বাংলাদেশের গ্রামের শিশুরা রাষ্ট্রের সামান্য সেবা পেলে কিভাবে বিশ্বজয়ী হতে পারে তার প্রমাণ মেয়েদের ফুটবলে সাফের শিরোপা জয়। গ্রামে অপুষ্টিতে বেড়ে উঠা তহুরা, মারিয়া, সানজিদা, রুপনা, কৃষ্ণারা তাঁদের বাবা-মা, গ্রাম, শিক্ষকদের লালন ও পালনে শৈশবের চ্যালেঞ্জ উতরে যখনই জাতীয় পর্যায়ে সম্ভাবনার ছাপ রাখলো, তখন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বিশেষ ক্যাম্প করে তাঁদের রেখে দিল। পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত ঘুম, ব্যায়াম, শৃঙ্খলা ইত্যাদি পেয়ে গ্রামের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুগুলোই বাংলাদেশকে সারাবিশ্বে ইতিবাচকভাবে পরিচয় করিয়ে দিল। অথচ প্রতিটি মেয়ে গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। সানজিদা, মারিয়া মান্ডাদের শৈশব দেখলেই আমরা বাংলাদেশের গড়পড়তা শিশু স্বাস্থ্যের একটা আন্দাজ পেয়ে যাব। গ্রামের সবচেয়ে গরীব ঘরের শিশুরা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিল। দেশের বিত্তশালীদের সন্তানদের একটা বড় অংশ বিদেশে পাড়ি দিলেও এই গরীব শিশুরা বড় হয়ে দেশকে এনে দিল বিশেষ সম্মান। কিভাবে আমাদের শিশুরাও বদলে যাচ্ছে, বদলে দিচ্ছে দেশকে? এর উত্তর খুঁজে দেখা আজ জাতীয় শেখ রাসেল দিবসে খুব প্রাসঙ্গিক।
মারিয়া মান্ডা, তহুরা, সানজিদারা বেঁচে থাকার অধিকার পেয়েছিল, বেঁচে থেকে মাঠে মাঠে ফুটবল খেলার অধিকার পেয়েছিল। তাই তাঁরা আজ দেশের তারকা। ছোট শেখ রাসেল সে অধিকার পায়নি। একটি শিশুর কাছ থেকে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল বুলেটের নির্মম আঘাতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালরাতে একদল বিপদগামী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর আদর্শিক শত্রু। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী একজন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী নেতা। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের একনিষ্ঠ অনুসারী বঙ্গবন্ধু একবার আলজেয়ারিয়াতে বলেছিলেন, পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, আরেকদিকে শোষিত। তিনি শোষিতের পক্ষে। শোষিতের পক্ষের একজন নেতাকে খুনি লাগিয়ে মেরে ফেলেছিল শোষকের নেতারা। বিশ্বের নানা দেশে এভাবে খুনি পাঠিয়ে বিরোধী নেতাদের মেরে ফেলার চর্চা পুরোনো কৌশল। সাম্প্রতিককালেও সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে এভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। মেরে ফেলার আগে সিআইএ এজেন্টদের দিয়ে প্রত্যেক টার্গেট দেশে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়। এমনই একটি মিশন ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। পুরো পরিবারকে মেরে ফেলার টার্গেট নিয়ে সেই রাতে ৩২ নম্বরের বাসায় আসে কিছু সেনা সদস্য। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির ধানমন্ডির ১৩/১১ রোডের বাড়িতে তার স্ত্রী বেগম আরজু মনিসহ হত্যা করে আরেকটি গ্রুপ। আরজু মনি সে সময় গর্ভবতী ছিলেন। তাঁদের দুই শিশু সন্তান তখন অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই দুই শিশু আজকের শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ ফজলে শামস পরশ। খুনি সেনাদের আরেকটি দল বঙ্গবন্ধুর শ্যালক আবদুর রব সেরনিয়াবাত মিন্টু রোডে তাঁর বাসায় ভোর ৫ টা ৫০ মিনিটে শহীদ হন। সেই হামলায় সেরনিয়াবাতের ভাগ্নে শহীদ সেরনিয়াবাত, কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু এবং ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাতও নিহত হয়েছিলেন। এই হামলায় তিনজন গৃহকর্মীও মারা গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী আদর্শকে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এমনই ভয় পেত যে তাঁর শিশু সন্তান শেখ রাসেলকেও হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাউকেই বাঁচতে দিতে চায়নি খুনিরা। সেই কালরাতে শেখ রাসেলের সাথে আরজু মনির গর্ভে থাকা সন্তান, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী), কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র), আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ’র জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকান্ত আব্দুল্ললাহ বাবু (বয়স ছিল ৪ বছর এবং ঢাকায় দাদার বাসায় বেড়াতে এসেছিল)কেও হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিরোধিতার জন্য বিশ্বের আর কোনো ইতিহাসে এমন নারকীয় শিশুহত্যা সংঘটিত হয়েছে? শেখ রাসেল জাতীয় দিবসে আজ দেশের শিশুদের সামনে সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের হাজির করা উচিত। শিশুরা জানুক সেদিন শেখ রাসেল নিহত না হলে সে তাঁদেরই মতো করে বাবা-মা, ভাই, বোন, ভাবিদের আদরে বড় হতো। শেখ রাসেল, সুকান্ত বাবুরা বেঁচে থাকলে এদেশের ফুটবল, ক্রিকেট, বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি সব ক্ষেত্রে তারকা হয়ে চারপাশ আলোকিত করতেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে বেঁচে থাকার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। সানজিদা, তহুরা, মারিয়ারা তাই সৌভাগ্যবান। ফুটবল খেলে তাঁরা শুধু নিজেদের শৈশবকেই রঙিন করে তুলেনি, জয় করেছে পরিবারের দরিদ্র। এই মিরাকল কিভাবে সম্ভব হলো? বাংলাদেশে যেখানে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে অকালে অনেক মেয়ে শিশুর জীবন সকল সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলে সেখানে এই মেয়েগুলো কিভাবে পারলো সকল বাধা পেরিয়ে এমন বিপ্লব করতে?
