বিশ্বকাপের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ার সুযোগ এবার এখনো হয়নি। কিন্তু পাশের বাড়ির বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বাতাস কিছুটা গায়ে লাগছে। সেটা নানাভাবে। টেলিভিশনে খেলা দেখে। পত্রিকা পড়ে। এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সৌজন্যে। তা ছাড়া আগে টুকটাক বিশ্বকাপ কাভার করার অভিজ্ঞতাও কিছুটা আছে। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল নিয়ে সাধারণ মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাসের প্রতি সম্মান রেখেই লিখছি, এ দেশের মানুষ ক্রিকেটকে আবেগ দিয়েই দেখে! বাস্তবতার বাইশ গজ থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে! তাই আমাদের স্বপ্নের দিগন্তে উঁকি দেয়—সেমিফাইনালে বাংলাদেশ! ধর্মশালায় নিজেদের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়ার পর অনেকের লেখা এবং বলায় মনে হয়েছে, সেমিফাইনালের পথে হাঁটতে শুরু করেছে বাংলাদেশ! ধর্মশালার পাহাড়-পর্বত দেখার পর বোঝা উচিত ছিল সেমিফাইনালের পথটা স্বপ্নের মতো এত মসৃণ নয়। মনে রাখা উচিত ক্রিকেটীয় ধর্মকে। ক্রিকেট যা দেয়, তার কিছুটা কেড়েও নেয়। বাংলাদেশের কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিতে ক্রিকেট-ঈশ্বর খুব বেশি সময় নেয়নি। পরের ম্যাচে সেই ধর্মশালায় রীতিমতো বিধ্বস্ত হলো ইংল্যান্ডের কাছে। ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে হার! সেই হারের ধাক্কা কতটা সামলে উঠতে পেরেছে, তা নিয়ে সংশয় থাকছে। ইংলিশদের কাছে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার পরই নিউজিল্যান্ডের সামনে বাংলাদেশ। যে নিউজিল্যান্ড নিয়মিত অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনকে ছাড়াই দারুণ ক্রিকেট খেলছে।
বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচটা চেন্নাইয়ের চিপকে। যেখানে বাংলাদেশের একটামাত্র ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। তা-ও পঁচিশ বছর আগে ভারতের বিপক্ষে। তুলনামূলকভাবে চিপকের বাইশ গজে কিইউদের কাছে অনেক চেনা। অবশ্য ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে চিপকের উইকেট যে আচরণ করেছে, তাতে মনে হয় এ ম্যাচ বাংলাদেশ ব্যাটার ও স্পিনারদের বড় পরীক্ষা নেবে। বাংলাদেশ দলে বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুলের মতো ব্যাটার কোথায় যারা খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তুলতে পারবেন! অবশ্য তার আগে প্রশ্ন, বাংলাদেশ খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াবে বলছি কীভাবে! বলছি, কারণ ইংলিশদের বিপক্ষে বাংলাদেশ তো দাঁড়াতেই পারল না!
আধুনিক ক্রিকেট অনেক আক্রমণাত্মক এবং ব্যাটিংমুখী হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রিকেট অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক গেম। সেটা সর্বকালীন। সেখানে বাংলাদেশের মনস্তাত্ত্বিক মডেলটা কী, তা জানি না। তবে এই দলে মানসিকভাবে শক্ত এবং অভিজ্ঞতা থেকে নির্ভার থেকে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা প্লেয়ার একজনই। তিনি সাকিব আল হাসান। তাকে বলা যেতে পারে বিরাট কোহলির বংশধর! মানসিকতার দিক থেকে তিনি তাই। যে ফর্মুলায় লাভবান হওয়া যাবে, তাতে ঠিকঠাক মতো মন দেন তিনি। অতীত ঝুঁকে দেখতে চান না। আবার ভবিষ্যতের জ্যোতিষচর্চায়ও মন দেন না। বর্তমানই যেখানে চ্যালেঞ্জিং, সেখানে অতীতের মালপত্র বইবেন কেন? আবার ভবিষ্যতে আচ্ছন্ন থাকাও অর্থহীন। এটা অনেকটা ডেল কার্নেগির থিওরি।
কিন্তু ক্রিকেটে মনোবিজ্ঞানেরও কিছু থিওরি আছে। আধুনিক ক্রিকেটে যা অনেক বেশি ফলো করা হয় খারাপ সময়ে। ভিভ রিচার্ডস, শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরামও মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হয়েছেন ক্রিকেট নিয়ে। সেটা নিজেদের প্রয়োজনে। মনোবিদদের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সেশন থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তার মর্মার্থ হচ্ছে, নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে নিজের সেরা পারফরম্যান্সের কথাই ভাব। নিজেকে নিজে বলতে হবে, ‘আগে যখন পেরেছি এখন কেন পারব না!’
বাংলাদেশ টিমে কোচ হাথুরুসিংহে অনেক সাপোর্ট স্টাফ নিয়েছেন। কিন্তু তার চাহিদাপত্রে কোনো মনোবিদের নাম শোনা যায়নি। তেমন কেউ থাকলে তিনি সাকিবদের নিউজিল্যান্ড ম্যাচের আগে কী বলতেন জানি না। তবে মনোবিদদের শরণাপন্ন হওয়া ক্রিকেটাদের কাছ থেকে শোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, হয়তো বলতেন, ‘সাকিব নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের এবং দলের সাফল্যের ভিডিওগুলো বারবার দেখো। মনকে বলো অতীতে পারলে এবার কেন নয়। তাতে মানসিক চাপ অনেকটা কেটে যাবে।’
হ্যাঁ, ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০১৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডকে বাংলাদেশ হারিয়েছিল একেবারে খাদের কিনার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে। কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের ২৬৫ রান তাড়া করতে গিয়ে ৩০ রানে ৪ উইকেট হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর সাকিব আর মাহমুদউল্লাহর রূপকথার সেই ২২৪ রানের পার্টনারশিপ। যার ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছিল বাংলাদেশ ৫ উইকেটে। ট্রেন্ট বোল্টকে কাভার দিয়ে পরপর দুই বাউন্ডারি মারার পর ১১৪ রানে বোল্ড হয়ে যান সাকিব। অন্য প্রান্তে অবিচল থাকেন মাহমুদউল্লাহ। ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। আইসিসির টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটারকে দল রাখা না রাখা নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছে! কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকে ২০১৫ বা ২০১৭-তে ফিরে গেলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই মাহমুদউল্লাহ, যিনি বাংলাদেশকে টেনেছিলেন ব্যাট হাতে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি একাদশে সুযোগ পাবেন কি না, বলা যাচ্ছে না। চিপকের উইকেট স্পিন-সহায়ক। অতএব একজন বাড়তি স্পিনার নাও দলে! এই থিওরিতে একাদশের বাইরে রাখা হতে পারে মাহমুদউল্লাহকে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ও রকমভাবে হারার পর দলের ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করতে বিসিবি সভাপতির ভোকাল টনিক বা হাথুরুসিংহে স্বপ্নবিলাসী মনের সেমিফাইনালে খেলার কথা আদৌ কোনো কাজে দেবে বলে মনে হয় না। ওগুলো শোনার চেয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অতীতের সাফল্যের কথাই বেশি মনে করা উচিত সাকিবদের। সেমিফাইনালের কথা না ভেবে প্রতিটি ম্যাচে আলাদাভাবে ফোকাস করা উচিত তাদের। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কঠিন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের। এখানেই তাদের মানসিকতার আসল পরীক্ষা।