• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে পাড়াকেন্দ্র মডেল


ঞ্যোহ্লা মং
প্রকাশিত: মে ৭, ২০২৩, ০৩:৩৯ পিএম
স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে পাড়াকেন্দ্র মডেল

পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সুন্দর দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রকল্প আছে। প্রকল্পটির একটি লম্বা নাম থাকলেও সবাই ‘পাড়াকেন্দ্র’ নামেই চেনে। যত দূর জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিসেফের উদ্যোগে ১৯৮২-৮৫ সালে একটি যৌথ গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণা ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইউনিসেফ সাহায্যপুষ্ট সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে এর কার্যক্রম শুরু হয় (১৯৮৫-৯৫)। কার্যক্রমটির ধারাবাহিকতায় কয়েক ধাপে নাম পরিবর্তিত হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯১-২০১১, তৃতীয় মেয়াদে ২০১১-২০১৮ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমানে ‘টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প’ নামে ২০১৮-২০২৩ মেয়াদে কার্যক্রমটি চলমান রয়েছে।

পাহাড় সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে পাড়াকেন্দ্র নতুন কিছু নয়। পাহাড়ে চলমান একটি বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে পাড়াকেন্দ্র সর্বজনবিদিত। পার্বত্য চুক্তির আগেপরে অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। যেগুলোর সেবার মান, দৃশ্যমান পরিবর্তন, কর্মীদের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে নানাজনের নানা প্রশ্ন থাকলেও, খুব সম্ভবত পাড়াকেন্দ্র নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। পাড়াকেন্দ্র নিয়ে রাগঢাক, অভাব-অভিযোগও খুব একটা শোনা যায় না বললেই চলে।

প্রকল্পটি পাহাড়ের মা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে। পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে শূন্য থেকে ৮ বছরের শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন উপযোগী করে তোলে। শিশুর জীবনরক্ষাকারী আচরণে অভ্যস্ত করার পাশাপাশি কিশোর, গর্ভবতী ও প্রসুতিকে নিরাপদ ও সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চিত করতে পাড়াকর্মী নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকে।

বর্তমানে পাড়াকেন্দ্র পাড়ার মৌলিক তথ্য সংরক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নতুন কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য পেতে পাড়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয় না। পাড়াকেন্দ্রেই সব তথ্য মিলছে। মোটামুটি পাড়াকেন্দ্র একটি পাড়ার মোট ২৮ ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে। এছাড়া পাড়াকেন্দ্রটি টিকা দান কেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদে শিশুর জন্ম নিবন্ধনে সহায়ক কেন্দ্র ইত্যাদি হিসেবেও কাজ করছে।

পাহাড়ে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোও পাড়াকেন্দ্রকে তাদের নানা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছে। পাড়ায় একত্রে বসার প্রয়োজনে নতুন কোনো জায়গা খুঁজতে হয় না। পাহাড়ের শিশুরা উন্নত বিশ্বের ন্যায় না হলেও পাড়ায় বসে খেলতে খেলতে অক্ষরগুলো, ফলমূলের নামগুলো শিখে ফেলছে। কেন্দ্রগুলো সকাল সকাল খুলে যায় বলে, গ্রামের নারীটি তার শিশুকে পাড়াকেন্দ্রে রেখে কিছু কাজ করে নিতে পারছে। শিশুটি খেলতে খেলতে তার অজান্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযুক্ত হয়ে, কয়েকটি পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলেমিশে পড়ালেখা করার মনোবল, সাহস, শক্তি অর্জন করছে।

একটি পাড়াকেন্দ্রে আসা এলাকাবাসী

ছেলেমেয়েরা আনন্দে শিখছে দেখে অনেক অনেক পাড়ার পাড়াকেন্দ্রকে গ্রামবাসীরা ফুলের বাগান দিয়ে সাজিয়ে, শিশুদের একটি আর্দশ খেলার স্থান, শেখার স্থানে পরিণত করেছে। উন্নয়নকর্মী আর পর্যটকদের জন্যও পাড়াকেন্দ্র এখন ছবি তোলার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

সাবেক চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ের ৪০০০তম পাড়া কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। বর্তমানে পাড়াকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে ৪৮০০টি রয়েছে।

পাড়ার শিশু, কিশোর, গর্ভবতী মা কেন্দ্র থেকে শেখার, জানার সুযোগ পায়। সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য সংস্থাও সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। এবং প্রয়োজনে কেন্দ্রটি সকলে ব্যবহার করতে পারলেও প্রতিবার প্রকল্পের মেয়াদ শেষে পাড়াকর্মীসহ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে চিন্তিত হতে দেখা যায়।

অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় হলেও প্রকল্পটিকে উন্নয়ন বোর্ড স্থায়ী করতে পারেননি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বড় সুনাম এই পাড়াকেন্দ্র। পাড়াকেন্দ্রের সুনামের কারণে উন্নয়ন বোর্ড আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন বলেও জেনেছি। তারপরও উন্নয়ন বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির স্থায়ী রূপ দেওয়ার চিন্তা করতে পারেননি।

প্রকল্পে রাস্তাঘাট, দালানকোঠা নিমার্ণ, বড় অঙ্কের কেনাকাটা, টেন্ডার ইত্যাদি আকর্ষণীয় কার্যক্রম নেই বলে তথাকথিত উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদেরও খুব একটা আগ্রহী করে না। পাহাড় দিন দিন ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। পানিয় জলের সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন মা ও শিশুরা। মা ও শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা পাড়াকেন্দ্রটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কথা থাকলেও তা হয়ে উঠেনি। আমরা উন্নয়নকর্মীরাও নিজেদের প্রয়োজনে পাড়াকেন্দ্রটি ব্যবহার ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করলেও প্রকল্পটিকে নিয়ে প্রশংসা করতে পারিনি। পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ইউনিয়ন পরিষদসমূহের কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেও প্রকল্পটির গুরুত্ব নিয়ে নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করানো যায়নি।

