• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঝুমন দাস অকারণে সাজা পাচ্ছেন নাকি?


ইমতিয়াজ মাহমুদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২১, ০২:২৩ পিএম
ঝুমন দাস অকারণে সাজা পাচ্ছেন নাকি?

ঝুমন দাসকে ওর গ্রামের লোকজন ধরে নিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে মার্চের ১৬ তারিখে, আর তারপরের দিন ১৭ তারিখে ওর গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। কয়েক দিন ধরে এসব ঘটনা নিয়ে যখন খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছিল, সে সময়ই কে যেন আমাকে ঝুমন দাসের ফেসবুক পোস্টগুলো দেখিয়েছে—দেখেন এই ছেলেটা কী সব আজেবাজে কথা লিখেছে ফেসবুকে, হেফাজতের নেতাদের গালি দিয়েছে এই ছেলের আর রক্ষা নাই। ততক্ষণে মামলা হয়ে গেছে, মামলা আর হামলা এই দুইটাই তো প্রায় একই সময়ে হয়েছিল আরকি। মামলার খবর শুনে আমার একটু একটু আগ্রহও জেগেছিল। আমি চাই যে এই মামলাটা যেন সুপ্রিম কোর্টে আসে, কেননা আমি দেখতে চাই যে একটা মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্নে কী বলেন। প্রসঙ্গটা হচ্ছে যে একজন মানুষ যখন কোনো মানুষের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতামতকে বা কোনো গোষ্ঠীকে সমালোচনা করতে গিয়ে গালাগালি করে বা ধর্মকে অবমাননাকর কথা বলে, সেসব কথা বলার স্বাধীনতা কি মানুষের নেই?

মামলা এখনো বিচারাধীন। মামলা চলবে কত দিন, তা জানা নেই। কিন্তু এই সময়ে ঝুমন দাসের কী হবে? আমরা কি ঝুমন দাসকে আটকে রাখব যত দিন মামলা শেষ না হয় তত দিন পর্যন্ত? সেটা তো হওয়ার কথা নয়। ঝুমন দাসকে তো আদালত থেকে জামিনে এরই মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কথা। জামিনে ছেড়ে দেওয়ার কথা কেন বলছি? কারণ, এই মামলা শেষ হতে তো সময় লাগবে। মামলার শেষে দেখা যাবে হয়তো যে ঝুমন দাসের ওই সব ফেসবুক পোস্ট প্রকাশ করা কোনো অপরাধ ছিল না, ঝুমনকে শাস্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাইলে কী হবে? এই যে এতগুলো দিন ঝুমন দাস কারাগারে আটকে রইল, এই যে ঝুমন দাসের লিবার্টি ক্ষুণ্ণ হলো, এইগুলোর কী হবে? যদি একজন লোক একটা দিনও কারাগারে আটক থাকে, সেই দিনটা তো আর পরে ফেরত দেওয়া যাবে না। সম্পদ গেলে সম্পদ ফেরত দেওয়া যায়, কিন্তু যে দিনটা আমি জেলে থাকলাম, সেই দিনটা কি ফেরত দেওয়া যাবে? যাবে না তো। এই জন্যে আইনে বিধান হচ্ছে যে একজন লোকের বিরুদ্ধ যখন ফৌজদারি মামলা হয়, বিচার চলাকালীন তাকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হবে।

