বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন বিশ্বের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বস্তুত ভাষা আন্দোলন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের শোষিত জনগণের সুদীর্ঘ সংগ্রামের সংগঠিত সূচনা। এটি ছিল দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেক্যুলার এই আন্দোলনে পূর্ব বাংলায় জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ধ্বংসের বীজ রোপিত হয়। এই আন্দোলনের মধ্যেই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী অনুভব।
সক্রিয় ভাষা আন্দোলনের আরম্ভ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে হলেও এই আরম্ভেরও আরেকটি আরম্ভ ছিল, সেটি করেছিলেন লেখক সম্প্রদায়। ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসগুলির বিবরণ অনুযায়ী বাঙালি লেখকগণ বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে এবং এ প্রয়াসের সূচনা ঢাকায়। কিন্তু তা ঠিক নয়। এ প্রচেষ্টার শুরু আরও আগে এবং কোলকাতায়। (আবদুল হক, ভাষা আন্দোলনের আদি পর্ব, পৃ ৩১) উল্লেখ্য, ‘কোলকাতা শুধু অখণ্ড বাংলাদেশের নয়, কিছুদিন খণ্ডিত পূর্ববঙ্গেরও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মাউন্টব্যাটেন ঘোষণার পরে পরেই আসন্ন পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যা তাদের দৈনন্দিন উত্তেজনাময় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এই সব আলোচনার একটা প্রধান বিষয় ছিল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন, কেননা ইতোমধ্যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল ছিল যে, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চলছে। সচেতন লেখকবৃন্দ তখনই এ প্রয়াসের বিরোধিতা করার এবং বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নিয়েছিলেন।’ (আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ ৩২) এদিকে জুলাই মাসে ঢাকায় মুসলিম লীগের বামপন্থীদের নিয়ে ‘গণ আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র সংস্থা গঠিত হয়। এই সংস্থার ম্যানিফেস্টোতে বলা হয় ‘বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। (বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি পৃ ৩; কামরুদ্দীন আহমদ, দি সোশ্যাল হিস্ট্রি অব ইস্ট পাকিস্তান পৃ ৯৮-৯৯; আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ ৪০) রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সক্রিয় আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পূর্বে প্রতিষ্ঠানগত-ভাবে তমদ্দুন মজলিস বাংলার দাবির স্বপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নাকি উর্দু?’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়। (অধ্যাপক আবুল কাসেম সম্পাদিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ১৯৬৭) অতএব ‘একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লেখক সম্প্রদায়ই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, প্রথমে কলকাতা থেকে, তারপর ঢাকা থেকে। ...প্রধানত তাদেরই প্রয়াসে শিক্ষিত ও ছাত্র সমাজ বাংলাভাষার দাবি সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন এবং এভাবেই ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। (আবদুল হক,প্রাগুক্ত, পৃ ৪১)
প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দানা বাধে কতকগুলি সরকারি প্ররোচনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে। (বদরুদ্দীন উমর, সংস্কৃতির সংকট ১৯৭০, পৃ ৭৮) ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান অস্তিত্বে আসে আর সে বছরেরই নভেম্বর মাসে শাসকরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালিদের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে গৌরবে বহুবচনের মতো উর্দুর সাথে ইংরেজিতে লেখা খাম, পোস্ট কার্ড, ডাকটিকেট, রেল-টিকেট, মানি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি ছেপে চালু করে দেয়। (আবদুল মতিন, বাঙালি জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন, পৃ ৫) পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তদানীন্তন সচিব গুড ইন ১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর তারিখে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়াদি সম্পর্কে একটি সার্কুলার প্রেরণ করেন। এ সার্কুলারে ঐ পরীক্ষার জন্য সর্বমোট ৩১টি বিষয় দেয়া হয়, যার মধ্যে নয়টি ছিল ভাষা; এ সকল ভাষার মধ্যে হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি এমনকি ল্যাটিন ও সংস্কৃতও স্থান পায়, কিন্তু স্থান পায় না পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। এই পটভূমিতে ১৭-১১-১৯৪৭ তারিখে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা করার দাবি জানিয়ে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করা হয়। (দৈনিক আজাদ, কলকাতা ১৮ নভেম্বর ১৯৪৭) ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন রাজধানী করাচীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৬-১২-১৯৪৭ তারিখে ‘মর্নিং নিউজ’ এ এই শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে মর্মে সংবাদ এর প্রতিবাদে ঐদিনই দুপুর দুইটার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও অন্যান্য কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক প্রতিবাদ সভা করে। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তমদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাসেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, এ কে এম আহসান প্রমুখ এবং প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের ভিপি ফরিদ আহমদ। প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটাই সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্র সভা। বাংলাদেশের অন্য সকল আন্দোলনের মত ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগারও তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। (Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and its Aftermath, Bangladesh Books International Ltd., Dhaka, Bangladesh, 1980) ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন। (বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি; একুশে সংকলন, ১৯৮১: স্মৃতিচারণ, বাংলা একাডেমী) এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অনুধাবন করে এর প্রতিকারের জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন আহবায়কের ভূমিকা পালন করেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। সংগঠনটির প্রথম সভাপতি ছিলেন দবিরুল ইসলাম। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। অধিবেশনে পূর্ব বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সদম্ভে ঘোষণা করে বলেন যে ‘পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে’। (একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস- আহমদ রফিক পৃষ্ঠা: ৫৬,১৪২, ৫৯; ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস, বাংলা একাডেমি পৃ ৫-২৭) নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। এসময় তমদ্দুন মজলিস, গণ আজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন ছাত্রাবাসের যৌথ উদ্যোগে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। (শহীদ তাজউদ্দীনের ডায়েরি ২.৩.১৯৪৮) রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঐদিন এক প্রস্তাবে সারা পূর্ব বাঙলায় ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ভোরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে নাজিমুদ্দিনের এই রকম চুক্তি করতে বাধ্য হওয়ার কারণ কায়েদে আজম ১৯ মার্চ, ১৯৪৮ ঢাকা সফরে আসছিলেন। ১৫ মার্চ ভাষা-আন্দোলনের বন্দী ছাত্র ও কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়। (বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ ২৭৬) ২১ মার্চ ১৯৪৮ রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ বলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, অন্য কোনও ভাষা নহে। যে কেহ অন্য পথে চালিত হইবে সেই পাকিস্তানের শত্রু’। (আজাদ ২৩ মার্চ ১৯৪৮) ২৪ মার্চ তারিখে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাবির সমাবর্তনে তিনি পুনরায় ঘোষণা করেন ‘Urdu and Urdu alone shall be the state language of Pakistan’. জিন্নাহ যখন বলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা, তখন হলের মধ্যে বহু ছাত্র ‘না,না’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। ছাত্ররা এইদিন প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মতিন, এ কে এম আহসান প্রমুখ। ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাতদান করেন। (বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ ২৮৫-২৮৬) জিন্নাহ কঠোর ভাষায় তাদের শাসিয়ে দেন, ‘যে কোন অসাংবিধানিক আন্দোলন কঠোর হস্তে দাবিয়ে রাখা হবে’। ২৮ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে তার দেয়া বক্তব্যে তার অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। এই ভাবে ১৯৪৭-৪৮ সালে সমগ্র দেশের ছাত্র ও জনগণের সমর্থিত বিরাট সম্ভাবনাময় ভাষা আন্দোলনের দুঃখজনক পরিসমাপ্তি ঘটে। (আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত পৃ ১৬) ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে একটি মানপত্র দিয়ে তাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। এ মানপত্রটি পাঠ করেন ইউনিয়নের তৎকালীন সেক্রেটারি গোলাম আযম। আসলে এটি পাঠ করার কথা ছিল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের। কিন্তু লিয়াকত আলীকে ভাষা আন্দোলনের দাবি সংবলিত মানপত্র পাঠ একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে করালে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং মুসলিম লীগ সরকার এ নিয়ে নানা প্রকার বিরূপ প্রচারণা শুরু করবে এ আশংকা থেকেই একজন মুসলমান ছাত্র হিসেবে সেক্রেটারি গোলাম আযমকে সেটা পাঠ করতে দেয়া হয়েছিল। (বদরুদ্দীন উমর,ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভেলকিবাজি,যুগান্তর ২৭ জুলাই ২০০৮)উল্লেখ্য, গোলাম আযম রাজনৈতিকভাবে মুসলিম লীগ সরকারের নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে ডাকসুর জিএস পদের কারণে সমাবেশে দাবি-নামা পাঠের মধ্যে দিয়েই গোলাম আযমের ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার অবসান হয়। এরপর থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত কোন আন্দোলনে গোলাম আযমের অংশগ্রহণ বা কোন ভূমিকা রাখার কথা কোথাও জানা যায় না। বরং নিজের এই অংশগ্রহণকে সুবিধাবাদী কারণে অস্বীকার করতেও দ্বিধা-বোধ করেননি গোলাম আযম। পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে ১৮ জুন (১৯৭০)এক সংবর্ধনা সভায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, ‘উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা। তিনি বলেন, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনিও তাতে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তা ভুল হয়েছিল। (দৈনিক পাকিস্তানের ১৯ জুন ১৯৭০; দৈনিক আজাদ, ২০ জুন, ১৯৭০; ড. মোহাম্মদ হান্নান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৩৯৯)
১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লেও পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির বাংলা ভাষা বিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বাংলা ভাষাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল এ প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য। এ জন্য আরবি হরফে বাংলা লেখার আজগুবি এক প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় তারা। এ কাজে বাংলাভাষী কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তৎকালীন পাক শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। অতঃপর ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ তারিখে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি বাংলা হরফকে বাদ দিয়ে তদস্থলে আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণার প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা মোস্তফা নূর উল ইসলামের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন এবং নজরুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, ইলা দাস গুপ্ত, নূরুল ইসলাম, মমতাজ বেগম, রিজিয়া সিদ্দিকী, খলিলুর রহমান প্রমুখের সমন্বয়ে একটি বর্ণমালা সাব-কমিটি গঠন করা হয়। (বাংলা হরফ বিতাড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এম. আর. মাহবুব, জনকণ্ঠ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২; বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা, সৈয়দ আবুল মকসুদ, যুগান্তর,১৪ অক্টোবর ২০১৬)
১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এই কমিটি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু’ এবং ‘উর্দু হরফে বাংলা লিখনের প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে’ বলে উক্তি করেন। তার বক্তৃতায় প্রদেশব্যাপী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। (সৈনিক ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীক ধর্মঘট পালন করা হয় ও ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের আহবান করা হয়। (আবদুল মতিন, বাঙালি জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন, পৃ ৬২) বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সহযোগে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ৩১ তারিখে নাজিমুদ্দিনের ভাষা সম্পর্কিত ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগের উদ্যোগে বার লাইব্রেরি হলে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। (সৈনিক, প্রাগুক্ত; বদরুদ্দীন উমর, নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃ ১৯৯; আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত) সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী। সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘটের সমর্থন দেওয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। (বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত, পৃ ৩২০-২৪) এই সভায় আন্দোলন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত হন কাজী গোলাম মাহবুব। (আবুল কাসেম ফজলুল হক,একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন, পৃ ১৮) ৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন যে, ‘পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি এই সম্পর্কে কেবলমাত্র কায়েদে আজম মরহুমের উক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন। চূড়ান্তভাবে এই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা কেবলমাত্র গণপরিষদেরই আছে। (আজাদ, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষার প্রচলন করার বিরুদ্ধে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের সকল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ধর্মঘট পালন করে। বেলা ১১টা হতে শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হন। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের এক সভা হয়। এই সভায় বিভিন্ন শিক্ষায়তনের পক্ষ হতে ছাত্র বক্তাগণ পাকিস্তানের বৃহত্তম অংশ এই পূর্ব পাকিস্তানের নর-নারীর মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষারূপে গ্রহণ করতে এবং আরবি হরফে বাংলা ভাষা প্রবর্তন না করতে দাবি করেন। (আজাদ ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) সভা শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্র ছাত্রী এক বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হতে বের হয়ে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবন হয়ে হাইকোর্টের সম্মুখ দিয়ে নবাবপুর রোড, পাটুয়াটুলি, আরমানিটোলা ও নাজিমুদ্দিন রোড অতিক্রম করে। ছাত্রছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না ’ প্রভৃতি স্লোগান দেয়। (সৈনিক ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষেধ করেন। আদেশ জারির কারণস্বরূপ তিনি বলেন যে, ‘একদল লোক শহরে সভা,শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রয়াস পাওয়ায় এবং তদদ্বারা জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা থাকায় এই ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়েছে’। (আজাদ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) এমতাবস্থায়, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪, নবাবপুর রোডে অবস্থিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা না করা প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও বাগবিতণ্ডার পর রাত নয়টার দিকে ভোটাভুটির দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। (আবদুল মতিন,প্রাগুক্ত, পৃ ৬৫) ফজলুল হক হলের প্রতিনিধি শামসুল আলম, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম মওলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দেন। (আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ ৬৬) যুবলীগের মোহাম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত ছিলেন। বাকি সবাই (১১জন) ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ভোট দেয়। এভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত জয় যুক্ত হয়। এমতাবস্থায় অলি আহাদের তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দ্বারা পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেন। ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিনের জবানীতে: ‘১৯৪৭-৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে একজন অলি আহাদ সব সময় বলতেন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে একুশ তথা ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। জাতিসত্তা, বাঙালি জাতিসত্তা, সে সত্তার জন্য প্রয়োজনে বাঙালিদের ভিন্ন রাষ্ট্র গঠন ইত্যাদির ভিত্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে অলি আহাদ কতোখানি দেখতেন সে বিষয়ে আমার প্রশ্ন থাকলেও একটি বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই যে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখের বৈঠকে অলি আহাদের ভূমিকা ও সহযোগিতা ছাড়া সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রাসঙ্গিক দুইটি মত: ১) একুশ তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ২) একুশ তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করা, ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ছাত্র সভায় উপস্থিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করানো সম্ভব হতো না। এই মর্মে অলি আহাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ‘সভাপতি আবুল হাশিম প্রশ্ন তুললেন যে, ছাত্র সমাবেশ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে বাতিল করে তাহলে তো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে’। সভাপতির কথার পর অলি আহাদ উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে, ‘আমি সভাপতির কথা বুঝতে পারছি এবং সেই জন্যই তো বলছি, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটকে প্রস্তাব হিসেবে না নিয়ে তা মত হিসেবে ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠদের ভোটকে দুইটা মত হিসেবে উপস্থিত করে আগামীকালের ছাত্র সমাবেশের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়াটা হবে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত’। সভাপতি মৃদু হেসে বলেন, ‘I appreciate Oli Ahad`s point.’ (আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত) বেলা ১২টার মধ্যে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে হাজির হয়। প্রায় সাড়ে ১২টার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গাজিউল হকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন আন্দোলনের পূর্বাপর পর্যায় ও ১৪৪ ধারা প্রবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ সংকটজনক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন এবং সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপরেই ১৪৪ ধারা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। তখনই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালানের জন্য বক্তৃতা দেন। কিন্তু আন্দোলন সম্পর্কিত ছাত্রদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখে বিপর্যস্ত হয়ে তিনি তার সহকর্মীগণসহ সভা থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। অতঃপর ব্যাপকতর পর্যালোচনার পর ভাষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ছাত্ররা সুদৃঢ় আত্মসচেতনতায় ঐক্যবদ্ধভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অভিমত ঘোষণা করে। (উদ্ধৃত, আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ ১০) বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা চলার সময় হতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চতুর্দিকে রাইফেলধারী পুলিশ মোতায়েন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও বিভাগীয় ডিনগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। (আজাদ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) এ সময় ছাত্রনেতা আবদুস সামাদ প্রস্তাব করলেন, ছাত্ররা দশজন দশজন করে বের হবে। এটা এক ধরনের সত্যাগ্রহ। ... এতে একদিকে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করা হবে, অপরদিকে ব্যাপক আকারের গোলযোগ এড়ানো সম্ভব হবে। ছাত্ররা এ প্রস্তাব মেনে নিলো শেষ পর্যন্ত। .... সঙ্গে সঙ্গে সভা ভঙ্গ করে দশজনী মিছিল বের করার জন্য ছাত্ররা স্লোগান দিতে দিতে গেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাগুক্ত) এ সময় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করার ফলে কিছু সংখ্যক ছাত্র দৌড়ি গিয়ে রাস্তার অপর পাশের ময়দানে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং কিছু সংখ্যক ছাত্রকে দৌড়িয়ে মেডিকেল কলেজের দিকে যেতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত ছাত্ররা কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় ভিসি পুলিশের নিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের প্রতিবাদ জানান। এরপর ভিসির অনুরোধক্রমে ছাত্ররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে শুরু করে। (সৈনিক ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) রাস্তায় বের হলেই ১৪৪ ধারা অমান্য করা হয়েছে বলে পুলিশ অনেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং বহু ছাত্রকে মোটরে করে সুদূর তেজগাঁও নিয়ে ছেড়ে দেয়। ৬২ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। (আজাদ, প্রাগুক্ত) গ্রেপ্তারের ফলে ছাত্র মহলে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। (সৈনিক, প্রাগুক্ত) এদিকে মেডিকেল কলেজের সামনে সমাবেশের প্রস্তুতি চলছিল। (আহমদ রফিক, ভাষার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না ৫২, বেলা অনুমান ২ ঘটিকার সময় পরিষদের সদস্যগণ পরিষদ অভিমুখে গমনকালে ছাত্ররা পথরোধ করে পরিষদে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আলোচনা করার ও পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য অনুরোধ জানায়। এ সময় রাস্তায় ছাত্রদের সমাবেশ হতে থাকে। পুলিশ জনতাকে চলে যেতে বললে তারা যেতে অস্বীকার করে। এরপর পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও লাঠিচার্জ করে এবং ছাত্ররা পুলিশের ওপর প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করতে থাকে। (সৈনিক, প্রাগুক্ত) ছাত্ররা যতই স্লোগান দেয় মিছিলে একত্রিত হয়, ততই পুলিশ হানা দেয়। কয়েকবার ছাত্রদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস ছেড়ে তাড়া করতে করতে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। হোস্টেল প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করায় ছাত্ররা বাধ্য হয় ইট পাটকেল ছুড়তে। একদিকে ইট পাটকেল আর অন্যদিক থেকে তার পরিবর্তে কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিচার্জ আসে। পুলিশ তখন ছাত্রদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন আহমদ শহীদ হন। আর ১৭ জনের মতো আহত হন। তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে রাত আটটার সময় আবুল বরকত শহীদ হন।
