রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষা কি এক? মাতৃভাষা প্রসঙ্গ এলে অনেকে রাষ্ট্রভাষাকে বুঝে থাকেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও এ নিয়ে তর্ক জড়িয়ে দেন। বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলা হতে পারে না, অনেক উচ্চশিক্ষিতও উপলব্ধি করতে পারেন না।
আদিবাসী শিশুদের মধ্যে যারা শুরু থেকে শহরে পড়ালেখা করে, সে সকল ছেলেমেয়ের অভিভাবকরা সবচেয়ে বেশি এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে থাকেন। আদিবাসী পরিবারের অভিভাবকরা স্কুলের শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, বাংলা চর্চা করতে গিয়ে, অনেকের সন্তান আর মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। শহুরে আদিবাসী পরিবারগুলোতে মাতৃভাষা চর্চা না থাকা সকলের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
বেসরকারি নামিদামি স্কুলগুলো নিজস্ব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করে থাকেন। অধিকাংশ শিক্ষকের শিক্ষকতা বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণও থাকে না। নিয়োগপ্রাপ্তরা মেধাবী হতে পারেন, কিন্তু শিশু শ্রেণিতে শিক্ষকতা করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা তা আর দেখা হয় না। উন্নত বিশ্বে যেখানে সবচেয়ে সেরাদের সেরাকে শিশু শ্রেণিতে পড়ানোর জন্য নির্বাচন করা হয়, সেখানে আমাদের মতো দেশে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত নতুনদের দিয়েই শিশু শ্রেণিতে পড়ানোর হয়।
ভাষা শিক্ষা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার হলেও শহরের স্কুলগুলো সকল ভাষাভাষী শিশুর থেকে সমান বাংলা ভাষায় দক্ষতা প্রত্যাশা করে থাকেন। আমরা প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ইংরেজি শিখি। তারপরও কতজন ইংরেজিতে মাতৃভাষার ন্যায় বলতে, লিখতে, পড়তে সক্ষম হই, ভেবে দেখা দরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শহরে বসবাসকারী অনেক শিশুকে তার নিজের মাতৃভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করছি কিনা উপলব্ধি করা দরকার। এখানে অনেক পাঠক বাংলা চর্চা বৃদ্ধি হিসেবে খুশি হতে পারেন। কিন্তু এটাও জানা দরকার যে, পৃথিবীর প্রয়োজনে সকল ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে রাষ্ট্রভাষাকে চাপিয়ে দিয়ে অন্যের মাতৃভাষাকে অবহেলা করার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষাকেও এক প্রকার গুরুত্বহীন করা হচ্ছে কিনা ভাবা উচিত। ইতিমধ্যে সে লক্ষণও আমরা দেখতে পাই, যার টাকা আছে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চায়। আজকালকার শিশুরাও ইংরেজিতে কথা বলতে, পড়ালেখা করতে পারলে নিজেকে স্মার্ট হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে।
ফেব্রুয়ারি এলে আমরা ভাষা নিয়ে কথা বলি। ভাষা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুধু বাংলাকে নিয়ে গবেষণা করতে থাকি। ফেব্রুয়ারিকে যদিও ভাষার মাস হিসেবে অভিহিত করি, চর্চার বেলায় ভাষার মাসের বদলে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে নিয়ে আলোচনা করতে থাকি। ফলে আমাদের মাসব্যাপী বইমেলাটি আক্ষরিক অর্থে বাংলা বইয়ের মেলাতে রূপ নেয়। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে মেলাটি পরিচালিত হয় বলে বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের প্রাধান্য পায়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে মাথায় রেখে, বইমেলা থেকে ভাষার মেলাতে পরিণত করা দরকার। বই প্রকাশনা, বেচাবিক্রির চেয়ে মাতৃভাষা চর্চা ও উপলব্ধি জরুরি। ভাষার মাসকে বইমেলাতে আটকে রেখেছি বলে বইমেলা এখন তরুণদের সেলফি জোনে পরিণত হয়েছে।
ভাষার মাসে হাজার হাজার বই প্রকাশ পায়, কিছু বই বিক্রি হয় কিন্তু মাতৃভাষা চর্চা হয় না। তরুণরা লিখতে গিয়ে ভুল বানানে কিংবা সংমিশ্রিত ভাষাতে কথা বলে। ঢাকা শহরে বসবাস করতে গিয়ে অনেক অভিভাবক নিজ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা আর চর্চা করেন না। শিশুদের আঞ্চলিকতা প্রভাবমুক্ত করতে আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় করতে ভুল করেন না। আঞ্চলিক ভাষা শিখে যাবে বলে অনেকের থেকে শিশুতে দূরে রাখতেও দেখা যায়। এর মধ্যে দিয়ে অভিভাবক শিশুটিকে শিকড় থেকে শুধু দূরে ঠেলে দিচ্ছেন না, সন্তানকে নিজের থেকেও দূরে ঠেলে দিচ্ছেন উপলব্ধি করা হয় না।
