• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কালাই রুটিও বৈষম্যের বাইরে নয়


ঞ্যোহ্লা মং
প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৩, ০৭:০৪ পিএম
কালাই রুটিও বৈষম্যের বাইরে নয়

সমাজে উঁচু-নিচু শুধু অর্থনীতির বিচারে করা হয় না, অঞ্চলভেদে কিছু খাবারকে হেয় করার মাধ্যমেও মানুষের মাঝে ভেদাভেদ করা হয়, হেয় করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নারীদের ‘ওয়াও’(WOW) উৎসব, অর্থাৎ উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছি। উৎসবকে ঘিরে ছিমছাম একটি মেলারও আয়োজন ছিল। ঢাকা শহরে ফুটপাতের খাবার এড়িয়ে চলি। কিন্তু মেলায় খাবারের মান ও পরিবেশ দেখে পরপর দুদিন নানা খাবার খেতে গিয়েছি।

মেলার মাঝখানে একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অন্যদিকে সমাজে নারী পুরুষ ভেদে বৈষম্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলতে দেখেছি। দীর্ঘদিন এনজিওতে কাজ করার সুবাদে সমাজে জেন্ডার সম্পর্কিত আলোচনাগুলো নতুন কিছু ছিল না। রাজশাহীর থেকে অংশগ্রহণকারী একমাত্র কালাই রুটির দোকানটির সামনে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো মনের আনন্দে কালাই রুটি খাচ্ছিলাম আর সমাজে একজন নারীর চলাফেরা, পোষাক, কথা বলা থেকে সবকিছুতে সমাজে এক ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুনছিলাম।

কালাই রুটি খেতে খেতে ভাবছিলাম, সমাজে শুধু নারীরা কেন, আমাদের খাবার-দাবার নিয়েও তো আমরা একে অন্যকে হেয় করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬ বছর কাটিয়েছি, কিন্তু কোনদিন কালাই রুটি খাওয়ার সুযোগ পাইনি। কোনো হলে, কোনো খাবারের আয়োজনে কালাই রুটি পরিবেশন হতে দেখিনি। সারা ক্যাম্পাসে কতশত দোকান, কোথাও কালাই রুটি বিক্রি হতে দেখিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কালাই রুটি দেখার এবং খাওয়ার অভিজ্ঞতা হওয়ার পরিবর্তে চাপাইনবাবগঞ্জের ছাত্রছাত্রীদেরকে ‘কালাই’ বলে ক্ষেপাতে দেখেছি। ক্যাম্পাসে কালাই রুটি নিয়ে এমন নেতিবাচক মনোভাবের কারণে চাপাইনবাবগঞ্জের রুমমেট পাওয়ার পরও তারা কালাই রুটি খেতে আমাকে কোথাও নিয়ে যায়নি। এখন ধারণা করছি, ক্যাম্পাসে তাদেরকে ‘কালাই’, ‘কালাই রুটি’ বলে ক্ষেপানো হয় বলে, হয়তো সচেতনভাবে তারা বন্ধু ও সহপাঠীদের এড়িয়ে চলতেন।

ক্যাম্পাসগুলোতে শুধু খাবার নিয়ে নয়, ‘কুলু-পিলু’ বলেও মাস্টার্স করতে আসা শিক্ষার্থীদের বিব্রত করতে দেখেছি। আর শিক্ষার্থী যদি আদিবাসী হয়ে থাকেন, তাকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন তোমরা নাকি ব্যাঙ খাও? তোমরা নাকি কাঁচা খাও? তোমরা কি মরা মানুষ খাও? তোমাদের ঘরবাড়ি কি জঙ্গলে? তোমাদের মেয়েরা সুন্দরী হয় কেন? তোমরা সাপ খাও? ইত্যাদি।

