স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতখানি এগিয়েছে? অফিসগুলোর শান শওকত, টক শোর বাড়বাড়ন্ত, সাংবাদিকদের নানাবিধ সাংগঠনিক তৎপরতা, ক্রমশ সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া পত্রিকা আর টিভি চ্যানেল ইত্যাদি দেখে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশ উন্নতি লাভ করেছে। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্প বেশ অগ্রসরমান। অনলাইন এবং টেলিভিশন চ্যানেলের আধিপত্যের এই সময়েও বাংলাদেশে নতুন নতুন প্রিন্ট সংবাদপত্র বের হচ্ছে। নিশ্চয় সম্ভাবনা আছে বাজার ধরার এবং সসম্মানে টিকে থাকার। না হলে কেনই-বা নতুন পত্রিকা আর টিভি চ্যানেল আসবে? বাংলাদেশে বর্তমানে বাংলাদেশে অনুমোদিত বেসরকারি টিভি চ্যানেল ৪৫টি। তবে ৪৫টি চ্যানলের মধ্যে বর্তমানে ৩০টি পূর্ণ সম্প্রচারে রয়েছে, বাকিগুলো সম্প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে এবং সরকারি টিভি চ্যানেল রয়েছে আরো ৪টি । অনলাইন এবং অফলাইন মিলে মোট পত্রিকার সংখ্যা কত, এটা সরকার বাহাদুর নিজেও বলতে পারবে না। সংখ্যাগত দিক থেকে গণমাধ্যমের এমন ক্রমবর্ধনশীল পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে এমন সাংবাদিকতার মুখোমুখি আমরা হই যে হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না। হাতে বুম আর সাথে ক্যামেরা থাকলেই কি সাংবাদিক হওয়া যায়? এই পেশায় কাজ করা খুবই সহজ? বিস্তর পড়াশুনা না করে, যথাযথ প্রশিক্ষণ না নিয়ে, প্রতিদিন না শিখে কি এই পেশায় কাজ করে ফেলা যায়?
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মতো জটিল এবং কঠিন কাজের কথা আমি বাদ দিলাম। সাধারণ ইন্টার্ভিউ নিতে গিয়ে মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের কেউ কেউ এমন সব প্রশ্ন প্রকাশ্যে করছেন যে, সাংবাদিকতার একজন শিক্ষক হিসেবে আমাকে দশবার ভাবতে হচ্ছে। সর্বশেষ একটি সাক্ষাৎকারে দেশের এক জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় নারী ফুটবলার সানজিদাকে জিগ্যেস করছেন তিনি ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত কয়টা প্রেম করেছেন! সানজিদারা জন্মের পর থেকে অতি দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে, সমাজের রক্তচক্ষুকে জয় করে অনেক পরিশ্রম করে আজ বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। এমন সংগ্রামী একজন ফুটবলারকে সাংবাদিক জিগ্যেস করছেন, তিনি ছোটবেলা থেকে কয়টা প্রেম করেছেন? সানজিদা যদি ধনীর দুলালিও হতেন, তবু কি তাঁকে এভাবে প্রশ্ন করা যেত? আচ্ছা সানজিদার বয়স কত? সাফ জয়ী নারী ফুটবল দলের সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় সাবিনার বয়স সবে ২৮। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা নারী ফুটবলার সাবিনা বাদে বাকি সবারই বয়স এ বছরের শুরুতেও ছিল ১৭/১৮/১৯। শুনতে একটু কেমন জানি লাগে! তবে এটা সত্য যে আমাদের সাফজয়ী কন্যাদের অনেকেই এই বছরের শুরুতেও শিশু ছিলেন! হ্যা। সানজিদারা কদিন আগেও শিশু ছিলেন। কারণ বাংলাদেশের জাতীয় শিশুনীতিতে ১৮ বছরের কম ছেলেমেয়েদেরকে শিশু বলে অভিহিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ১৮ বছরের কম বয়সের সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করে। বেসরকারি চ্যানেলের নাম উল্লেখ না করাই সমীচীন হবে। তবে সে সাক্ষাৎকারের সানজিদাকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল সে গুলো আমরা একটু দেখে নিই। সাংবাদিক সানজিদাকে জিগ্যেস করছেন সানজিদার প্রিয় নায়ক কে? জায়েদ খান নাকি শাকিব খান? সানজিদা যেভাবে এক্সপ্রেশন দিয়েছেন তাতে জায়েদ খান আর শাকিব খান কষ্ট পেতে পারেন। তারচেয়েও দুঃখজনক সাংবাদিক নিজে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তরের