০ বছর বয়সী ইতাই রুভেনি একজন মাস্টার সার্জেন্ট। বেসামরিক জীবনে সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন নিয়ে গবেষণারত রুভেনি বলেন, ‘দক্ষিণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন উত্তরে না ঘটতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে আমরা এখানে এসেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি, হিজবুল্লাহ (হামাসের চেয়ে) অনেক বেশি আধুনিক। আমরা বুঝতে পারছি, এই সীমান্তে কেবল তিন হাজার যোদ্ধাই আসবেন, এমনটা নয়। এই সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। তা ছাড়া এই সমীকরণে ইরানও থাকবে। তাদের মোকাবিলা করতেই আমরা এখানে এসেছি।’

ইসরায়েলের জন্য হিজবুল্লাহ বড় ধরনের বিপদ—এটা শুধু রুভেনিই দেখছেন না। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য কট্টরপন্থী সদস্য লেবাননের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার্থে নিজেরাই আগে আক্রমণ চালানোর পক্ষে।

এতে ওয়াশিংটনের শঙ্কা, সংঘাত আঞ্চলিক রূপ নিলে ইরানও জড়িয়ে পড়তে পারে। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন। তবে ইসরায়েলি রাজনীতিক, জেনারেল ও সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে এমন বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে লেবাননের সঙ্গে নতুন একটি যুদ্ধ অনিবার্য।

গাজায় বোমা হামলা শুরুর পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশের অংশ হিসেবে সীমান্তবর্তী ইসরায়েলি গ্রামগুলোতে রকেট হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। পাশাপাশি সীমান্তে ঝটিকা আক্রমণ করতে বিভিন্ন দল পাঠায় তারা। নভেম্বরের শেষ দিকে একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের ৫২ শতাংশ মানুষ অবিলম্বে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পক্ষে। অন্যদিকে মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ উত্তরাঞ্চলে নতুন একটি যুদ্ধ শুরুর বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

ইতাই রুভেনি ও রিজার্ভ প্যারাট্রুপাররা ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী লেবানন সীমান্তের ইসরায়েলি শহর রশ হানিকরায় দেখেন, ৭০৫৬ নম্বর প্যারাট্রুপার ব্যাটালিয়ন ইতিমধ্যেই ছোটখাটো সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। গাজাবাসীর সমর্থনে ইসরায়েলি সীমান্তবর্তী শহর ও গ্রামে হিজবুল্লাহ হামলা চালিয়েছে। অপর দিকে ইসরায়েলও পাল্টা কামানের গোলা ও বিমান হামলা চালিয়েছে লেবাননের সীমান্তে।

সম্প্রতি দুই পক্ষের লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও। পাল্টাপাল্টি হামলায় চারজন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। অপর দিকে ১৪ জন লেবাননের নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরায়েলের ড্রোন ও ট্যাংক হামলায় অন্তত তিনজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অরনা মিজরাহি বলেন, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে এবং এই প্রবণতা বাড়তির দিকে। তিনি বর্তমানে তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজে কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সংঘাত বৃদ্ধির এমন প্রবণতা সবচেয়ে দুশ্চিন্তার। কেউই পুরোমাত্রায় যুদ্ধ চায় না, কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা যেকোনো মুহূর্তে এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারি।’

মিডলইস্ট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনবিষয়ক পরিচালক রান্দা সিলিম বলেন, সীমান্তে হিজবুল্লাহর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’ নীতির মতো। এই মুহূর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধের সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করছে। কারণ হিজবুল্লাহ ও ইরান এই মুহূর্তে কোনো উত্তেজনা চায় না।

ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর উপস্থিতি সহ্য করার মনোভাব নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছে। লেবানন সীমান্তবর্তী ইসরায়েলের মেতুলা শহরের কাউন্সিলপ্রধান ডেভিড আজুলে বলেন, ৭ অক্টোবর ভোরে দুই হাজার মানুষ এটা জেনে ঘুম থেকে উঠেছেন যে তাদের সঙ্গেও এমনটা ঘটতে পারত।

ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল থেকে ৮০ হাজার নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পাশাপাশি গভীর হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দাও। তাই সামরিক সমাধানের বিষয়টি নিয়ে জোর আওয়াজ উঠেছে। ৬ ডিসেম্বর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোর মেয়রদের সঙ্গে বৈঠক করেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি হিজবুল্লাহকে সরে যেতে বাধ্য না করে, তাহলে এটি নিষ্পত্তি করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে ইসরায়েল। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গানৎসও উত্তরাঞ্চলের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের জন্য গত শুক্রবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্ব যদি হিজবুল্লাহকে সীমান্ত থেকে সরিয়ে না দেয়, তাহলে ইসরায়েল নিজেই তাদের সরিয়ে দেবে। এই সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। আরব দেশগুলোর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লেবানন-ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ নিরসনে একটি সমঝোতার প্রস্তাব করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত অ্যামোস হোস্টেইন। বৈরুতের সরকার সংকটে রয়েছে। এ কারণে চুক্তি করার মতো অবস্থায় নেই তারা, বাস্তবায়ন তো দূরে থাক। দেশটিতে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেখানকার ক্ষমতায়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দেশটির অর্থনীতি ভঙ্গুর। ফলে সমঝোতার আশু সম্ভাবনা নেই। তবে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান সীমান্ত সংঘাত উভয়পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর এবং তাতে প্রাণহানী ক্রমাগত বাড়ছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে যত দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে ততই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হয়।

লেখক : কথাশিল্পী ও শিক্ষক

Link copied!