ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত লেখক অভিজিৎ রায় ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে তাদের সহযোগীরা। ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে, জনাকীর্ণ আদালত প্রাঙ্গণে। জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে পুলিশি প্রহরা থাকা অবস্থায়। ঘটনার তিন দিনেও ওই দুই জঙ্গিকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ, গ্রেপ্তার করা যায়নি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে, পাঁচ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ধরব, ধরে ফেলব, এমনই বার্তা দেওয়া হয়েছে; অগ্রগতি এতটুকু এখন পর্যন্তই!
গত রোববার (২০ নভেম্বর) দুপুরে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড়সংলগ্ন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিজেএম) ফটকের সামনে থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। পুলিশ বলছে, জঙ্গিদের সহযোগীরা পুলিশের চোখে স্প্রে ছিটিয়ে, কিল-ঘুষি মেরে তাদের ছিনিয়ে নেয়। এরপর তারা দুটি মোটরসাইকেলে করে রায়সাহেব বাজার মোড়ের দিকে পালিয়ে যায়।
জঙ্গিরা পুলিশের চোখেমুখে স্প্রে মেরে, কিল-ঘুষি মেরে সহযোগীদের নিয়ে পালিয়ে গেছে। খুব সাধারণ এই কৌশল। এ জন্য তাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। এত দুর্বল পুলিশের জঙ্গি-ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাব্যবস্থা। আদালতের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও পুলিশের দক্ষতা যদি এই বিন্দুতে এসে ঠেকে, তবে আমাদের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। কারণ, আদালত প্রাঙ্গণ যেখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থাকার কথা, সেখানে এত দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা দিয়ে কীভাবে সম্ভব? জঙ্গিরা এমনিতেই দেশের হুমকি, এর বাইরে নানা মামলার যারা আসামি তারাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আদালতের নিরাপত্তাব্যবস্থা যদি এমন হয় তাহলে সুবিচারের পথ প্রশস্ত হবে কীভাবে? অপরাধীরাই কেবল আদালতে যায় না, অবিচারের শিকার অনেক বিচারপ্রার্থীও আদালতে যান। কিন্তু এত এত পুলিশ থাকার পরেও যদি তারা নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সুবিচার পর্যন্ত পৌঁছা কীভাবে সম্ভব?
পুলিশের ভাষ্যে এখন পর্যন্ত যা শুনছি, তাতে মনে হচ্ছে জঙ্গিদের আদালত আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সাধারণ নিরাপত্তাব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। সাধারণ কয়েদির মতো তাদের আনা-নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু কেন? দেশের হুমকি হয়ে থাকা, এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য কেন অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? আদালত প্রাঙ্গণে কতজন পুলিশ নিয়মিত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন, সেটা এখানে মুখ্য নয়, অপরাধীর অপরাধ এবং অপরাধের নৃশংসতা, প্রভাব ও তাদের সহযোগীদের বিবেচনাতেই অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। এটা নেওয়া হয় না, এবং হচ্ছে না বলেই জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে।
আদালত থেকে, পুলিশের প্রহরা থেকে, এজলাস থেকে আসামির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশে নতুন নয়। বেশির ভাগই সাধারণ বলে তাদের অনেককে ধরে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু জঙ্গিবাদ যেখানে একটা নেটওয়ার্কের অধীন এবং এই নেটওয়ার্কের মধ্যে অনেকেই থাকেন, তখন তাদের নিয়ে আলাদা করে ভাবা উচিত ছিল। জঙ্গিরা যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, এটা অবিদিত নয়। পুলিশই এটা বলে থাকে; আমরাও এটা বিশ্বাস করি। অথচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিদের বিষয়েও এই খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত।