না, এর ব্যতিক্রম আছে। কোনো কোনো সময় আদালত চাইলে আসামিকে জেলহাজতে রাখতে পারেন। কখন পারেন? যদি আদালতের মনে হয় যে না, এই লোকটাকে যদি জামিনে ছেড়ে দিই তাহলে সে সাক্ষীদের মাথায় পিস্তল ধরতে পারে বা মামলার আলামত নষ্ট করতে পারে, বা অন্য কোনো না কোনোভাবে তদন্ত বিঘ্ন ঘটাতে পারে, তখন আদালত বলবেন যে ভাই, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি আমার হেফাজতেই থাকুন, মানে জেলহাজতে। অথবা যদি এমন হয়, আসামির পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আদালত যদি মনে করেন যে এই লোকটাকে ছেড়ে দিলে তো সে বিদেশ চলে যাবে, আর একবার চলে গেলে সে আর ফেরত আসবে না, তখনো আদালত আসামিকে আটকে রাখতে পারে। উকিল সাহেবেরা আপনাকে নানা রকম ভারী ভারী শব্দ বলবেন, বেইলেবল, নন-বেইলেবল এই রকম নানা সব বাগাড়ম্বর, না, ওই সব কথারও গুরুত্ব আছে, তবে মূল কথা বা সার কথা হচ্ছে ওটাই।

 

বেইলেবল বা জামিনযোগ্য অপরাধ আর নন-বেইলেবল বা জামিন অযোগ্য অপরাধ, এই দুইটার মধ্যে পার্থক্য কী সেটা সংক্ষেপে বলি। জামিনযোগ্য অপরাধ হচ্ছে সাধারণভাবে সেই সব অপরাধ যেগুলোর শাস্তির পরিমাণ একটু কম, এসব মামলায় বিচারের সময় জামিনে মুক্ত থাকা আসামির অধিকার, তবে আদালতের যদি সংগত কারণ থাকে মনে করবার যে আসামি পালিয়ে যেতে পারে বা তদন্তে বিঘ্ন ঘটাতে পারে তাহলে আদালত তাকে আটকে রাখতেও পারেন। আর জামিন অযোগ্য অপরাধ হলে আসামি অধিকার বলে জামিন দাবি করতে পারে না, তবে আদালত যদি মনে করে যে আসামি পালাবে না বা তদন্তে বিঘ্ন ঘটাবে না, তাহলে আদালত তাকে জামিন দিতে পারেন। দুই ক্ষেত্রেই আদালতকে বিবেচনা করতে হয় আসামির পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বা তদন্তে বিঘ্ন ঘটানোর সম্ভাবনা আছে কি না। আর কিছু বাস্তব বিষয় বিবেচনা করতে হয়: আসামি বেশি বৃদ্ধ হলে বা শিশু হলে বা অন্য কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে জামিনে ছেড়ে রাখাই উত্তম।

ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে যে মামলাটি হয়েছে এটা একটা জামিন অযোগ্য মামলা, অর্থাৎ আদালত যদি মনে করেন যে লোকটা পালাবে না, বা তদন্তে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না, তাহলে নানা শর্তে জামিন দিতে পারে। শর্ত দিতে পারে যে তুমি দেশ ছেড়ে যাবে না। অদ্যাবধি ঝুমন দাশের জামিন হয়নি। আজকে ছয় মাসের মতো হতে চলল, এই তরুণ ছেলেটা জেলে আটকে আছে। ওর ছোট একটা বাচ্চা আছে, তাকে নিয়ে ওর তরুণী স্ত্রী তীব্র অভাবের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আপনার আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, যেকোনো সাধারণ মানুষের চোখেই দৃশ্যমান যে ঝুমন দাসের সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে দুইভাবে। প্রথমত, ছেলেটাকে বিনা বিচারে শাস্তি পেতে হচ্ছে, দ্বিতীয়ত ওকে শাস্তি পেতে হচ্ছে নিতান্ত দুইটা কথা বলার জন্য। এই দুইটাই অন্যায়, গুরুতর অন্যায়। আরেকটা অন্যায়ও ওর প্রতি হচ্ছে, সেটা পরে বলছি।