শহরের যে অভিভাবক, শিক্ষক নিজেদের আঞ্চলিকতা প্রকাশ করতে লজ্জা পান, তাদের কাছে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আদিবাসী শিশুরা কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন, প্রশ্ন করতে পারি। শিক্ষক, অভিভাবকরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরির্বতনের পরিবর্তে তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি শিশুদের মাঝে দেখতে চায়, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের অধিকার লঙ্গন বলে মনে করি।
দেশে নামিদামি স্কুলগুলোর উপলব্ধি আনয়নে ভাষার মাসটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভাষার মাসে বইমেলাকে প্রধান উৎসব হিসেবে দেখা হয়। এই উৎসবকে সময়ের বিবেচনায় পরিবর্তন, পরিমার্জন করার দাবি রাখতে পারি। বইমেলা আমাদের ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে ধরে রেখে ভাষার মাসকে ভাষা মেলাতে রূপ দিতে পারি। বইমেলাতে হাজার হাজার বই উন্মোচন হলেও ঘুরে ফিরে সে দুটি ভাষাতেই— বাংলা কিংবা ইংরেজি। আমরা যদি ভাষার মাসকে ভাষার মেলাতে রূপ দিতে পারি দেশের অনেক ভাষার বই স্থান পাবে। তরুণরা, শিক্ষকরা, শিক্ষিতরা দেশে অন্যান্য মাতৃভাষার অস্থিত্ব বুঝতে পারবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট এ বছর সীমিত পরিসরে ভাষামেলা শুরু করেছে। মাত্র ২দিনের মেলায় ১৬টি সংগঠন/ প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। ভাষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কার্যক্রমসহ প্রকাশিত বইগুলো প্রদর্শনী ও বিক্রি করেছে। ভাষামেলা ধারণাটি বাংলা একাডেমিও গ্রহণ করতে পারে। বাংলা একাডেমি দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের জন্য স্টল বরাদ্দ দিয়ে শিশুদের শিক্ষিতজনদের ভাষা, মাতৃভাষা বিষয়ে জ্ঞান, ধারণা ও চর্চায় ভূমিকা রাখতে পারে।
মাতৃভাষা মানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা নয়। মাতৃভাষা মানে রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহৃত ভাষা নয়। মাতৃভাষা মানে অফিস-আদালতে, স্কুল কলেজে কিংবা শুধু পাঠ্য বইয়ের ভাষা নয়। শিশুটি যদি তার মায়ের ভাষায় কথা বলে, সেটিই তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। তারা ভাষামেলা আয়োজন করেছে। সরকারও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক চালু করে, প্রথম পদক একজন আদিবাসী ভাষা গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরাকে দিয়ে উৎসাহিত করেছে। বর্তমানে বাংলাভাষার পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৫টি আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে। এখন বাংলা একাডেমিকেও এগিয়ে আসতে হবে। বাংলা একাডেমিকে শুধু বাংলা ভাষা চর্চা থেকে বেরিয়ে মাতৃভাষা চর্চায় ভূমিকা রাখতে হবে। একাডেমিতে আদিবাসী ভাষা বিভাগ/ সেল স্থাপনের দাবি উত্থাপিত হচ্ছে।
২১ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে, আমাদের প্রথা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বৃহৎ পরিসর নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহৎ হতে শুরু করলে শহরের স্কুল, শিক্ষকসহ শিক্ষিতরাও মাতৃভাষা বিষয়ে বৃহৎ পরিসর নিয়ে ভাবতে শুরু করবে। শহরে বাস করা আদিবাসী ছাত্র, পরিবারটিও মাতৃভাষা চর্চায় সাহসী হয়ে উঠবে। শহরের কোনো শিশু মা, মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। বাংলাভাষী পরিবারগুলোও নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবে। একটি অর্থপূর্ণ শব্দ আবিষ্কার হতে কত সময়, বছর লেগেছে তার হিসাব জানা না থাকলেও শব্দ, ভাষাগুলোকে মেরে ফেলা আমাদের কাজ হতে পারে না। ভাষা আমাদের জ্ঞান, ইতিহাস, সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানসহ একটি জাতিগোষ্ঠীর জীবন প্রণালি। সকল জ্ঞানকে সংরক্ষণই হোক আমাদের অঙ্গীকার। সে লক্ষ্যে আমাদের ভাষার মাস হয়ে উঠুক ভাষার মেলায় মাস।
লেখক : কলামিস্ট