ঢাকার আদালতে কয়েক শ পুলিশ আসামি আনা-নেওয়ার কাজ করে থাকেন। এদিকে জঙ্গিদের মতো ভয়ংকর নয়, এমন অনেক আসামির ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি শত শত পুলিশের উপস্থিতি। সামনে-পেছনে-ডানে-বাঁয়ে পুলিশ, শত শত পুলিশ। ওসব ঘটনার সময়ে আদালতে থাকা পুলিশেরা নিশ্চয় আদালতের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য নয়, তবু তাদের নিয়ে আসা হয়। নিরাপত্তার কারণে নিয়ে আসা হয়। যদিও ওই আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার কথা নয়। তবু পুলিশ এমনই ব্যবস্থা করে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ক্ষেত্রে দেখা গেল অন্য চিত্র, যেখানে সাধারণ ব্যবস্থা আর সামান্য কিল-ঘুষি আর স্প্রেতে ঘায়েল পুলিশ। এখানে দায়িত্বে অবহেলা অবশ্যই আছে। তবে তার চেয়ে বেশি আছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা। কারণ, তারা জঙ্গিদেরও সাধারণ কয়েদি হিসেবে দেখছে। আর সেটারই এই পরিণতি।
জঙ্গিদের আদালত-ব্যবস্থাপনা নিয়ে এমন গুরুত্বহীনতা কেন? ‘শর্ষের ভেতর ভূত’ বলে বাংলায় যে কথা আছে, এখানে কি আছে এর উপস্থিতি? প্রবল আশাবাদী লোক বলে এমনটা বিশ্বাস করতে মন চায় না, তবু বলি এমন যদি হয় তবে এটা কেবল নিচের দিক থেকেই হবে না, ওপরের দিকেও থাকতে পারে এর যোগ। কারণ, এই জঙ্গিবাদের সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করা হয়েছে। জঙ্গিরা ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ প্রচার করে, ধর্মের নামে খুনোখুনি করে, ধর্ম রক্ষার নামে অভিজিৎ রায় ও ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করেছে। অভিজিৎ-অনন্ত-দীপনসহ অন্যদের হত্যার পর দেশের একটা শ্রেণির লোক এর বিরোধিতা করেনি, উল্টো খুশি হয়েছিল। এই খুশি হওয়া গোষ্ঠীর আদর্শিক সমর্থক প্রশাসনে যে নেই, সেটা কেউ বলতে পারবে না।
জাতীয় বিভিন্ন উপলক্ষের আগে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখে জঙ্গি-হামলার আশঙ্কা আছে কি নেই, এসব আমরা শুনে আসছি। ধারণা করছি, তারা জঙ্গিবাদ নিয়ে যথেষ্ট ভাবছেন, জঙ্গিদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোথায় এর প্রকাশ? জনাকীর্ণ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে যখন প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ প্রহরায় থাকা জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের সহযোগীরা, তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা আর কাজের অমিলটাই প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। তারা কি জঙ্গিদের কেবল টেবিল-টকেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন? অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না; কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকা জরুরি ছিল। এখানে তারা ব্যর্থ, শতভাগ ব্যর্থ।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের বিষয়টি কেবল নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে দেখলে চলবে না, এটা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও দায়। জঙ্গিদের নিয়ে তারা সতর্ক নন, জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা ও জঙ্গি-নেটওয়ার্ক নিয়ে তারা ভাবিত নন। এ কারণেই জঙ্গিদের ক্ষেত্রেও সাধারণ কয়েদির মতো নিরাপত্তাব্যবস্থা রেখেছেন। অথচ এখানে দরকার ছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে নেওয়ার আগের বিধান হাইকোর্টের এক আদেশে এখন আর নেই। তাই বলে তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা কেন শিথিল করা হবে, উচ্চ আদালত নিরাপত্তা শিথিল করতে বলেনি। এখানে ডান্ডাবেড়ির সম্পর্ক খোঁজার অবকাশ নেই। দরকার নিরাপত্তা জোরদার করার।
অভিজিৎ-দীপন হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জোর দাবি জঙ্গিদের নিয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার। জঙ্গিবাদ দমন কেবল টেবিল-কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এটাকে কাজে পরিণত না করলে এভাবে পুলিশকে সামান্য কিল-ঘুষি দিয়ে জঙ্গিরা পালিয়ে যাবে। একটা ঘটনা যখন ঘটেই গেছে, তখন এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক