বিশ্বের যেকোনো দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা-যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রধান বলি হয় নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নিগ্রহ আজ অবধি চলে আসছে। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের অন্যতম শিকার করে তোলা হয় নারীকেই। তবে এবার ভারতের মণিপুরে যে ঘটনা ঘটেছে, তা এতটাই রুঢ় ও নিষ্ঠুর, যা মানব জাতির বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মণিপুরে একের পর এক নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত কয়েকমাস ধরেই গোটা মণিপুর রাজ্যে সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠী হিংসা চরমে পৌঁছেছে। তবে, এবার এই হিংসার পথ ধরেই সামনে এসেছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা। যার সাক্ষী হয়েছে ইতোমধ্যে গোটা বিশ্ব।
বর্তমানে মানবজাতি কোন সমাজে বাস করছে? যে সমাজ দিনে দিনে চরমভাবে নারীর প্রতি হিংস্র হয়ে উঠছে। যে সমাজে নারীকে মূল্যায়ন করা হয় না। নারীর সম্ভ্রম লুটে প্রতিশোধের আগুন নেভানো হয়। এমন হীন সমাজ কীভাবে মানবের বসতি হতে পারে? সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠী হিংসার আগুনে পুড়ছে গোটা মণিপুর। দুইজন নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয়েছে। এমনকি ওই নারীদের বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে।
নির্যাতনের ভিডিও সামনে আসার পরই গোটা ভারতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু এত ঘৃণ্য ও পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে দুই মাসেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু এতদিন এ বিষয়টি ধামাচাপাই ছিল। গত ২১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেছে, তা ৪ মে ধারণ করা। আগের দিনই হিন্দু মেইতি ও খ্রিষ্টান কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর। ভিডিওটিতে দেখা যায়, দুই মণিপুরি নারীকে বিবস্ত্র করে এক দল উত্তেজিত জনতা রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে একটি মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। সেই মাঠে ওই দুই নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়।
এতদিন পর ওই পুরোনো ভিডিও কী করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো, কারা তা করলো, কোন উদ্দেশ্যে—তা দ্রুত আলোচনায় উঠে আসে। বুধবার রাতেই দেশটির কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় তৎপর হয়ে ওঠে এ বিষয়ে। সামাজিক মাধ্যম কেন ওই ভিডিও বন্ধে উদ্যোগী হলো না, সেই প্রশ্ন আলোচিত হতে থাকে। কিন্তু মণিপুরী নারীদের প্রতি যে নির্যাতন হয়েছে সে বিষয়ে তখন পর্যন্ত কেউ মুখ খোলেনি। বরং ভিডিও ছড়িয়ে পড়া নিয়েই তাদের আপত্তি দেখা যায়।
মণিপুর বরাবরই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এবারের ঘটনা এতটাই ন্যক্কারজনক যে, গোটা মানব সমাজকে তা নাড়া দিয়েছে। গোষ্ঠী হিংসার জেরে নারীর প্রতি এতটা রুঢ় আচরণ কোন সমাজের ইঙ্গিত দেয়? জাতীয় রাজনীতিতে ঝড়, সোশ্যাল মিডিয়ায় উপচেপড়া প্রতিবাদ, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি, সুপ্রিম কোর্টের কঠোর বার্তা সবই ভিডিও প্রকাশের পরের ঘটনা। কিন্তু মণিপুরে দিনের পর দিন এভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া নিয়ে তেমন তোড়জোড় আগে দেখা যায়নি। যা ভিডিও প্রকাশের পরে ঘটেছে। কিন্তু এ ক্ষত কি শুকানোর? এত সহজে কি তা সত্যি যাবে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এ বীরেন সিংহ বলেছেন, ‘ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। অপরাধীদের যাতে মৃত্যুদণ্ড হয় তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মণিপুর দুই নারীকে নির্যাতনের অভিযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘অপরাধীদের খুঁজে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না।’ পরবর্তীকালে ঘটনার মূল অভিযুক্তকে পাকড়াও করেছে মণিপুর পুলিশ। ভিডিও দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়। তবে বাকিদের গ্রেপ্তার করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা মণিপুর রাজ্যে নারীর প্রতি যে ধরনের বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে তা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে।
শুধু তাই নয় মণিপুরে দুই নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসলেও প্রশ্ন থেকে যায় সত্যিই কি এই দুই নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে নাকি আরও কোনো নারী পাশবিকতার শিকার? ঘটনার উপর্যুপরি বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। ১৪০ কোটি জনগণের দেশে এমন একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে ২ মাসের বেশ আগে তবু ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পূর্বে তা সবার অজানাই ছিল। এতদিন পরে হলেও যেহেতু নারীর প্রতি এমন রুঢ়-কদর্য ও বিকৃত অত্যাচার হয়েছে তার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া দেশটির সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্যকে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশও দিয়েছেন। তবে তা শুধু আদেশ প্রদানের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে।
শুধু দুই নারীর প্রতি নির্যাতন করেই থামেনি মণিপুরের জাতিগত সহিংসতা। এবার মণিপুরে এক স্বাধীনতাসংগ্রামীর স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থল রাজ্যের কাকচিং জেলার সেরু গ্রাম। সেরু থানায় হওয়া মামলার অভিযোগ অনুসারে, ৮০ বছর বয়সী এক নারীকে তার ঘরে তালাবদ্ধ করা হয়। পরে ঘরে আগুন দেয় একটি সশস্ত্র দল।
ঘটনাটি ঘটে গত ২৮ মে। তখন সেরুর মতো স্থানগুলোয় ব্যাপক সহিংসতা ও গুলিবিনিময় হয়েছিল। সহিংসতার আগে সেরু ছিল সুন্দর একটি গ্রাম। গ্রামটির অবস্থান রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে। এনডিটিভি দেখেছে, এখন গ্রামটিতে রয়েছে শুধু পোড়াবাড়ি ও দেয়ালজুড়ে বুলেটের গর্তের চিহ্ন। উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যে গত মে মাস থেকে উপত্যকায় বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মেইতি ও পাহাড়ে বসবাসকারী সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সহিংসতা চলছে। মেইতিদের তফসিলি উপজাতির মর্যাদার দাবিকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতার সূত্রপাত। সহিংসতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর একটি সেরু।
২৮ মে ওই নারী আগুনে জীবন্ত পুড়ে মারা যায়। তার নাম ইবেতোম্বি। তাঁর স্বামীর নাম এস চুরাচাঁদ সিং। তিনি ৮০ বছর বয়সে মারা যান। তিনি একজন স্বাধীনতাসংগ্রামী ছিলেন। তাঁকে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম সম্মাননা দিয়েছিলেন। দুই নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটিয়ে নিয়ে তৎপরবর্তীকালে গণধর্ষণ এবং ৮০ বছর বয়সী স্বাধীনতাসংগ্রামীর স্ত্রী ইবেতোম্বির মৃত্যু জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দেশটির রাজ্য সরকার, প্রশাসন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এখনই নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নতুবা এমন ভয়াবহ ও রুঢ়তার শিকার হওয়া থেকে নারীদের রক্ষা করা দায়!
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।