• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাধীনতার ঘোষণা ও ৭ ই মার্চের ভাষণ


মিল্টন বিশ্বাস
প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২২, ১১:৫২ পিএম
স্বাধীনতার ঘোষণা ও ৭ ই মার্চের ভাষণ

৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী জোসেফ সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য।’প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সামগ্রিক ইতিহাসের পটভূমিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে উল্লিখিত স্বাধীনতার তাৎপর্য অনেক আগেই জাতির পিতার কণ্ঠে একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে। ১৪ খণ্ডের সিক্রেট ডকুমেন্টেসের প্রকাশিত ১০টি খণ্ডের মধ্যে সপ্তম থেকে (১৯৬২-৬৩) দশম খণ্ডের(১৯৬৬) বিবরণসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় একাধিক জায়গায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বিশেষত দশম খণ্ডে বর্ণিত দেশব্যাপী ৬-দফার পক্ষে সমাবেশ সভাগুলোতে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠে সরাসরি স্বাধীনতার কথাই শোনা গেছে।

তবে ১৯৭১ সালের মার্চের পটভূমি ছিল পুরোটাই আলাদা। আর সেকারণেই ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের এই বহুধা বিভক্ত সমাজ-রাজনীতির আঙিনায় প্রাণের আনন্দদায়ক সংবাদ খুব বেশি আসে না। কারণ এই সমাজে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে বিকৃত করার পাকিস্তানি চেতনাধারী লোকের সংখ্যা এখনও অনেক। তবু আন্তর্জাতিক খ্যাতি বয়ে এনেছে জাতির পিতার অবিস্মরণীয় ভাষণ। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। যে তালিকার মাধ্যমে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে সেখানে বঙ্গবন্ধু তখন থেকে আরো ঔজ্জ্বল্য নিয়ে মূর্ত। আসলে বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেস্কো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিকভাবে প্রভাব থাকতে হয়। ২০১৭ সালের ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসেছিল আন্তর্জাতিক এডভাইসরি কমিটি। সেখানেই  সিদ্ধান্ত হয় ৭ মার্চের ভাষণকে অন্তর্ভুক্ত করার। এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বের মোট ৪২৭টি নথি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডে যুক্ত হয়েছে। এর আগে পৃথিবীর অন্যতম একটি ভাষণ হিসেবেও এটি স্বীকৃতি পেয়েছে। Jakob F. Field  সম্পাদিত We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইতিহাসের অন্যতম ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই দুই বৈশ্বিক স্বীকৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।

 

২.

চড়ূান্তভাবে স্বাধীনতার বাণী ধারণ করার জন্য বিশ্বব্যাপী ৭ই মার্চের ভাষণ বারবার স্বীকৃতি পেয়েছে। আসলে একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির নিয়ন্তা। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে উচ্চারিত- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ছিল তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের উত্থান-পর্বের শেষ শীর্ষবিন্দু। এই ভাষণেই তিনি সমস্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলার মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের সেই সশস্ত্র প্রত্যয়ই ঘোষিত হয়েছিল। এমনকি ‘আমি যদি না-ও থাকি’ কিংবা ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি’ উচ্চারণের মধ্যে ছিল জাতির মুক্তি আন্দোলনে নিবেদিত অন্যান্য নেতাকর্মী ও আপামর জনতার ওপর নির্ভর করার আত্মবিশ্বাস।