প্রকল্পটি শুধু মা-শিশুদের শেখার কেন্দ্র নয়, উন্নয়নকর্মী, গবেষকদেরও শেখার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যত দূর জানা যায়, প্রকল্পটি নিয়ে গবেষণা করে ইতিমধ্যে একাধিকজন পিএইচডি ডিগ্রিও লাভ করেছেন। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, যে প্রকল্প নিয়ে প্রশংসা আছে, পুরস্কারপ্রাপ্তির গল্প আছে, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির রেকর্ড আছে, সে প্রকল্পকে কেন স্থায়ী রূপ দেওয়া হবে না?

প্রকল্পকে ঘিরে ইতিমধ্যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। শুধু পাড়াকর্মীদের হিসাবে আনলে ৯৫ ভাগই সংশ্লিষ্ট পাড়ার নারী। যারা সামান্য সম্মানীতে গ্রামকে সেবা দিচ্ছেন, সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরলস সহযোগিতা করে চলেছেন।

আমাদের জানাশোনা কত প্রকল্পই তো ঢাকঢোল পিটিয়ে হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়। অনেক প্রকল্প রাজস্ব খাতে উন্নীত হয়। তবে কেন এই ৪৮০০ জন গ্রামীণ নারী কর্মীকে স্থায়ী রূপ দিয়ে নারী, শিশুশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রকল্পটিকে সরকারীকরণ করা হবে না।

অনেকের মতে, প্রকল্পটি শুধু পাহাড়ে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের সব পাড়া, গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। শিশুদের জন্য গ্রামে গ্রামে খেলার ছলে শেখার কেন্দ্র থাকা উচিত। পাড়া কেন্দ্রের মধ্যে ১০টি কেন্দ্রকে মডেল পাড়া হিসেবে না রেখে সব পাড়া কেন্দ্রকে মডেল পাড়াতে রূপান্তরে কাজ করা উচিত। প্রতিটি পাড়াকে মডেল করতে পাড়া কেন্দ্র হতে পারে একটি প্রধান ও সহজতর পন্থা।

সরকারের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর ক্ষেত্রে নানা বাধা বিদ্যমান। একটি শ্রেণিকক্ষে তিন চার ভাষাভাষির শিশু থাকে। সেখানে একজন শিক্ষক কতটি ভাষায় পড়াবেন? এমন সমস্যা সমাধানে চলমান পাড়াকেন্দ্র বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। কেননা, একটি পাড়াতে সাধারণত এক ভাষাগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীই বেশি থাকে। সে ক্ষেত্রে মাতৃভাষার হাতেখড়ি দিতে পারেন পাড়াকর্মী।

সরকার ‘ডিজিটাল’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপান্তরে কাজ করছেন। গ্রামনির্ভর বাংলাদেশকে স্মার্ট করতে হলেও পাড়াকেন্দ্র তার একটি মডেল হিসেবে গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাহাড়ে এখনো অনেক পাড়া রয়েছে যেখানে পাড়াকেন্দ্র নেই। পাড়াকেন্দ্র ছাড়া পাড়া এখনো হাজার খানেক থাকবে বলে অনেকের ধারণা। পাহাড়ে অনেক শিশুর জন্য পাড়াকেন্দ্রই এক ও একমাত্র স্কুল। আশপাশে আর কোনো স্কুল না থাকলে তাদের শেষ ভরসা পাড়াকেন্দ্র। এমন সব দুর্গম এলাকার পাড়াগুলোকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরণের সুযোগ আছে। ৫-৬ কিলোমিটার দূরে প্রাথমিক বিদ্যালয় হলে অনেক অভিভাবকের পক্ষে সন্তানকে একা ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাড়াকেন্দ্রে পড়ার সুযোগ পেলে শিশুটি দূরবর্তী গ্রামে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সাহস ও যাওয়া-আসা করার মনোবল অর্জন করবে।

এছাড়া প্রকল্পের অধীনে ৪টি আবাসিক বিদ্যালয় চালু রয়েছে। বান্দরবান সদর সূয়ালক ইউনিয়নে আবাসিক বিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হলো, শুধু পিছিয়ে পড়া দুই জনগোষ্ঠী ম্রো ও খুমী শিশুদের আবাসিক সুবিধা দিয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়া।

শিশুকে নিয়মিত টিকা দিচ্ছে কিনা, গর্ভবতী মা নিয়মিত চেকআপ করছে কি না, শালদুধ খাওয়ানো হচ্ছে কি না, জন্মনিবন্ধন করল কি না, এমন নিবিড় তদারকি তো একমাত্র পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মীই করতে পারেন। যেটি কোনভাবে কমিউনিটি ক্লিনিক দ্বারা সম্ভব নয়।

সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে গিয়ে প্রশংসা করছেন, শিখছেন। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ নিমার্ণে পাড়াকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল। পাহাড়ের পাড়াকেন্দ্রটি শুধু পাহাড়ে সীমাবদ্ধ না রেখে, সারা দেশে এই মডেলটি ছড়িয়ে দেওয়া হোক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই মডেলটি অন্য অনেক দেশের জন্যও একটি অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠতে পারে।

 

লেখক: কলামিস্ট

Link copied!