দেখুন, মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা, যা অন্যায়, সেটা তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। নীতিটা তো এখন সবাই জানেন, এইটাকে সভ্যতা ও গণতন্ত্রের একরকম একটা মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে দেশে মানুষ মুক্তভাবে কথা বলতে পারে না, সেই দেশকে চিহ্নিত করা হয় অসভ্য ও অগণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে। মুক্তভাবে কথা বলা মানে কী? মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরু মানুষের পছন্দের বিপরীতে কথা বলার অধিকার। সংখ্যাগুরুর মন জুগিয়ে কথা বলার জন্য কোনো অধিকার বা স্বাধীনতা দরকার হয় না, বাকস্বাধীনতা হচ্ছে কোটি মানুষের পিত্তি জ্বলে যাবে এই রকম কথা বলার অধিকার। লোকে প্রশ্ন করে, তাহলে কি অন্যের বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বলার অধিকারও আছে? অবশ্যই আছে, না হলে তো বাকস্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকে না।

 

উদাহরণ দেব? গ্যালিলিওর কথা ধরুন, তিনি যে কথাটি বলেছিলেন সেটি কি সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেনি? যুবক যিশু যখন জেরুজালেমের রাস্তায় বলতেন, আমি ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন ইত্যাদি, সেগুলো কি জেরুজালেমের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করেনি? অবশ্যই করেছে। কিন্তু সেই কথাগুলো বলার অধিকার তো ওদের ছিল। তখন মানুষ এসব উপলব্ধি করেনি, কিন্তু এখন আমরা জানি যে মানুষের সভ্যতা অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার জন্যও সবার যা ইচ্ছা তাই বলার অধিকারকে রক্ষা করতে হবে। এমনকি যার কথাটা মনে হবে নিতান্ত প্রলাপ বা বাহুল্য, তার অধিকারও রক্ষা করতে হয়। কেননা, কেউ যদি কথাটি বলতেই না পারে, তবে কি করে আমরা বুঝব কথাটি আসলেই প্রলাপ বা বাহুল্য? এটাই স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সভ্যতার নিয়ম। কথা বলার জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র কাউকে বাধা দিতে পারে কেবল তখনই, যখন কারও কথাতে অপরের অধিকার খর্ব হয়। যেমন কেউ যদি বলে যেসব ইহুদিকে হত্যা করতে হবে, বা যদি বলে যে নাস্তিকদের হত্যা করতে হবে। তখন আর আপনি আপনার অধিকারের সীমার মধ্যে থাকলেন না, অপরের অধিকার খর্ব করলেন।

ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে যে মামলা, সেখানে এটাই সিদ্ধান্ত হবে, ঝুমন দাস কি তার বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে অন্যের অধিকারকে খর্ব করেছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে আমাদের দেশের অন্য সব আইনে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, ওকে শাস্তি দেওয়াটা হবে ওর মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। তো সেই বিচার হোক, কিন্তু বিচার চলাকালীন ওকে কেন এত দিন আটকে রাখতে হবে? এটা তো ওকে বিনা বিচারে সাজা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা তো অন্যায়। দৃশ্যমান সুস্পষ্ট অন্যায়।

 

আরেকটা অন্যায়ও সম্ভবত ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে হচ্ছে। ঝুমন দাসকে কি কেবল হিন্দু বলেই জেলে আটকে রাখা হচ্ছে? সম্ভবত বলছি বটে, কিন্তু এ রকম ধারণা করার তো সংগত কারণ রয়েছে। মার্চের ওই দুই-তিন দিনের ঘটনায় যারা শাল্লার গ্রামটিতে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করেছে, তাদের কাউকে তো জেলে আটকে রাখা হয়নি, সবাই জামিন পেয়ে গেছে। ওদের জামিন না দেওয়ার তো যুক্তিসংগত কারণ ছিল, কেননা ওরা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছে, মানুষের বাড়ি ঘরে হামলা করেছে, ওরা বাইরে থাকলে সাক্ষীদের হুমকি দেবে, তদন্তকে বিঘ্নিত করবে। ওদের আপনারা জামিন দিয়ে দিলেন, কিন্তু বেচারা ঝুমন দাস, যে কিনা শুধু কথা বলেছেন, তাকে আটকে রেখেছেন? কেন? সে ক্ষমতাহীন ও সংখ্যালঘু বলে?

 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

Link copied!