একারণেই ১২ মার্চ কর্নেল এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে অবসরপ্রাপ্ত কয়েক হাজার সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ গ্রহণ এবং ২০ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের ৫শ ছাত্রছাত্রী নিয়ে গঠিত গণবাহিনীর ১০ দিনের ট্রেনিং শেষে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিক্রিয়ারই অংশ। অর্থাৎ সেদিন মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যে জনগণ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঙালিদের যে করতে হবে তাও তাঁর দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। মূলত উত্তাল মার্চের বাংলাদেশের প্রথম শাসক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি জান্তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে যে দ্রোহের আগুনে বাঙালি জাতি সেদিন জেগে উঠেছিল তার কেন্দ্র ভূমির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর নির্দেশ ছিল আদেশের মতো, আপামর জনগোষ্ঠী তা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল; বিশ্ববাসীর সামনে তাঁর প্রতি বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত আস্থা ছিল বিস্ময়কর। কারণ তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হতে তখন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। আর ঘটনার বিচিত্র আবর্তে ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন নেতা। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতির দর্শন ছিল মানবপ্রেম। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতে আছে সেই প্রত্যয়- ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্বদিন পর্যন্ত দেশের গণমানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তাঁর রাষ্ট্রনীতি। তিনি সবসময় শোষিতের মুক্তি কামনা করেছেন। আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সকল অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচিতেও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।’ সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য ধৈর্য ধরে কাজ করার কথাও বারবার উল্লেখ করেন। আত্মজীবনীর বিবরণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হন। তিনি বলেছেন, দেশভাগের পর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও ছয়দফা পর্যন্ত যদি বাংলার রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করো, তাহলে দেখবে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলার সুপ্ত চেতনার জন্ম সাতচল্লিশের বাংলাভাগের আগেই এবং সেই চেতনারই প্রথম বহিঃপ্রকাশ আটচল্লিশ সালেই অসাম্প্রদায়িক ভাষা-আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। আর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কেবল আন্দোলন নয় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বও তাঁর। রাজনীতি করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নানা সমস্যা ও সংকটময় পথ পরিক্রমা করতে হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন তিনি সাহসের সঙ্গে; পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন দৃঢ় চিত্তে। তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির কবি-‘রাজনীতির প্রকৌশলী নন মুজিব, মুজিব হচ্ছেন রাজনীতির কবি, বাঙালির স্বাভাবিক প্রবণতা প্রায়োগিক নয়, শৈল্পিক। তাই মনে হয়, বাংলাদেশের সকল মানুষ, শ্রেণি ও মতাদর্শকে এক সূত্রে গাঁথা হয়ত কেবল মুজিবের মতো রাজনৈতিক কবির পক্ষেই সম্ভব।’

 

৩.

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ’ উত্থানের পিছনে একাত্তরের মার্চ থেকে জেগে ওঠা বিদ্রোহী বাংলার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ’ করা হয়। সেখানে স্পষ্ট উচ্চারণে বলা হয়-‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।’ স্বাধীন বাংলার মহান নেতা হিসেবে স্বীকৃত বঙ্গবন্ধুকে এদেশের জনগোষ্ঠী কেবল নয় বিদেশি শাসকসহ পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা উপেক্ষা করতে সাহস দেখায়নি। বরং জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন দেখে এই মহান নেতার দ্বারস্থ হয়েছে বারবার। কারণ মার্চের প্রথম দিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো দেশ চলতে শুরু করেছিল। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ই মার্চের ভাষণটিকে কেন্দ্র করে দশ লাখেরও বেশি মানুষের সেই সমাবেশ মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ভুট্টো গংদের বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্ব মেনে নিতে হতো। সেটা না মানার জন্যই পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো বলেছিল তাদের দল বাদ দিয়ে অধিবেশন বসলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব নিথর করে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া তার হুমকির কাছে মাথা নত করে। আর তার ঘোষণার পরে বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পদ্মা- মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এসব স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশ তখন মিছিলের সমুদ্র। বঙ্গবন্ধু জানান বিনা চ্যালেঞ্জে তিনি কোনো কিছুই ছাড়বেন না। ছয়দফার প্রশ্নে আপস না করারও ঘোষণা আসে। ১ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলতে থাকে। ছাত্রলীগ আর ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গণজাগরণের এই পরিস্থিতিতে ৭ই মার্চ ছিল স্মরণীয় দিন। ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে কলকাতার অধুনালুপ্ত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এককালের সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং উপমহাদেশের দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারার দর্শনের প্রভাব অর্থাৎ গান্ধীজির নিরস্ত্র নৈতিক যুদ্ধের আহ্বান এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক দর্শন। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী ধাপেরও নির্দেশ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে। উপরন্তু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য। জনৈক খ্যাতিমান গবেষকের মন্তব্য, ‘বাঙালির মুক্তির সনদ ছিল এই ভাষণটি। এই দিনই রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তানকে বাঙালিরা প্রত্যাখ্যান করে।’ এই ‘রাজনীতির কবি’র ৭ই মার্চের ভাষণই একটি মহাকবিতা। পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে বারবার। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণআন্দোলন সংঘটিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। ৭১-এর প্রথম মাস জানুয়ারি থেকে তিনি মুক্তিকামী মানুষের শৃঙ্খল মোচনের শপথে উদ্দীপিত করেন সাধারণ মানুষকে- রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবী মহলের প্রত্যেককে; কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক নির্বিশেষ।

