সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বছর-দুই আগে একটা ‘বিজ্ঞাপন’ খুব প্রচার হচ্ছিল, “আগামীকাল (রবিবার) ৭ই মার্চ বিকাল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে গণ-সমাবেশ। বক্তৃতা করিবেন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।” একাত্তরে পত্রিকায় প্রকাশিত সেই বিজ্ঞাপনটি যখন নিউজফিডে আসে তখন অন্তর্গত তুমুল আন্দোলনে আন্দোলিত হয়েছিল দেহ-মন। সেবার আন্দোলিত হয়েছিলাম। আগের মতো না হলেও এবারও ফিরেছে সেই বিজ্ঞাপন; দিন-তারিখের ঠিক নেই যদিও, ব্যবধান সময়েরও। উত্তাল একাত্তর আর এই সময়ের বিশ-তেইশ। তখন স্বাধিকার আর স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত বীর বাঙালির প্রস্তুতি, অনন্ত প্রতীক্ষা। আর এখন স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় খানিকটা রকমফের, দেশ থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে!
সেই রেসকোর্স আগের নামে নেই, আগের নামে নেই দেশও। রেসকোর্স ময়দান হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি বাংলাদেশ, ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। নির্দিষ্ট এই তারিখকে ঘিরে আমাদের আবেগের যোগ, যদিও দেখিনি একাত্তর তবু অনুভব করছি আমাদের পূর্বপুরুষকে যারা সাত মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাব্বিশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, এরপর ডিসেম্বরে অর্জন করেছিলেন ঐতিহাসিক বিজয়।
বাঙালির এই বিজয়, এই স্বাধীনতার ঘোষণা, এই সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ স্রেফ বিশেষ কোনোদিনের ব্যাপার ছিল না। এটা ছিল দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের পরিণতি, যেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ একাত্তরে বাঙালিকে যখন মুক্তির সংগ্রামের চূড়ান্ত ধাপে নিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু তখন তিনি তার ঐতিহাসিক ভাষণে অতি-আবেগে কিংবা অতি-বিপ্লবের বশবর্তী না হয়ে বাঙালিকে দিয়েছিলেন চূড়ান্ত পথের দিশা। তিনি বিদ্রোহ করেননি ঠিক তবে মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। তিনি সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা দেননি ঠিক কিন্তু ‘যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতার কথা বলেছেন, সংগ্রামকে ব্যাখ্যায় বলেছেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার সেই ভাষণ তাই বিদ্রোহ বলে পরিগণিত হয়নি, একটা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছিলেন দূরদর্শী চিন্তায়। তাই সাত মার্চের কঠোর সেই নির্দেশনা, পাকিস্তানিদের প্রতি হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে আখ্যা দিতে পারেনি খোদ পাকিস্তানিরাই। নেতৃত্বের এই বিরল গুণ তার মধ্যে ছিল বলেই তিনি দেশকে মুক্তিযুদ্ধের পথে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতার বীজ প্রোথিত করতে পেরেছেন সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ এই দিনটিকে সর্বোচ্চ কাব্যিক আর শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন হয়তো। ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় তিনি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের দিনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে করে টের পাওয়া যায় একাত্তরকে, সাত মার্চকে, রেসকোর্স ময়দানকে। কারা এসেছিল রেসকোর্সে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে; এ চিত্রও পাওয়া যায় নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতায়। কবির চোখে ভেসেছিল তারা যারা, “কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল/ কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে/ এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে/ এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে/ এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা,/ ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।” কবি লিখেন, “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে—/‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?” চমৎকার সেই বর্ণনা; এই বিশ-তেইশে বসেও দিব্যচোখে দেখা যায় একাত্তরকে!
জাতির পিতার এই ভাষণ অলিখিত হলেও শব্দ-বাক্যের দ্যোতনা আর অর্থের দিক থেকে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, একই সঙ্গে সাত কোটি বাঙালিকে দেওয়া পরিষ্কার দিকনির্দেশনা। সে ভাষণে একজন রাজনীতিকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য নির্দেশনাই কেবল ছিল না, এর মধ্যে নিহিত ছিল মানুষের চেতনা জাগানিয়া মহাকালের গান। আর পথ ধরেই এসেছিল বাঙালির স্বাধীনতা। একাত্তরের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে গ্রহণ করেছিল আত্মিকভাবে, তাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তার কথামতো সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মার্চের ছাব্বিশে এসে তিনি দিয়েওছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। আর সেখান থেকেই রক্তের পথ ধরে অর্জিত বাংলাদেশ।
একাত্তরের সাত মার্চ দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ কেবল বাঙালি আর বাংলাদেশের সম্পদ হয়ে থাকেনি, এটা হয়েছে বিশ্বের সম্পদ। অমরত্বের রূপ পেতে যাচ্ছে এই ভাষণ। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) স্বীকৃতিতে এটা বৈশ্বিক ঐতিহাসিক দলিল। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণটিও রয়েছে। বৈশ্বিক এই স্বীকৃতি এই ভাষণের মাহাত্ম্যকে বর্ণনা করে। দেশেও বাঙালির এই ৭ মার্চ জাতীয় ঐতিহাসিক দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে হাই কোর্টের এক নির্দেশনার আলোকে মন্ত্রিসভা পরিপত্রে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন/পালন সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত পরিপত্রের ‘ক’ ক্রমিকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর পরে ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব অনুমোদিত হয় গত তিন বছর আগে।
বিশ্ব ঐতিহ্য কিংবা বাঙালির ঐতিহ্য যাই বলা হোক না কেন ৭ মার্চ বাঙালির কাছে অবিনশ্বর এক দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধু মুক্তির সংগ্রামের যে চূড়ান্ত যে বার্তা দিয়েছিলেন সেটা নেতার নেতৃত্বের স্মারক হয়ে আছে, মুক্তিকামী উপস্থিত লাখো বাঙালি তার সেই বজ্রকণ্ঠে উদ্দীপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিল বিজয়ী হতে বাড়ি ছাড়বে বলে। মার্চের ছাব্বিশে সুস্পষ্ট ঘোষণার পর তারা চূড়ান্তভাবে বাড়ি ছেড়েছিল সকল বাড়িকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে। সফল হয়ে বিজয়ী বেশে ফিরেওছিল তারা।
একাত্তরের মার্চের সাত, সেদিন ছিল রোববার। পঞ্চাশ বছর পর ২০২১ সালে সে তারিখে রোববার ফিরেছিল। এবার যদিও এটা মঙ্গলবার, তবু বিজ্ঞাপনে আন্দোলিত হওয়া বাদ যায়নি আমাদের। এই বিজ্ঞাপনও এক ঐতিহাসিক দলিল। এই বিজ্ঞাপনে চোখ পড়তে আজও আমরা ধারণ করতে বসেছি একাত্তরকে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’; বঙ্গবন্ধুর তেজোদৃপ্ত সেই ভাষণের কথাগুলো যেন কেবল একাত্তরকেই প্রতিনিধিত্ব করছে না, এটা এই সময়েও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার যে আকাঙ্ক্ষা সে চিরায়ত এক; বাঁধহীন, মুক্ত। স্বাধীনতা, সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ না করা যে এক প্রপঞ্চ।
বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের সাতই মার্চের কালোত্তীর্ণ সেই ভাষণ অমরত্ব লাভ করেছে, তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও সময়কাল অতিক্রম করেছে। ‘স্বাধীনতা’ যে শব্দ তার অর্থ-আবেদন-আকাঙ্ক্ষা এই সময়ে এসেও সমভাবে প্রাসঙ্গিক।
আজ ৭ মার্চ; আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বসে বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের মত ‘স্বাধীনতার’ কথাই বলছি! ‘স্বাধীনতা’, পুরনো কথা নয়; ‘স্বাধীনতা’ সবকালে সবসময়ে গণমানুষের সতত আকাঙ্ক্ষা। সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর অবিনশ্বর সেই ভাষণ এখনও আমাদের মোহাবিষ্ট করে রাখে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক