জাতীয় জীবনে শনিবার যেন শনি ডেকে এনেছে! কোথাও স্বস্তি নেই! আজ মন খারাপ বাংলাদেশের। শুক্রবার দিনটি শেষ হওয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশ স্তম্ভিত জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে, সরকারি ভাষায় যেটিকে বলা হয় সমন্বয়! অকটেন, পেট্রল, ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারপ্রতি ৪৬, ৪৪ ও ৩৪ টাকা করে বাড়তি গুনতে হবে ভোক্তাকে। এর প্রভাব পড়বে পণ্যের বাজারে। সব পণ্যই বেশি দামে কিনতে হবে বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৫১ লাখ মানুষকে!
এই ‘জাতীয় দুশ্চিন্তা’ মাথায় নিয়ে মানুষের বড় অস্বস্তিতে কেটেছে রাতটা! সচেতন মানুষ মাত্রই তীব্র প্রতিক্রিয়ার ডালি নিয়ে বসে আছেন, খুব কম মানুষই অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখান। কারণ দিন শেষে লাভ নেই, কে শোনে কার কথা! এমন একটি দিনের প্রাক্কালে মন ভেঙে দেওয়া এক হার দেখেছে বাংলাদেশ হারারেতে। যে দলটির বিপক্ষে ওয়ানডেতে হেসে-খেলে জেতাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, সেই জিম্বাবুয়ের কাছে হারতে হয়েছে টানা ১৯ ওয়ানডে জয়ের পর। জাতীয় জীবনে ক্রিকেট যে কিনা স্বস্তির খবর দেয় মাঝেমধ্যে, সে-ও যেন তেলেসমাতির খবর জেনে গিয়েছিল আগে-ভাগেই। আর তাই তো ৩০৩ রানের পাহাড়ে চেপেও পরাজয়ের তিলক। এই ‘রানের পাহাড়’ শব্দটার সঙ্গে আপনি মেলাতে পারেন এ দেশের ফুলে-ফেঁপে ওঠা অর্থনীতিকেও। পদ্মা সেতু হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, পাতাল টানেল হচ্ছে, কিন্তু দিন শেষে সাধারণের ভাগ্যে ওই পরাজয়ের বেদনা! মূল্যস্ফীতির চাপে ভেতো বাঙালি আজ চিড়েচ্যাপ্টা, ‘ইমপ্যাক্ট’ চারদিকে শুধু হতাশা আর হতাশা!
এ দেশের ক্রিকেটাররা এই ‘ইমপ্যাক্ট’ শব্দটিকে দারুণ বোঝেন! তারা সবাই ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার হতে চান, দেশকে সাফল্য এনে দিতে চান, যেন এ দেশের মানুষ একটু স্বস্তি পায় তার নিরানন্দ জীবনে! এই যেমন জিম্বাবুয়ের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে নতুন টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান বলে গিয়েছিলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ‘ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার’ হতে চান। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘প্রভাবক ক্রিকেটার’। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন কী? সিকান্দার রাজা ও রায়ান বার্ল এমন দুটি ‘ইমপ্যাক্ট ইনিংস’ খেললেন, যার ধারেকাছে নেই বাংলাদেশি কোনো ক্রিকেটার, ফল টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো জিম্বাবুয়ের মতো দুর্বল একটি দলের কাছে সিরিজ হার। এখন আসি তরুণদের কথায়। আপনি বাংলাদেশ দলে যেকোনো তরুণকে জিজ্ঞাসা করবেন, সে কার মতো হতে চায়? একবাক্যে—সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, মাশরাফির যে কারও নাম বলে দেবে। কিন্তু তাদের মধ্যে এখনো যারা খেলছেন, তারা কি আর প্রভাববিস্তারী ক্রিকেটার আছেন? সেই প্রসঙ্গ এখন উঠতেই পারে। প্রথম ওয়ানডেতে তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ প্রত্যেকেই রান পেয়েছেন, কিন্তু কেউ ট্যাক্টফুল বা কৌশলী ইনিংস খেলতে পারেননি, যা দলের কাজে লাগে। খেলেছেন নিজের জন্য, দলের জন্য নয়। আর তাই তো সিকান্দার রাজা ও ইনোসেন্ট কায়ার ওপর ভর করে তিন শ স্কোর পার হয়েছে জিম্বাবুয়ে, আর ক্রিকেট আকাশে বাংলাদেশকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। শুধু টি-টোয়েন্টি নয়, টাইগাররা তাদের প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতেও এখন ৫, ৬ ও ৭ নাম্বারে ‘ইমপ্যাক্ট ক্রিকেটার’ খুঁজে পাচ্ছে না! যেটা জিম্বাবুয়ের মতো দলও খুঁজে পেয়েছে সিকান্দার রাজা-রায়ান বার্লদের মাঝে।
টাকার অঙ্কে এই জিম্বাবুয়ে বড়ই দুর্বল এক ক্রিকেট বোর্ডের অধিকারী, সেখানে বিসিবি পৃথিবীর শীর্ষ চার ধনী বোর্ডের একটি। অথচ আজ টি-টোয়েন্টিতে একটি কার্যকর দল গড়ার মতো ক্রিকেটার নেই, ওয়ানডেতেও সাকিব না থাকলে একটা ব্যালান্স একাদশ নামানো কঠিন হয়ে পড়ছে, আর টেস্ট ক্রিকেটে খুবই দুর্বল এক দল এই বাংলাদেশ। ক্রিকেটের কাঠামো-পরিকাঠামো নিয়ে ছেলেখেলা, স্বজনপ্রীতি আর পাওয়ার পলিটিকসের ফল এটি।
টাইগার ক্রিকেটের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির একটি জায়গায় দারুণ মিল। বিসিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি প্রতিষ্ঠানই তাদের টাকশাল নিয়ে একসময় গর্ব করত, আজ দুটিই খেলো, অন্তঃসারশূন্য; কারণ তা সিস্টেমে কোনো পজিটিভ ইমপ্যাক্ট রাখতে পারেনি বরং সংকট বাড়িয়েছে। সরকার ও বিসিবি জানে কোথায় সমস্যা, কোথায় দুর্নীতি; কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে সাধারণ মানুষের পকেটে টান পড়বে, ক্রিকেটের দুর্গতি দেখে সাধারণের মন পুড়বে, এটাই এখন নিয়তি!
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন