আমরা জানি ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। তবে বড়দিন বলতে আমরা সময়ের তুলাদণ্ডের হিসাব করে বলতে পারি না, ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। প্রাকৃতিক নিয়মে কিন্তু দিনটি ছোট। ছোট বলতে শীতকালে সূর্যোদয় দেরি করে হয়। ঘন কুয়াশায় সূর্য ঢাকা পড়ে যায়, আবার সূর্যাস্তের সময়ও প্রকৃতিতে তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসে। এ জন্য দিন ছোট হয়ে থাকে। এই হিসাবে দিনটি কিন্তু ছোটই।
কিন্তু ২৫ ডিসেম্বর খ্রিষ্টান জগতে এই দিনটি সত্যিই ‘বড়দিন’। কারণ, দিনটির একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সেই তাৎপর্যটি হলো খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যিশুখ্রিষ্ট (আনুমানিক) ২৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে তীব্র শীতে এক জীর্ণ গোয়াল ঘরে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র আত্মার শক্তিতে কুমারী মারিয়ার গর্ভে দেহ ধারণ করে পৃথিবীতে তিনি জন্ম নিলেন। তাই দিনটিকে বড়দিন বা ক্রিসমাস ডে বলেই অভিহিত করা হয়।
বড়দিনের উৎসব একটি সর্বজনীন উৎসব। গোটা বিশ্বে এই উৎসব উদ্যাপিত হয়ে থাকে। খ্রিষ্টধর্মের মানুষের জন্য দিনটি আনন্দ, শান্তি, ভালোবাসা ও মিলনের মহোৎসবের দিন। বাইবেলের পুরোনো নিয়মে বর্ণিত এই মহামানবের জন্মের অপেক্ষায় ইসরায়েল জাতি হাজার বছর প্রতীক্ষায় ছিল। পৃথিবী যখন পাপে নিমজ্জিত, চারদিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হাহাকার, মারামারি-হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তখন মানুষ একজন মুক্তিদাতার অপেক্ষা করছিলেন, যিনি এই দুর্দশা থেকে তাদের মুক্ত করবেন। কারণ, তারা শাসনে-শোষণে, নির্যাতন-অশান্তিতে জীবন যাপন করে মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন। আর দয়াময় ঈশ্বর তাদের মিনতিতে কর্ণপাত করে একজন মুক্তিদাতাকে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। যিশুখ্রিষ্টই সেই প্রত্যাশিত মুক্তিদাতা, অনন্য মন্ত্রণাদাতা; সেই অভিষিক্তজনই সেই মশীহ, যিশুখ্রিষ্ট।
তিনি এলেন দীন বেশে, দরিদ্রের কুটিরে; অতি সাধারণ মানুষের বেশে। মারিয়া ও জোসোফের ঘরে তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞায় বেড়ে উঠতে থাকলেন এবং সবার কাছে প্রীতিভাজন হয়ে উঠলেন।
তিনি কেন মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে এলেন?
তিনি আমাদের মধ্যে মানুষ হয়ে এলেন, যাতে আমরা ঐশ্বরিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে জীবন লাভ করে মানবতায় বিধৌত হয়ে অন্তরে সূচি শুভ্র হয়ে উঠতে পারি। তিনি এসেছিলেন মানবজাতিকে উদ্ধার করতে। কারণ, মনুষ্য জাতি তখন পাপের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল, তিনি সত্য ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হয়ে অন্যায়ের জোয়াল ভেঙে দিতে এসেছিলেন। সর্বোপরি তিনি মানুষকে ভালোবাসতে এসেছিলেন এবং পরম পিতার ভালোবাসার স্বাদ দিতে এসেছিলেন। যেন মানুষ তার ভাই মানুষের প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মিলন ও ভ্রাতৃত্বের মধ্য দিয়ে একত্রে বসবাস করতে পারে।
তাঁকে বলা হয় শান্তিরাজ। কারণ, তিনি অশান্তির মধ্যে শান্তি নিয়েই এসেছিলেন। সাধারণ মানুষের মতো জোসেফ ও মারিয়ার পরিবারে জ্ঞান ও বুদ্ধিতে তিনি বেড়ে উঠতে থাকলেন। ৩০ বছর ধরে তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেন। তারপর তিনি মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য শিক্ষাদানে ও সেবা কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি দেখাতে চাইলেন তার জীবন দিয়ে, আচার-আচরণ দিয়ে ও সেবা কাজের মাধ্যমে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসার গভীরতা।
তিনি শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের স্বরূপ প্রকাশ করলেন, আর সেবা কাজের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের মহানুভবতা প্রকাশ করলেন। তিনি ছিলেন দরিদ্রের বন্ধু, তাই তিনি দরিদ্রতার মধ্যেই নিজের জীবন পরিচালনা করে দীন-দরিদ্র অসহায় ভাইবোনদের পাশে দাঁড়ালেন। সেবা কাজের মধ্য দিয়ে তিনি শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থ করে ঈশ্বরের ভালোবাসার মধ্যে তাদের নিয়ে এলেন।
তিনি বলেছেন, “ওহে শ্রান্ত-ভারাক্রান্ত, তোমরা আমার কাছে এসো। আমি তোমাদের শান্তি ও সান্ত্বনা দেব। তোমাদের জোয়াল হালকা করে দেব।” তিনি তা-ই করেছেন। অন্ধকে দিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি, বোবাকে কথা বলার শক্তি, খঞ্জকে দিয়েছেন চলার গতি, মৃতকে দিয়েছেন সঞ্জীবনী শক্তি। এভাবেই তিনি মানুষকে ঈশ্বরের ভালোবাসায় সিক্ত করে তুলেছিলেন।
স্বর্গ সুখ ছেড়ে যিশুর কি এ মাটির ধরায় আসার প্রয়োজন ছিল?
হ্যাঁ, ছিল বৈকি। আমাদের পাপ থেকে মুক্ত করতে, অসুস্থতা থেকে সুস্থ করতে, মানুষকে নতুন জীবন দিতে, অবহেলিত ও অসহায় মানুষকে আশার বাণী শোনাতে, শয়তানের শৃঙ্খল ভেঙে দিতে, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দিতে, আমাদের অন্ধকারের রাজ্য থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনতে তাঁর আসার প্রয়োজন ছিল এবং আছে। তাঁকে আসতে হবেই এই অসুস্থ পৃথিবীকে সুস্থ করতে, পাপের রাজ্য থেকে ক্ষমার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে।
তিনি এসেছেন একবার। আবারও তাঁকে আসতে হবে আমাদের কর্মের বিচার করতে। তাই এই অসুস্থ পৃথিবীতে তাঁর আসার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি। এই পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে তিনি আসবেন। যখন তিনি আসবেন, তখন আমার হৃদয়টা কি তাকে গ্রহণ করার জন্য সূচি শুভ্র ও পবিত্রতা নিয়ে প্রস্তুত থাকবে? নাকি পাপ কালিমায় নিমজ্জিত অবস্থায় থাকবে?
জন্মলগ্নে ফুল চন্দন নিয়ে তাঁকে গ্রহণ করার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। তার জন্য কোনো আশ্রয়ও ছিল না। তাই গভীর রাতে তাঁর পিতা-মাতা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে একটু আশ্রয় ভিক্ষা করেছিলেন। কিন্তু মনুষ্য সমাজে কোনো আশ্রয় তারা পাননি। মারিয়ার তখন প্রসবের সময়, এমন দুরবস্থায় তাদের জন্য মনুষ্য সমাজে কোনো আশ্রয় জোটেনি। অবশেষে অনেক কষ্টে তারা একটি গোয়াল ঘরে গরু ভেড়ার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে কনকন শীতের মধ্যেই যিশুর জন্ম হলো। এ কেমন ঘটনা? যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রাজাধিরাজ, তার জন্ম হলো পশুশালায়!
তিনি ধনী বা রাজপ্রাসাদ বেছে নেননি। বরং শোষিত-শাসিত নির্যাতিত নিপীড়িত দরিদ্রদের মতো জীর্ণ গোয়াল ঘর বেছে নিয়েছিলেন পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করার জন্য। তার বাণী প্রচারের মূল সুর হলো, “স্বর্গে তোমাদের একজন পিতা আছেন।”
লেখক : সিস্টার , এসএমআরএ