আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক ধারণা হলো, জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় পুনর্জন্মের উৎস হতে পারে যুদ্ধ। ১৯১৪ সালে এই বিভ্রমের পরিণতি ভোগ করে ইউরোপ। তখন এই প্রলাপ দিয়ে একদল ইউরোপীয় উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী একটি প্রজন্মকে প্রলুব্ধ করেছিল, সেই বিভ্রমে ডুবে বিসর্জন দিয়েছিল বহু তরুণ প্রাণ। এই আন্তঃযুদ্ধ মূলত ফ্যাসিবাদী ও নাৎসি মতাদর্শের জন্ম দেয়।
এই ধারণা যে কতটা বিপথে নিতে পারে, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তবে ভিন্ন রূপ দেখেছে ব্রিটেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে রক্ষণশীল, শ্রম ও উদারপন্থীদের জাতীয় ঐক্য সরকার করে গড়ে ওঠে, ব্রিটিশ কল্যাণ রাষ্ট্রের পেছনে জাতীয় ঐকমত্যের সূচনা হয়, যা আজ অবধি টিকে আছে।
দমনমূলক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা, বিরোধীদের দমন, প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে বাধা ও জনসমর্থন অর্জনের জন্য যুদ্ধকে ব্যবহার করে বিপন্ন শাসনব্যবস্থা। (যেমন সত্যিই পুতিন ইউক্রেনে করছেন)। এর আংশিক ফল হলো- যুদ্ধ কেবল জাতীয় বিভাজন, ঘৃণা ও চরমপন্থার মতাদর্শকে শক্তিশালী করে তোলে।
মনে হতে পারে পশ্চিমা গণতন্ত্র রক্ষা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ একইভাবে সম্পর্কিত; এই ধারণাটি অযৌক্তিক। তারা নিজেরা লড়াই করছে না, অর্থনৈতিক স্বার্থেও খুব বেশি ছাড় দিচ্ছে না। তবু এই প্রলাপ অনেক প্রলোভন সৃষ্টি করছে, পশ্চিমা উদারপন্থীরা নিজেদের কিছু সংস্কারের জন্য মরিয়া হয়ে আছেন; আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার মতো পর্যবেক্ষকও এই বিভ্রমের ভুক্তভোগী।
ফুকুইয়ামার মতে, ইউক্রেনের যুদ্ধ আমেরিকান জনগণকে প্রভাবিত করবে, যদি ভ্লাদিমির পুতিন সফল হন, তাহলে আমেরিকায় গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলোও সফল হবে। আমি আপনাকে বলতে পারি, যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে; পুতিন নির্ধারকভাবে পরাজিত হবেন। এর ফল দাঁড়াবে পুতিনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী পপুলিস্ট আন্দোলনের পালে বাতাস লাগবে, সঙ্গে বিশ্বজুড়ে উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের পুনর্জন্ম হবে।
বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে গেলে এটি অর্থহীন আলাপ। যেমনটি ফুকুইয়ামা নিজে অন্যত্র লিখেছেন, আমেরিকায় গণতান্ত্রিক পতনের কারণ (ভিন্ন হলেও ইউরোপেও একই সমস্যা); পরিচয়ের রাজনীতি, বর্ণবাদ, অভিবাসন সমস্যা, আর্থসামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক মেরুকরণের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব গভীরভাবে প্রোথিত। পুতিন ক্ষমতায় আসার আগে থেকে আমেরিকায় এসব সমস্যার সৃষ্টি, যা কয়েক দশক ধরে চলমান। রাশিয়ার পরাজয়ের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান আসবে না, ইউক্রেনে যুদ্ধের মাধ্যমেও তাদের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অভিবাসন ও জাতীয় ঐক্যসংক্রান্ত ইউরোপিয়ান গণতন্ত্রের গভীর বিভাজন সমাধানের কোনো ফল ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আসবে না।
আমেরিকান গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন ফুকুইয়ামা। তার মতে, সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন অনুভূতি তৈরি করতে পরিচয়ের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মৌলবাদের আগ্রাসন কমাতে হবে; বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান; অভিবাসন নীতিতে যুক্তিসংগত আপস; অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে চুক্তি; আর্থসামাজিক বৈষম্য কমাতে সাধারণভাবে সম্মত নীতি গ্রহণ করতে হবে। মার্কিন সংবিধানের অস্পষ্ট ও অসংস্কারযোগ্য বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন তিনি।
ইউক্রেনের যুদ্ধ কি মার্কিন রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব সমস্যা সমাধানের দিকে অগ্রসর করছে? একেবারেই না। যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রকৃত ঐক্যের সূত্রপাত তৈরি করেছে, উভয়ের সম্মতিতে সামরিক শিল্প গঠনে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয়কে এক ধরনের জাতীয় শিল্পোন্নয়ন বলা যেতে পারে, যদিও তারা এটি প্রকাশ্যে বলতে সাহস দেখায় না; তবে মাঝে মাঝে রিপাবলিকানরা এটি স্বীকার করেন। যদি তাই হয়, তবে এটি অযৌক্তিকভাবে অপচয়কারী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভুল নির্দেশিত পরিকল্পনা।
উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের ঠাণ্ডা যুদ্ধকে গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখা এক বিশাল বিভ্রান্তি। যেমনটি ম্যাট ডাস ও সেন বার্নি স্যান্ডার্সের মতো শীর্ষ বৈশ্বিক নীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন; ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এই যুগের জন্য নতুন দৃষ্টান্ত বিকাশের পরিবর্তে নীতিনির্ধারকরা কেবল পুরোনো ‘আমাদের বনাম তাদের’ শীতল যুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে আছেন। দুঃখজনকভাবে বিপরীতমুখী নীতির প্রচার করতে ৯/১১-এর পরের সময়ের ক্ষণস্থায়ী ঐক্যের বোধকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ফুকুইয়ামা যে ধরনের সংস্কারের কথা বলেছেন, ঠিক তার বিপরীতে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সহায়তা প্যাকেজ ও পেন্টাগনের বাজেট বৃদ্ধি আমেরিকান সম্পদের বিচ্যুতি প্রকাশ পায়। ফুকুইয়ামা বলেছিলেন, অবকাঠামোগত পুনরুদ্ধার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী মেরামত করার কথা।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাত অত্যাবশ্যকীয়, কিন্তু তা পশ্চিমা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা তো দূরের কথা বরং অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিশাল সুবিধাজনক বিভ্রান্তি হিসেবে কাজ করছে। অভিজাত সুইডেন বিষয়টিতে সহজ ও সান্ত্বনাদায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে, তা তাদের সিদ্ধান্ত দেখে বোঝা যায়; অভিবাসন সমস্যা, অপরাধ বৃদ্ধি ও অন্যান্য সামাজিক যন্ত্রণাদায়ক কঠিন সমস্যার সমাধান করার বিপরীতে রাশিয়াকে নিজেদের অস্ত্বিত্বের হুমকি হিসেবে নিয়ে ন্যাটোতে যোগ দিতে চায় তারা। দেশে ডানপন্থী উগ্রবাদ বৃদ্ধিসহ এমন সমস্যা বৃদ্ধির পেছনে অভিজাতদের নিজস্ব দায় কি নেই?
সামরিকভাবে বলতে গেলে, ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; এবং এটি সমগ্র ইউক্রেনকে পরাধীন করার জন্য রাশিয়ান প্রচেষ্টা হিসেবে শুরু হয়, যেহেতু রাশিয়ানরা কিয়েভের বাইরে পরাজিত হয়েছিল, যা এখন দেশের পূর্ব ও দক্ষিণে অঞ্চলে সীমিত সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। অবশ্যই ইউক্রেনের জনগণের জন্য এটি অপরাধ, দুঃখজনক ঘটনা ও একটি দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এটা কখনোই বৈশ্বিক গণতন্ত্রের অস্তিত্বের জন্য লড়াই নয়।
ড্যানিয়েল ল্যারিসন উল্লেখ করেছেন, মার্কিন শত্রু ও মিত্রদের মধ্যে স্বৈরাচারী শাসন বিভক্ত। ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদীদের উত্থানের পেছনে অবদান রাখছেন; ফুকুইয়ামা, অ্যান অ্যাপেলবাউম ও অন্যদের এই যুক্তি ভেঙে দিতে সক্ষম ল্যারিসনের উল্লেখিত পয়েন্ট। কোনো গুরুগম্ভীর ব্যক্তি কি মনে করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বা মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসির উত্থানে অবদান রেখেছিলেন পুতিন? অথবা ফিলিপাইনে রদ্রিগো দুতার্তে ও ‘বংবং’ মার্কোস? কিংবা ব্রাজিলে জইর বলসনারো? ইউরোপে সবচেয়ে শক্তিশালী উগ্র জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাসহ নির্বাচিত সরকারগুলোর একটি পোল্যান্ডে, যারা সবচেয়ে তিক্তভাবে রুশ-বিরোধী।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সঙ্কটের ইস্যু হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধের আলোচনা ‘অস্তিত্বগত’ শব্দের অর্থকে অবনত করে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সত্যিকারের অস্তিত্ব হুমকিকে অন্যদের কাছে গৌণ হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করে পশ্চিমা বিশ্ব। জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা বিশ্বের কাছে নিজেদের চাকরি, সংস্কৃতি, আচরণ ও ঐতিহ্যগত পদ্ধতির হুমকি হিসেবে দেখে পশ্চিমা নিরাপত্তা এলিটরা।
কিন্তু আমাদের উত্তরসূরিরা কি এখন থেকে এক শতাব্দীর পরে সত্যিই ভাববে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে দনবাসকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের সরকারগুলো পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য সঠিকভাবে কাজ করেছে? তার মানে এই নয় ইউক্রেনকে সমর্থন করা পশ্চিমের উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই উচিত। কিন্তু যারা সত্যিই গণতন্ত্রের গতরকে মূল্যায়ন করে ও প্রয়োজনীয় সংস্কার চায়, তাদের প্রাথমিক, নায্য ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে প্রত্যেকের সমর্থন করা উচিত। বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্য পৌরাণিক সংগ্রামের নামে এই সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
লেখক : আনাতল লিভেন; ব্রিটিশ লেখক, সাংবাদিক ও বৈশ্বিক নীতি বিশ্লেষক।
(কলাম স্বত্ব : রেসপন্সিবল স্টেটক্র্যাফট। অনুবাদ : গোলাম আনোয়ার সম্রাট)