• ঢাকা
  • শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ রমজান ১৪৪৬

মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের শিল্পীরা


দীপংকর গৌতম
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৫, ১১:১৬ এএম
মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের শিল্পীরা

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্মারক কিংবা জন্মজরুল বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ কখনো একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় না, ভারতবর্ষেও স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে থেকেও আমরা একই বিষয় দেখে এসেছি। সিপাহি বিদ্রোহ বা সিরাজউদ্দৌল্লার আম্রকাননের যুদ্ধ কোনোটাই মুক্তি সংগ্রাম থেকে আলাদা নয়। আন্দোলন-সংগ্রামের এক একটি সোপানকে অতিক্রম করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। বাঙালীর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ছিলো বহু পূরানো। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে তেভাগা,  টংক, নানকার, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহসহ বিভিন্ন কৃষক সংগ্রাম সব গণসংগ্রামই ছিলো স্বাধীনতার এক একটি সোপান। স্বাধীনতাযুদ্ধ কখনো একবারে বা একদিনে শুরু হয়েছে বিশ্বের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস তা বলে না। বাঙালীর গণসংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় ৫২, ৬২, ৬৯-এর রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে , অজস্র মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আসে একদিন আসে মুক্তির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমাদের মহান স্বাধীনতা ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত নীরিহ বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক ওই পরিকল্পনা দিয়ে নারকীয় গণহত্যা  শুরু করে। এক রাতেই তারা হত্যা কওে ৩০ হাজার মানুষকে। এত কম সময়ে এত বড় গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে নজির বিহীন। মানুষ বুঝে উঠতে পারেনি সে কী করবে। তারপর পথ সব খুলে যায়। মা, মাটি ,মানুষ রক্ষায় তব্রি প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালী দামাল ছেলেরা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ। চিত্রশিল্পীরাও শামিল হয় জনযুদ্ধে। ১৯৬৯ বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে। সেই বছর ২১ ফেব্রুয়ারির স্লোগান ছিল ‘আজ পলাশ ফোটার দিন’। ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্ররা ‘অ’ ‘আ’ অক্ষর দিয়ে ফুলের বলয় এবং আন্দোলনের বার্তা বহনকারী স্বরবর্ণের ব্যানার শহীদ মিনারে টাঙায়। আর্ট কলেজে প্রতিদিন রাত জেগে পোস্টার লেখা হতো। প্রতিদিন এক রিম কাগজে সর্বোচ্চ ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সময় রাস্তায় নেমে ছবি এঁকেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবীসহ অনেকে। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামের শিল্পীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যানার, ফেস্টুন অঙ্কন করেন।

১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনে ‘বিক্ষুদ্ধ শিল্পী সমাজ’ এর ব্যানারে চারুশিল্পীরা সভা সমাবেশ করেন। নেতৃত্ব দেন শিল্পী কামরুল হাসান, হাশেম খান, শাহাদাৎ চৌধুরী, বিজয় সেন, গোলাম সরোয়ার, মঞ্জুরুল হাই সহ অনেকেই।দেশের শিল্পী সমাজ মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাদের রঙ তুলি মারণাস্ত্রের চেয়েও কোনো কোনো সময় বেশি কাজ করেছিল। তাছাড়া অনেক শিল্পী রঙ তুলি রেখে অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শিল্পী শাহাবুদ্দীন এর নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। একাত্তরের এপ্রিলে খালেদ মোশাররফ এর অধীনে দুই নম্বর সেক্টরে তিনি গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আতংক ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি শাহবাগ রেডিও স্টেশনে ঢুকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। ১৯৭১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একটি প্রদর্শনীতে ১৭ (সতের) জন শিল্পীর ৬৬ (ছেষট্টি)টি শিল্পকর্ম স্থান পায়। ঐতিহাসিক এই প্রদর্শনী দেখেই বিশ্ববাসী বাংলার দূরবস্থার কথা জানতে পেরেছিল। প্রদর্শনীতে অংশ গ্রহণকারী শিল্পীর নাম ও শিল্প:গোলাম মোহাম্মদ- ‘সূর্য বিলোপ’,অঞ্জন বণিক- ‘রক্তাক্ত বাংলাদেশ’,বীরেন সোম- ‘কান্না’, ‘দুঃস্বপ্ন’,চন্দ্রশেখর দে- ‘নিষ্পাপ শিকার’, ‘চঞ্চল পাখি’,মুস্তাফা মনোয়ার- ‘গর্বিত মা’, ‘নারী এবং পশু’,নাসির বিশ্বাস- ‘ধর্ষণ’ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদানকারী শিল্পীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র পটুয়া কামরুল হাসান। তিনি অনুভব করেছিলেন একমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্টীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালির সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কামরুল হাসান পশ্চিমবঙ্গে চলে যান এবং নবগঠিত মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তিনি ইয়াহিয়া খানের প্রতিকৃতি দিয়ে একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামে। সেখানে দানব আকারে দেখানো হয় ইয়াহিয়াকে যা প্রকৃত অর্থে পুরো হানাদার বাহিনীর নগ্ন চরিত্রের পরিচয় বাহক। সেই চিত্রটি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই পোস্টার চিত্রটি পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর এবং তাদের এদেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ রাজাকারদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্রোহের উদ্রেক বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী নিতুন কুণ্ডের করা  পোস্টারগুলোর মধ্যে ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন’ ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো’ উল্লেখযোগ্য। শুধু তাই নয় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার তুলেধরে চিন্তামণি কর ও কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কোলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির সহায়তায় ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বিড়লা একাডেমিতে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত ভাস্কর শ্রী দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক নির্মান করেছেন আমাদেও দেশের দেশপ্রেমিক শিল্পীরা। মুক্তিযুদ্ধে একজন সশস্ত্র যোদ্ধার কাজ তারা করেছেন তুলি-কলম-রঙের বর্নিল আচড় দিয়ে। মাতৃভুমির প্রতি,দেশের মানুষের প্রতি য়ে দায় তা তারা পালন করেছেন সর্বাত্মকভাবে। তাদেও এই দায়ব্ধতার ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে এই প্রজন্ম জানবে শিল্পীর স্বাধীনচেতাস্বভাব ও মাটি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। যার মধ্যে নিহিত রয়েছে শিল্পের রাজনীতি। শিল্পকলার বিকাশে শিল্পীর দায়বদ্ধতার জায়গাটার পাটাতনকে পোক্ত করাপর বিকল্প নেই।

তথ্যসূত্র:

১. মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী সমাজ/আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী । দৈনিক আজাদী ৫ মার্চ, ২০২২

২.মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী ও শিল্প হিমা আক্তার হিরামনি ২ এপ্রিল,২০২১ দৈনিক সংবাদ

৩. মুক্তিযুদ্ধেও শিল্পী ও শিল্প ,দীপংকর গৌতম

Link copied!