মূলত বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন ও ৭ই মার্চের ভাষণই মানুষকে নতুন এক স্বপ্নে আন্দোলিত করে। জাগরণ ও শিহরণে উদ্দীপিত মানুষ মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উৎসাহী হয়। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান বঙ্গবন্ধু। সেই দাবি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তাঁর কথা মতো চলতে নির্দেশ দেন। ফলে সাধারণ রিকশাওয়ালা, পিওন, চাপরাশি থেকে দেশের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত তাঁর নির্দেশ মান্য করা শুরু করেন। সেই মার্চ মাসেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকার করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে সম্প্রচার করতে না দেয়ায় বেতার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনুষ্ঠান বন্ধ করে বেতার ভবন ছেড়ে চলে আসেন। পরদিন ৮ ই মার্চ সকালে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ প্রচার করার অঙ্গীকার করার পরই পুনরায় তারা কাজে যোগদান করেন।

 

৪.

পহেলা মার্চে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চের জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন-‘লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।’ তিনি ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানান। একইদিন পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি সমর্থন করে ছাত্রলীগের নেতারা বলেন- ‘আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।’ ২ মার্চ হরতাল পালনের সময় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন নিহত ও অর্ধশত আহত হলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সে রাতেই ৭ই মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং জনগণকে কয়েকটি নির্দেশ দেন। ৫টি নির্দেশের মধ্যে ৬ মার্চ পর্যন্ত সর্বত্রই হরতাল এবং রেডিও-টেলিভিশন বা সংবাদপত্রসমূহ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বা বিবৃতি পেশ না করলে সেই সব প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত সকল বাঙালিকে সরকারি প্রশাসনকে অসহযোগিতা করতে বলেন তিনি। ৭ই মার্চ বিকালে তাঁর ভাষণ দেয়ার কথাও জানান তিনি। ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৪ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে পল্টনে সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রেখে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু সামরিক জান্তাকে সকল প্রকার খাজনা-কর না দেয়ার আহ্বান জানান এবং বলেন- ‘আমার হুকুম ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবে না।’ তিনি কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, রেল, স্টিমার ও পিআইএ বিমানে কর্মরতদের কাজে না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিব সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

৫ মার্চ ঢাকা থেকে ‘দি টাইমস’-এর সংবাদদাতা পল মার্টিন কর্তৃক এক সংবাদে শেখ মুজিবকে কার্যত বিদ্রোহী পূর্ব বাংলার শাসক বলে উল্লেখ করা হয়। তবে সেদিনই বঙ্গবন্ধু জানান সেনাবাহিনীর গুলিতে অন্তত ৩শ নিহত এবং ২ হাজার লোক আহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতির মধ্যে তাঁর শান্তি বজায় রাখার আহ্বান কাজে দিয়েছিল; মানুষ শান্ত হয়েছিল। মানুষের ওপর পুরো মাত্রায় বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্ব ছিল। তাঁর নির্দেশ পালনে মানুষও সদাপ্রস্তুত থাকত। এজন্যই ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসাবে বলে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে সকাতর মিনতি জানিয়ে ঘোষণা দেয়। কিন্তু পরদিন ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট ঘোষণা ও নির্দেশনা তাঁকে মুকুটহীন সম্র্রাটের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত করে।

