• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ধর্মীয় সংঘাত নয়, চাই সম্প্রীতি


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৩, ০৪:০৩ পিএম
ধর্মীয় সংঘাত নয়, চাই সম্প্রীতি

পঞ্চগড় দেশের একটা প্রান্তে পড়ে থাকায় ওখানকার ধর্মীয় সহিংসতা শুরুতেই ব্যাপক আলোচনায় আসতে পারেনি। অথচ এটা ভয়ঙ্কর। একই ধর্মের দুইটা দল একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ছে। যদিও আহমদিয়া সম্প্রদায় বা কাদিয়ানিদের মুসলমান মানতে নারাজ মুসলমানদের একটা পক্ষ। আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবি একাংশের অনেক দিনের। এই দাবির বাইরে দেখানো ধর্মীয় খোলস, ভেতর তার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির। এই দাবি, দাবি আদায়ে নানা কৌশল চলমান। এটা চলবে ততদিন, যতদিন থাকবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি।

ধর্ম শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলে, এমনই দাবি যেখানে, সেখানে ধর্মের নামে কেন এই সহিংসতা? আহমদিয়াদের কেন অমুসলমান ঘোষণা করতে হবে? এখানে স্বনির্ধারিত যুক্তির সুযোগ নেই। প্রশ্ন কেবল, এই ঘোষণার কর্তৃপক্ষ কে? কোনো দেশের সরকার কি সেটা পারে? দৃশ্যত কোনো রাষ্ট্রই অনুমোদিত ধর্মীয় সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নয়। কোনো আইন ধর্মীয় বিধান নয়। রাষ্ট্রের আইনে পাপ-পুণ্যের বিধান নেই, নেই বেহেশত-দোজখ কিংবা স্বর্গ-নরকের বিধান। রাষ্ট্রের সবকিছু লৌকিক; রাষ্ট্রের কোনো পরকাল নেই; সবটাই ইহকালের! রাষ্ট্রের আইন অমান্যে শাস্তির যে বিধান, সেটা জীবদ্দশায়ই ভোগ করতে হয় প্রত্যেককে। তাহলে কোন যুক্তিতে একটা অংশ আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানায় রাষ্ট্রের কাছে?

অদ্যকার এই ধর্মীয় সহিংসতা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে। এখানে কেন বাধা দেওয়া হবে? যার যে বিশ্বাস সেটা তারা পালন করুক। এখানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সুযোগ নেই জোরজবরদস্তির। সুযোগ নেই আইন লঙ্ঘন করে বাধা দেওয়ার, সুযোগ নেই ধর্মরক্ষার নামে সহিংসতায়।

পৃথিবীতে কয়েক হাজার ধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষজনকে বাধা দিলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হবে। একই ধর্মের মানুষেরা নানা মত-পথে বিভক্ত হতে পারে। কিন্তু সেটা নিয়ে সহিংসতায় জড়ালে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে নিজেদের কারণে নিজেরাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটা কেন করবে তারা?

ধর্ম পালন করা, না করা নিয়ে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না। তবে যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনার বিপক্ষে অবস্থান নেবে রাষ্ট্র, এটাই স্বাভাবিক। পঞ্চগড়ে সেটাই হয়েছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার বিরুদ্ধে প্রথমে কর্মসূচি দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন নামের ধর্মভিত্তিক একটা সংগঠন। এটা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি, ধর্মের নামে রাজনৈতিক কর্মসূচি। এই ধরনের কর্মসূচি দিয়ে তারা জনসমর্থন কুড়াতে চায়। এভাবেই তারা আলোচনায় থাকতে চায়। অতীতে আমরা অনেকবার দেখেছি। যে ধারা চলছে তাতে না চাইলেও ভবিষ্যতেও আমাদের দেখতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন পঞ্চগড়ের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দাবি করেছেন, ‘শুক্রবারের মিছিলের বিষয়ে তাদের কোনো নির্দেশনা ছিল না। কারা মিছিল বের করেছে, তা তাদের জানা নেই’। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক এই নেতা যতই অস্বীকার করুন না কেন, প্রাথমিক উসকানি কিন্তু তারাই দিয়েছিলেন। জুমার নামাজের পর সহিংসতার যে ঘটনা ঘটল সেটা সাধারণ মুসল্লিদের ব্যানারে কিংবা নামে হয়েছে হয়তো, কিন্তু এই পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তারাই। কারণ সাধারণ মুসল্লি নামের আড়ালে এই রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরাই এখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, যেকোনো সংঘাত-সহিংসতায় শত-সহস্র লোক অংশ নিলেও সবাই নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকে না। এখানে কিছু লোক উসকানি দিয়েছে, আইন অমান্য ও সম্প্রীতি বিনষ্টে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা না দিলে এই ধরনের অপরাধকে জিইয়ে রাখা হবে। বারবার ঘটতে থাকবে। আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে দেশের নানা প্রান্তে। দ্রুত ও সঠিক বিচার হয়নি বলে এই অপরাধগুলো অপরাধ হিসেবে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।    

পঞ্চগড়ের ধর্মীয় সহিংসতায় এখন পর্যন্ত দুইজনের প্রাণহানি হয়েছে। যে দুইজন মারা গেছে বয়সে তারা তরুণ। শোনা যাচ্ছে, তাদের একজন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের, আরেকজন অন্যপক্ষের। কেউ কি জানে তাদের গন্তব্য? ধর্মীয় বিধানে গন্তব্য যেখানে বেহেশত-দোজখ কিংবা স্বর্গ-নরকে, সেখানে ধর্মের নামে এই সহিংসতায় তারা প্রাণ হারালেও কেউ জানতে পারবে না আদৌ তাদের গন্তব্য। তাহলে কীসের জন্যে সংঘাতে জড়াচ্ছে এরা? সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং অশান্তি সৃষ্টিতে যেখানে নেই পুণ্যের সুযোগ, সেখানে কেন এই পাশবিকতা?

ফেসবুকে-ইউটিউবে-হোয়াটসঅ্যাপে ধার্মিক সেজে বসে থাকা লোকের সংখ্যা অগণন। এদের বেশিরভাগই ধর্মের উপকার করছে না, বরং ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে অনেকের কাছে। নেপথ্য যারা তারা ঠিকই এখানে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। এদের ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি।

যদি ধার্মিক হোন, তবে ধর্ম পালন করুন। ধর্ম পালনে কেউ কখনো কাউকে বাধা দেয় না, দেবেও না। যার যার ধর্ম তার তার কাছে, যার যার ব্যাখ্যা তার তার কাছে। যদি একান্তই কাউকে প্রভাবিত করতে চান তবে শান্তি ও সম্প্রীতিকে মাথায় রাখুন। সম্প্রীতিহীন পৃথিবী বিরান জনপদতুল্য!

 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!