অপশন দিয়ে দিচ্ছেন! জায়েদ খান বা শাকিব খান যেমনই ‘নায়ক’ হওন না কেন, সানজিদার মুখ দিয়ে তাঁদের নামে কিছু বের করার অপকৌশল সাংবাদিক কেন নিবেন? সানজিদা কিন্তু সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা পরানের কথা বলেছেন। টাইটানিক সিনেমার নায়ক-নায়িকার কথা বলেছেন। এরপরেও সাংবাদিক নামের ঐ লোকটি সানজিদাকে জিগ্যেস করছে তার প্রিয় নায়িকা কে? বুবলি নাকি অপু বিশ্বাস? সানজিদা আবার বিব্রত হয়ে সাংবাদিককে এই প্রসঙ্গ বাদ দিতে বলেছেন। মুভি নিয়ে ঐ সাংবাদিকের সামান্যতম জ্ঞান থাকলে সানজিদাকে দামাল সিনেমা নিয়ে কথা বলতে পারতেন। ঐ সাংবাদিক সানজিদাকে জিগ্যেস করছেন শাহরুখ খানের সাথে অভিনয়ের সুযোগ পেলে করবেন কি না? শাহরুখ খান সানজিদার সাথে কিংবা সানজিদা শাহরুখ খানের সাথে অভিনয় করতে যাবেন কেন? সানজিদাদের বীরোচিত উত্থান নিয়ে সিনেমা হতে পারে। ভারতের নারী হকি দল নিয়ে যেমন ‘চাক দে’ হয়েছে। বাংলাদেশে নারী ফুটবল জাগরণ নিয়ে অবশ্যই সিনেমা হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দামাল মনে হয় ধামাল সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় মেয়েদের ফুটবল নিয়েও কোনো না কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা ভাবছেন। তাই বলে শাহরুখ খানের সাথে সানজিদা কেন অভিনয় করতে যাবেন? সানজিদা আমাদের একজন ফুটবলার। তার কাজ ফুটবল খেলা। ঐ চ্যানেলের সাংবাদিক সানজিদাকে আরও ভয়ংকর প্রশ্ন করেছেন। যে প্রশ্ন করে আমাদের মেয়েদেরকে বারবার গ্রামেগঞ্জে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে, শহরে, বন্দরে বিব্রত করা হয়। যে প্রশ্ন করে মেয়েদেরকে থামিয়ে দেওয়া হয়, তার ভেতরকার শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। সানজিদার বর্তমান বয়স সম্ভবত ১৯। সবে মাত্র সাফ জিতল। বাংলাদেশের এই মেয়েরা বাংলাদেশকে এখন এশিয়া কাপে নিয়ে যাবে। সাবিনার বয়সে যেতে যেতে এরা হয়ত বিশ্বকাপেও যেতে পারে। এই প্রত্যাশা বাড়াবাড়ি নয়। কারণ এই দলটি সাউথ এশিয়ান লেভেল থেকে বেশ উঁচুতে চলে গেছে। এর প্রমাণ হলো এই দলটি ভারত, নেপাল এবং মালদ্বীপকে বড় ব্যাবধানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং কোনো ম্যাচেই মনে হয়নি বাংলাদেশ হারতে পারে। বাংলাদেশ বয়সভিত্তিক দলের খেলায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দলের চেয়েও ভালো ফুটবল খেলছে। র্যাঙ্কিংয়ে ৬১ ধাপ এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়াকে ৬–০ গোলে হারানোর রেকর্ড আছে বাংলাদেশের। আরেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ১৬ বছর বয়সী মেয়েদেরকে ২ গোল দিয়ে ড্র করেছিল। সেই ম্যাচ না দেখলে বিশ্বাস হবে না। অস্ট্রেলিয়ার উন্নত দেশের মেয়েরা বাংলাদেশের মেয়েদের সাথে দৌড়ে পারছে না। বল কন্ট্রোলে পারছে না। তহুরা দুই গোল দিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়াকে। সানজিদাদের দিয়ে মেয়েদের ফুটবল বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করাও সম্ভব। সেখানে এই চ্যানেলের সাংবাদিক সানজিদাকে জিগ্যেস করছে তিনি বিয়ে করবেন কবে? সানজিদা বরং দুর্দান্ত এক উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন দেশকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে তাঁদের। সাবিনা হয়ত আর ৫ বছর খেলবেন। এরপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিটনেস ধরে রাখা কঠিন হবে। কিন্তু অন্য মেয়েরা কমপক্ষে ১০ বছর খেলবে। ১০ বছরে এই মেয়েরা একসাথে খেললে আর এর চেয়ে বেশি পরিশ্রম করলে, নিবিড় প্রশিক্ষণ পেলে কেন বিশ্বকাপে খেলতে পারবে না? কিন্তু সাংবাদিক যদি এমন প্রশ্ন করেন তাহলে তো মেয়েদের এই অগ্রযাত্রা এখানেই থেমে যাবে। সাংবাদিক হয়ত বুঝতেই পারছেন না সানজিদার মনে কী বিষ তিনি ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন! সমাজের প্রায় সবাই মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে হামেশা ওকালতি করে। সেখানে একজন সাংবাদিকতার মতো মেধা ও পরিশ্রমভিত্তিক পেশায় থেকে একজন শহুরে লোক সানজিদাকে জিগ্যেস করছে কবে তিনি বিয়ে করবেন! আরেকটা প্রোগ্রামে খেলার চ্যানেলের সাংবাদিক ক্যামেরায় আড্ডা দিচ্ছেন ঋতুপর্ণ চাকমা, মারিয়া মান্ডা আর সাবিনার সাথে। সেখানে ঋতু চাকমাকে একজন সাংবাদিক জিগ্যেস করছেন তার রূপের রহস্য কী? খেলার সাথে রূপের সম্পর্ক খুবই কম। রূপ দিয়ে খেলাধুলা হয় না। তাছাড়া কয়েকজন মানুষের সামনে সুনির্দিষ্ট একজনকে তার রূপ নিয়ে প্রশ্ন করা কি খুব যৌক্তিক? ঋতুকে বলা হচ্ছে তিনি এক মিনিট হাসবেন আর সেই হাসি সবাই বসে দেখবেন!
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট এর বদৌলতে দেশব্যাপী মেয়েদের ফুটবল জাগরণ হলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাছাই করা মেয়েদের নিয়ে আসে বিশেষ ক্যাম্পে। দীর্ঘদিন এক সাথে রেখে নিবিড় প্রশিক্ষণের ফলে এই মেয়েদের মধ্যে একটা ক্ষুধার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করার ক্ষুধা । মেয়েদের ফুটবলে এগিয়ে চলা মনে অনেক কিছু। দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে হলে মেয়েদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। এই মেয়েদের দেখেই সারা বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এরা যত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশও তত এগিয়ে যাবে। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে যে সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব না, তার চেয়ে অনেক দামি কিছু এনে দিয়েছে এই সামান্য বেতনের আমাদের জাতীয় বীর কন্যারা। এরা এখন ইউরোপে ফুটবল খেলার ডাক পাচ্ছে। ফুটবল খেলে দারিদ্র্য জয় করা শিখছে। এই আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে গণমাধ্যমকে খুবই সাবধানী ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েদের মনযোগটা রূপচর্চা, বিয়ে, মডেলিং, ফ্যাশন এগুলোর দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান হতে পারে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। শেয়ার ব্যবসা, খামার, রেস্টুরেন্ট, মডেলিং ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় সাকিব আজ রঙিন দুনিয়ায় সপ্রতিভ কিন্তু বাস্তবে খেলার মাঠে ক্রমশ বিতর্কিত আর ম্রিয়মাণ। টাকা আর গ্ল্যামারের লোভ পেয়ে বসলে আমাদের নারী ফুটবল দলও হারিয়ে যেতে পারে সামনে। বাফুফে নিশ্চয় মেয়েদের বেতন বাড়াবে। সেনাবাহিনী প্রধান ইতোমধ্যে এদের সবাইকে তাঁর বাহিনীতে চাকরির অফার দিয়ে রেখেছেন। তিন বাহিনীতে আমাদের ফুটবলাররা ঢুকে গেলে এদের পরিবার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো পরিস্থিতি পাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এদের সবাইকে জায়গা এবং বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নারী ফুটবলারদের সবারই আর্থিক উন্নতি হচ্ছে, হতেই হবে। কিন্তু সবাই মিলে এদের মাথা নষ্ট করে দিলে ফুটবলের গণজাগরণ এবং নারী জাগরণ থেমে যেতে পারে। এই জাগরণ কখনোই থেমে গেলে চলবে না। গণমাধ্যমই গণজাগরণ সৃষ্টি করবে, তবে সাবধানে। তবে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বোধ হয় বাফুফের। মেয়েদেরকে মিডিয়া এবং মিডিয়াকে মেয়েদের সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার দায়িত্ব ফুটবল ফেডারেশনকে পালন করতে হবে সুচারুভাবে।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়