এ দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগই ডিজেল। দৈনিক প্রথম আলো বলছে, বছরে চাহিদা ৪৬ লাখ টন, যার মাত্র ৬ লাখ টন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড জোগান দিতে পারে। অর্থাৎ ৪০ লাখ টনের মতো ডিজেল সরাসরি আমদানি করতে হয় সরকারকে। বছরে ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) থেকে উপজাত হিসেবে মেলে এই ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা অকটেন, পেট্রলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেল। ১৯৬৩ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, আর ১৯৬৮ সাল থেকে উৎপাদন শুরু হয় জ্বালানি তেলের এই পরিশোধনাগার থেকে। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি ৫১ বছর পার করার পরও নতুন আরেকটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি! কেন পারেনি? এর কি প্রয়োজন নেই? প্রয়োজন যদি না-ই হবে, তাহলে ২০১৫ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড সেরা সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হলো কীভাবে? সেটি তো আর ধুঁকছে না!
জ্বালানিবিষয়ক আমলা-বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলেন, ডিজেল নাকি সরাসরি আমদানি করা ভালো, সেটি সাশ্রয়ী, বাংলাদেশের নিরিখে। এটা মন্দের ভালো এক থিওরি, সাময়িক সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে ডিজেল নীতির বিন্যাস ও সুদুরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা কোনো সরকারই করতে পারেনি! এ জন্য এখন একবার ভারত, একবার ব্রুনেই, একবার রাশিয়ার ডিজেল—কারটা নেব, কারটা সাশ্রয়ী—এসব ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। এখন নিজের রিজার্ভের ডলার বাঁচাতে তেলভিত্তিক (ডিজেল) বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে সরকার। অর্থাৎ তেল আমদানি কমে গেছে! বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি নেমে এসেছে ৯০ ডলারেরও নিচে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেক বাধ্য হয়ে উত্তোলনও কমিয়ে দিয়েছে। অথচ এ দেশের মানুষের ভাগ্যে তার সুফল মিলছে না! একলাফে সব জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে, পরে মাত্র ৫ টাকা কমিয়েছে সরকার।
৮০ টাকার ডিজেল এখন কিনতে হচ্ছে ১০৯ টাকায়! করোনার সময়ে বিশ্ববাজারে প্রায় ১৩০ ডলারের কাছাকাছি ক্রুড অয়েল বিক্রি হয়েছে, এখন প্রায় ৪০ ডলার কমে গেছে ব্যারেলপ্রতি। অথচ এর বিন্দুমাত্র সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষ! ডলারের মূল্যস্ফীতি হলেও, ক্রুড অয়েলের দাম কমেছে আরও বেশি! অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারের নিরিখে খরচ বাড়ার কথা নয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। এখানে কিছু সংকট রয়েছে। তেল আমদানিতে বাংলাদেশ সব সময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে, আর এতে আন্তর্জাতিক বাজারের উত্থান-পতন খুব একটা প্রভাব ফেলে না দামে। তাতে গত কয়েক বছরে বিপিসির সুবিধা হয়েছে। ২০১৪ থেকে ৪৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বড় এফডিআর রয়েছে ব্যাংকে। এটা নিশ্চয়ই এই সরকারের বড় এক সাফল্য। লোকসানি প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে তারা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।
কিন্তু এ দেশের তৃণমূল মানুষের খুব একটা লাভ হয়নি তাতে। ডিজেল হচ্ছে গরিবের জ্বালানি। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, নৌযানে, কৃষিকাজে, মাছ ধরার ট্রলারের জ্বালানি এটি। সাধারণ মানুষের বাহন ও পণ্য পরিষেবার জন্য ডিজেল অত্যাবশ্যকীয়! এই যে ডিজেলের আকাশসমান দাম বেড়ে যাওয়া, এতে দেশের অর্থনীতির প্রান্তসীমায় থাকা সব পরিবারের খরচ বেড়ে গেছে। এতে পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো জরুরি বিষয়গুলোতে ছাড় দিতে হচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে নিশ্চয়ই। বিপিসির কর্মকর্তারা প্রায়ই ডিজেল পাচারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোকে জায়েজ করতে চান, পার্শ্ববর্তী দেশে ডিজেলের উচ্চমূল্যকে সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু দেশের মানুষের জন্য একটু খুশির খবর দেওয়ার চেষ্টা কখনো করেন না! কীভাবে পাচার রোধ করা যায়, সে বিষয়ে বলেন না!
১০ বছর ধরে ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রকল্প-২ কাগজে-কলমে বন্দি। স্বাধীনতার পর কেন আরেকটি জ্বালানি তেল শোধনাগার এ দেশে হলো না, কেন ডিজেল নীতি জনবান্ধব হলো না, সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়! উদ্দেশ্য নতুনভাবে কী ভাবা যায়?
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন