• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে হবে


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম
পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে হবে

ভারতের মহারাষ্ট্রে অসময়ের বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পেঁয়াজ। অভ্যন্তরীণ বাজারে আচমকা পেঁয়াজের দাম ৪০ রুপিতে পৌঁছানোর পর জনমনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে ভারত সরকার আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব রাতারাতি পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। বিষয়টি অদ্ভুত ও বিস্ময়কর। পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ভারতীয় এ সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাবমুক্ত নয় দক্ষিণ এশিয়ার ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশও। ভারত এবারই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কিন্তু নয়। এর আগে গম, চাল এবং চিনি রপ্তানিতেও তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। একই সময়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের দৈন্যদশা দেখে ব্যথিত হতে হয়।

ভুটানে এতদিন ৬০-৭০ নুলট্রামে পেঁয়াজ বিক্রি হলেও নিষেধাজ্ঞার পর তা ১৫০ নুলট্রামে পৌঁছায়। নেপালে তা ২৫০ রুপিতে পৌঁছেছে। শ্রীলঙ্কায় তা ৩০০ রুপি প্রতিকেজি আর মালদ্বীপে তো আরও ভয়াবহ। আমাদের দেশে পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকাও পৌঁছেছে। মুদ্রার এই পাশাপাশি তুলনা দেখে তৃপ্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কম, তা সত্য। তবে ডলারের বিপরীতে মান কম হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের মুদ্রা ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি হিসেবেই চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়ে থাকে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, ২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল সোয়া ২৬ লাখ মেট্রিক টন। ওই বছর পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ৩৩ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ। সমস্যা হলো, ২৫-৩০ শতাংশ পেঁয়াজ সংগ্রহ করার পর নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণে বাকি পেঁয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ সরকার। এক্ষেত্রে ভারতই আমাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে। পরিবহন ও খরচের কথা বিবেচনায় ভারত থেকেই বাণিজ্য করাটা বেশি সুবিধার। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও পেঁয়াজের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল। 

ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে দেশটির সরকার বাজারে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদেরও চলছে রাজনৈতিক সংকট। মূল্যস্ফীতি জনজীবনে বাড়তি চাপ তৈরি করে চলেছে। নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। মূলত যাপিত জীবনে নানা নেতিবাচক পরিবর্তনই এ ক্ষেত্রে দায়ী। এই নেতিবাচকতার পরও বাজারব্যবস্থায় কোনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি। বাজারে নিয়ন্ত্রণের অভাব নতুন কিছু নয়। কদিন আগে কাঁচা মরিচের দাম বাড়ার পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামও বাড়তে শুরু করে। বাজারে অস্বাভাবিক হারে বাড়ে আলুর দাম। সম্প্রতি গরুর মাংসের দাম নিয়েও হুলুস্থুলু কাণ্ড। গরীবের আমিষ বলে পরিচিত পাঙাশ ও তেলাপিয়ার দামও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে শুধু সমন্বয় করছে। তারা প্রত্যাশা করে রাজনৈতিক সমাধান। কিন্তু তার আশাও নেই।

দক্ষিণ এশিয়ার বাজার তার নিজস্ব গতিতে চলে। পশ্চিমা বাজারের মতো নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না। তবে বাজার তদারকির বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া চলে না। বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেই সিন্ডিকেট নামক অদৃশ্য এক ব্যবস্থার ওপর দায় চাপানো হয়। অনেক সময় এই ব্যবস্থার প্রতি দায়িত্বশীল মহলগুলোকে অসহায় আত্মসমর্পণও করতে দেখা যায়। সমাধান আমরা খুঁজে পাই না। সমাধানটি সহজ হতেই পারতো।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করা হয়। বাকি পেঁয়াজ দেশে উৎপাদিত হয়। দেশে বর্তমানে দুই ধরনের পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে মুড়িকাটা বা কন্দ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৭-৮ লাখ মেট্রিক টন। মুড়িকাটা পেঁয়াজ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাজারে আসে। মার্চ এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়। সেই হিসেবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে। পেঁয়াজের বাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটি অচিরেই কেটে যাবে। এখন থেকে আগামী তিন মাস বাজারে পেঁয়াজের সংকট হবে না। এর পরপরই বাজারে আসা শুরু হবে গ্রীষ্মকালীন নতুন পেঁয়াজ। এই পরিসংখ্যানটিই আমরা পেয়েছি সম্প্রতি। চীন ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ এলে সংকট আরও কমবে জানা গেছে।

সমস্যা হলো, বাজারে কত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে এ ব্যাপারে আমাদের পরিসংখ্যান বা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয় না। ব্যবসায়ীরা লাভ করবেন। তা করবেন সহনীয় পর্যায়ে। তদারকি প্রতিষ্ঠান বাজারের তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের সচেতন ও অবহিত করবেন। এভাবেই মূলত বাজারের গতি বজায় রাখা যায়। অথচ আমাদের বাজারে রাজনৈতিক সচেতনতা কিংবা ভোক্তাদের সঠিক তথ্য প্রদানের বিষয়েও কারো আগ্রহ নেই। বিষয়টি সব নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেই সত্য। আমরা চাই বাজারব্যবস্থাকে ঢালাওভাবে সাজানো হোক। তা খুব দ্রুত হবে বলে প্রত্যাশা করতে পারি না। কাজটি সহজ নয়। কিন্তু বাজারে পণ্যের পরিসংখ্যান ও তথ্য আমাদের জানার অধিকার রয়েছে। সঠিক তথ্য জানা থাকলে খুচরা বা পাইকাররা পণ্য ধরে রাখতে পারবে না। ভোক্তা সচেতনতা বাড়ানোর এখনই সময়। জনজীবন পর্যুদস্ত। ভারতের মতো কি রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমাদের বাজারব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাবো না?

লেখক : সাংবাদিক

Link copied!