ক্যাম্পাসে নানা জেলার মানুষগুলোকে নানাভাবে চিহ্নিত করার চল আছে। বেশি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হয় এমন এলাকার ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের অবস্থা বুঝে চলাফেরা, বন্ধুত্ব তৈরি করে থাকেন। এক অঞ্চলের ছাত্রছাত্রী অন্য অঞ্চলের ছেলেমেয়েকে নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করার ফলে জেলাভিত্তিক গ্রুপিং তৈরি হতে দেখা যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে গিয়েও একজন ছাত্র ‘বিশ্ব’ হওয়ার বদলে, আক্ষরিক অর্থে নির্দিষ্ট জেলার ছাত্রছাত্রীতে রূপ পায়। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে গেলে প্রায় প্রত্যেকটি জেলার সমিতি’র উপস্থিতি দেখা মিলবে। তাদের ওঠাবসা, সমস্যা নিয়ে আলোচনা, দৃষ্টিভঙ্গি সবই জেলার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সমিতি ভিত্তিক বিভিন্ন সভায়, অতিথিও করা হয় নিজেদের জেলার শিক্ষককে।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদেরকে জেলা ছাড়িয়ে বিশ্ব নাগরিকের প্রতিনিধি হতে উদ্বুদ্ধ করে না। প্রতি বছর হলভিত্তিক একদিন ভালো খাবারের প্রথার প্রচলন আছে। এই খাবার নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতি, মারামারিও নতুন কিছু নয়। ছাত্রদের মাঝে অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে, বিভিন্ন জেলার খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে খাবারের বিশেষত্ব, গুণগুলোকে নিয়ে আলোচনা হতে দেখা যায় না।

বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওপেন ডে, ফার্স্ট ডে, ইউনিভার্সিটি ডে উদযাপন করে থাকে। উক্ত দিনগুলোতে দেশি-বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা স্ব-স্ব দেশের প্রতিনিধি হয়ে জনপ্রিয় খাবার, ছবি, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে স্টলগুলো সাজিয়ে তোলেন। ছাত্ররা এই দিনে ভালো কাজে ব্যয়ের লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি, নিজের দেশকে অন্যদের সামনে তুলে ধরেন।

আমাদের দেশে বিদেশী ছাত্রছাত্রী কম। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে সাধারণ ছাত্রদের দিয়ে নানান জেলার খাবার, সংস্কৃতি উপস্থাপনের আয়োজন করতে পারি। আমরা একে অপরকে না জানার ফলে প্রচলিত ‘ক্ষেপাটে সংস্কৃতি’র সাথে নিজেকে মিলিয়ে, নিজ দেশের সংস্কৃতিকে অজানা রেখে, নিজেকে অন্য জেলাবাসীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। সে অর্থে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েও নিজ জেলার গণ্ডি পেরুতে পারি না। উল্টো বিশ্ব নাগরিক হতে গিয়ে নিজ দেশের মানুষের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে হেয় করতে শিখি, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বের হয়ে আসি।

স্বীকার করি কিংবা না করি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অঞ্চলভেদে আমাদের গোপন দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এমন দ্বন্দ্ব নিরসনে সকল শিক্ষার্থীকে একই প্লাটফর্মে আনতে, বিশ্ববিদ্যালয় তার বিভিন্ন বিভাগের উদ্যোগে জেলাভিত্তিক স্টল সাজিয়ে সংস্কৃতিক উৎসব করতে পারে। সেখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাবার, পোষাক নিয়ে লেখালেখি, প্রকাশনা, গবেষণা, প্রদর্শনীর আয়োজন ইত্যাদি থাকতে পারে।

একটি জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার কালাই রুটিকে কেন্দ্র করে এলাকার শিক্ষার্থীদেরকে হেয় করা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের উচিত কিনা ভেবে দেখা দরকার। আর যারা সহপাঠীকে খাবার নিয়ে ব্যঙ্গ করতে পারেন, সমাজে তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারেন। ফেসবুকের ন্যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায় নারীকে নিয়ে কটুক্তি করা হচ্ছে। সেগুলোকে মজার ছলে হলেও অনেকে লাইক দিয়ে ফেলি। ভুলেও চিন্তা করি না, লাইক দেওয়ার মাধ্যমে আরেকজনকে হেয় করা হচ্ছে।

একজন ছাত্র  কী চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাস, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতির প্রতি কেমন ধারণা নিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রী সম্পন্ন করবেন তাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিন্তা করতে হবে। শুধু সিলেবাস শেষ করা, পরীক্ষার খাতা দেখে মানদণ্ড ঠিক করা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের যদি নিজের দেশের বৈচিত্র সম্পর্কে ধারণা না থাকে এবং বৈচিত্র ধারণ করার সক্ষমতা তৈরি না হয়, তাহলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তার আর কি গুণ থাকে? ছাত্রকে হতে হবে চিন্তা চেতনায় আধুনিক, সমাজ সচেতন, নারী বান্ধব, সমাজ সংস্কৃতি আর পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম একজন সুনাগরিক।

 

লেখক: কলামিস্ট

 

Link copied!