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) গত সেপ্টেম্বরে এক রিপোর্টে বলেছে, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিডের প্রাদুর্ভাবে ওই দুই বছর এই বয়সী প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দেশে ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়েদের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ হিসেবে ধরা হয়। সেক্ষেত্রে জরিপ প্রতিবেদনে ১৫–১৯ বছর বয়সী গ্রুপ বিবেচনা করার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বলা হয়। জরিপকালে ১৯ বছর বয়সী বেশ কিছু মেয়েকে পাওয়া গেছে, যাদের বয়স ২০২০ ও ২০২১ সালের শুরুতে ১৮ বছরের নিচে ছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির দুই বছরে ১৫–১৯ বছর বয়সী যে ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম বছর (২০২০) বিয়ে হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশের ও দ্বিতীয় বছর (২০২১) বিয়ে হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস্) ২০১৯ অনুসারে, একই বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। আর ১৮ বছর বয়সের নিচে এ হার ৫১ শতাংশ।
বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলের মেয়েরা কিভাবে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে শারীরিক এবং মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলো, সে বিষয়ে আমাদের জানা থাকা উচিত। কোনো কিছুই হুট করে আসে না। প্রত্যেকটি বড় অর্জনের পেছনে থাকে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও সঠিক বাস্তবায়ন। বাংলাদেশেও নারী ফুটবলে জাগরণের পেছনেও সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
শহীদ শেখ রাসেলের বড় আপা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ২০১০ সালে জাতীয়ভাবে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। এর ধারবাহিকতায় ২০১১ সালে জাতির পিতার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে মেয়েদের জন্য শুরু হয় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে দেশের ৬৫ হাজার। এত বড়সংখ্যক প্রতিষ্ঠান থেকে ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা দল গঠন করে অনুষ্ঠিত এই দুটি টুর্নামেন্ট সফলভাবে প্রতি বছর আয়োজিত হয়ে আসছে। সারাবিশ্বে পরিচিত গ্রাম কলসিন্দুর স্কুলের মেয়েরা এই বঙ্গমাতা প্রাথমিক স্কুল ফুটবলে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। ২০১৯ সালের মে মাসে কলসিন্দুরের মারিয়া, সানজিদাদের সব সনদ মেডেল স্কুলে আগুন লেগে পুড়ে যায়। সেই আগুন কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেগেছিল নাকি কেউ লাগিয়ে দিয়েছিল আর জানা যায়নি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা টুর্নামেন্ট থেকে বাছাই করা মেয়েদের নিয়ে বিশেষ দীর্ঘ মেয়াদি ক্যাম্প শুরু করে বাংলাদেশ ফেডারেশন। রাষ্ট্রের সঠিক পরিচর্যা পেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও যে বিশ্বজয় করতে পারে তার বড় উদাহরণ এই সানজিদা, মারিয়া ও রুপনারা। এই দিক থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেল থেকে অনেক সৌভাগ্যবান আজকের শিশুরা। তাঁরা বেঁচে থেকে নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। ৫০ বছরে শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে বাংলাদেশের অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। দেশে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। স্বাধীনতার সময় শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪১, এখন তা ২১। অর্থাৎ, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা বিনা বেতনে পড়াশুনার পাশাপাশি সরকার থেকে নগদ অর্থ সহায়তা পাচ্ছে, বই ফ্রি পাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্প-তৃতীয় পর্যায়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের উপবৃত্তি ও কিটস অ্যালাউন্স বাবদ ৮৬৪ কোটি ২০ লাখ ৩ হাজার ৫০০ টাকা সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে বিতরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার একটা দুর্দান্ত প্রকল্প পরিকল্পনা করেছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী সব শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে স্কুল মিল কার্যক্রমের আওতায় এনে তাদের শিক্ষা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় অবদান রাখতে প্রকল্পটি পরিকল্পনাধীন। প্রাথমিক ও গণসংখ্যা মন্ত্রণালয় ছাড়াও শিশুদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। অনেক সফলতার মধ্যে আমাদের ব্যর্থতাও কম নয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে যাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। বাংলাদেশে ১০ লাখেরও বেশি পথশিশু রয়েছে। শিশুদের একটা বড় অংশ শৈশবে নিপীড়নের শিকার হয়। অনেক শিশু ধর্ষণ এবং বলাৎকারের শিকার হয়। শহরগুলোতে শিশুদের খেলার জায়গা কমে যাচ্ছে। পার্কের অভাব, শব্দদূষণ, ধুলাবালি, নানাবিধ দূষণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে দেশের রাজধানীসহ অন্যান্য শহরগুলো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের পথে শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ নির্মাণ হোক জাতীয় শেখ রাসেল দিবসে সকলের অঙ্গীকার।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়