৭ই মার্চের ভাষণের পর সারাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে; আর ৮ মার্চ থেকে ৭টি সেনানিবাস বাদে বঙ্গবন্ধুর শাসন সমগ্র প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের শাসন সংহত করার জন্য ৩১টির ওপর নির্দেশ জারি করা হয়। নির্দেশাবলি সমাজের সর্বস্তরে যথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অফিস-আদালত, কলকারখানা, রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ, রেডিও-টিভি সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাসভবন থেকে প্রাদেশিক সরকারের কাজ চলছিল। মূলত সরকারের নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধু দখল করেছিলেন। বাস্তবে একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।  শাসকের প্রতি একে একে আনুগত্য প্রকাশের পালা শুরু হয়। রেডিও-টিভির পর কারাগার কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রধান আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে। ১২ মার্চ সকল সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণের ইচ্ছার কথা জানান। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স বর্জন এবং অন্যান্য কর্মসূচিসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশব্যাপী সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের কাছে খুবই যথার্থ ছিল। ১২ মার্চ লন্ডনের ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় বলা হয়, জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং অন্যান্য মহলের লোকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র মিলিটারি ব্যারাক ও সৈন্যবেষ্টিত বিমানবন্দরের উপর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে বলে মনে হয়। ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতির মাধ্যমে হরতাল অব্যাহত রাখাসহ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশের মধ্য দিয়ে তাঁর সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণের সকল দিক সম্পন্ন হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে প্রহসন চালাতে থাকে।

অন্যদিকে হানাদাররা ২৫ মার্চ এদেশের মানুষের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে। এরই মধ্যে ২১ মার্চ ভুট্টোর ঢাকায় আগমন, ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের প্রতিরোধ দিবস  পালন, ২৪ মার্চ শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনের প্রস্তাব প্রদান, ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ সবই বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্বের বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে। ২৩ মার্চ নিজের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাইজে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই কর্তৃত্বেরই অংশ ছিল। সেসময় মুজিবের নির্দেশ ছিল বাইবেলের বাণীর মতোই পবিত্র। পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগসহ অন্যান্য কর্মসূচি শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। জনগণের সমর্থন নিয়ে সর্বাত্মক ঐক্য সৃষ্টির অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি হয়েছিল এদেশে। একাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্মদিনে বলেছিলেন, ‘আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন।’ সাতকোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য তাঁর সেই সংগ্রাম সফল হয়েছিল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের মধ্য দিয়ে কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে পুনরায় তাঁর সেই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের চেতনা ফিরে এসেছে। তাই ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের মতো শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আহ্বান ২০২১ সালেও জাগে দিকে দিকে।

 

৫.

বস্তুত ১৯৬৯ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- ‘মুজিব প্রকৃতপক্ষেই পূর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্র্রাট।’ ১৯৭১-এর মার্চ মাসে এসে সেই মুকুটহীন সম্র্রাট জনগণের প্রিয় শাসকে পরিণত হলেন এবং দেশ চলতে আরম্ভ করল তাঁরই নির্দেশে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান এজন্যই লিখেছিলেন- ‘আমার ধারণায়, ১৯৭১ সালের পহেলা থেকে ছাব্বিশ মার্চ- এই ছাব্বিশ দিনেই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিলো...।’ কারণ এসময় দেশ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। আর সেসময় থেকেই কর্মনিষ্ঠ, ধৈর্য, সংগ্রামী চেতনা, আপসহীনতা আর অসীম সাহসিকতার জন্য যুগস্রষ্টা নেতা হয়েছিলেন তিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীর, শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহানায়ক, মহামানব হিসেবে চির স্মরণীয় একটি নাম। ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো-এর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ স্বীকৃতি পাওয়ায় এখন সারাবিশ্ব আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে পারছে। এই ভাষণেই জেগে উঠেছিলো পুরো জাতি। এই ভাষণে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয় বাঙালিরা। মু্ক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, আগামীতেও যুগিয়ে চলবে। কারণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোর মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা চূড়ান্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে ৭ ই মার্চের ভাষণেই।

 

লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!