গুলি চালানোর সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রান্তে প্রান্তে। তখনি অফিস আদালত, সেক্রেটারিয়েট ও বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে বেরিয়ে আসে। শহরের সমস্ত লোক তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে এসে হাজির হতে থাকে। রাস্তায় আর গলিতে গলিতে যেন ঢাকার বিক্ষুব্ধ মানুষের ঝড় বয়ে চলে প্রবল বেগে। মেডিকেল হোস্টেলের ব্যারাকে ব্যারাকে শহীদদের রক্ত রঞ্জিত বস্ত্রের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। মাইক দিয়ে তখন শহীদানের নাম ঠিকানা ঘোষণা করা হয়। সমস্ত মানুষের মন থেকে যেন মুহূর্তেই সমস্ত ভয় ত্রাস মুছে গেছে-চোখে মুখে সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধের দুর্জয় শক্তি প্রকাশিত হয়েছে। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ ১১) মেডিকেল হোস্টেলের ভিতর গায়ে-বানা জানাজা পড়া হয়। (প্রাগুক্ত, পৃ ১২) এদিন বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিষদ ভবন এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। (আজাদ , প্রাগুক্ত) তবু জানাজায় দশ সহস্রাধিক লোক উপস্থিত হয়। (আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত) ইমাম সাহেব মোনাজাত করলেন: ‘হে আল্লাহ আমাদের অতি প্রিয় শহীদানের আত্মা যেন চির শান্তি পায়। আর যে জালিমরা আমাদের প্রাণের প্রিয় ছেলেদের খুন করেছে তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায় তোমার দেওয়া এই দুনিয়ার বুক থেকে। (আবুল কাসেম ফজলুল হক,প্রাগুক্ত) জানাজার শেষে প্রায় হাজার লেকের এক শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রায় কর্মী ও যুবকগণ...শহীদের রক্তাক্ত জামা কাপড় লাঠির অগ্রভাগে বেধে মাতম করতে থাকে। পথ পার্শ্বের জনতা এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে বিক্ষুব্ধভাবে তাদের অনুসরণ করে। (সৈনিক ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) শোভাযাত্রার মাঝখানে পুলিশ হঠাৎ লাঠিচার্জ করার পরও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে গুলি চালায়। এখানেই হাইকোর্টের কেরানী শফিউর রহমান শহীদ হন। ছত্রভঙ্গ জনতা তখন... হাইকোর্ট আর কার্জন হলের দিকে আশ্রয় নেয়। শোভাযাত্রার এই অংশ সদরঘাট এলে পুনরায় তাদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয়। অনেকেই আহত হয়ে পড়ে রইল রাস্তার দু’পাশে। মিছিল মিটফোর্ড হয়ে চকবাজার দিয়ে মেডিকেল হোস্টেলে গিয়ে শেষ হয়। এইদিন জনসাধারণের বিভিন্ন অংশ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে দলবদ্ধ হয়ে শোভাযাত্রা বের করে ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাগুক্ত) এদিন শহরের প্রত্যেক মসজিদে জুম্মার নামাজের পর শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় হাজার হাজার মুসল্লি আজিমপুর কবরস্থান হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে জমায়েত হয়। জুম্মার নামাজের পর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এক বিরাট জনতার উপস্থিতিতে কোরআন তেলাওয়াতের পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তা সকালে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক এক বিরাট মিছিলে শান্তিপূর্ণভাবে যোগদানকারী জনতার ওপর বেপরোয়াভাবে গুলি চালানোর তীব্র প্রতিবাদ করেন। (আজাদ, প্রাগুক্ত) পূর্ববঙ্গ সরকারের এশতেহারে বলা হয়, ‘কার্জন হল, হাইকোর্ট, নবাবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রভৃতি স্থানে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি চালনার ফলে আহত মোট ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২ ব্যক্তি নিহত হয়। (আজাদ, প্রাগুক্ত) আজাদের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৪ জনের বেশি লোক শহীদ হয় (প্রাগুক্ত) সৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী শহীদানের সংখ্যা ৮ জন। (সৈনিক,প্রাগুক্ত) এদিন অপরাহ্ণে ব্যবস্থা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে গণপরিষদের নিকট বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। (আজাদ, প্রাগুক্ত) এদিন আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। (আজাদ,প্রাগুক্ত) ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরের সর্বত্র পূর্ণ হরতাল ও বিক্ষোভ চলতে থাকে। বহু মিলিটারি শহরের রাস্তাগুলিতে টহল দিতে থাকে। সেক্রেটারিয়েটসহ সকল অফিস আদালতে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। রাত ৮টা হতে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন প্রচলিত থাকে। (ইত্তেফাক ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) সরকারি স্বৈরাচারী আচরণের প্রতিবাদে এদিন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতি দেন। (প্রাগুক্ত) পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশও বিবৃতি দেয়। (আজাদ, প্রাগুক্ত) এদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদকে আন্দোলন চালানোর জন্য আবার পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। বেলা প্রায় ৩টার সময় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে কর্মপরিষদের সভা বসে। সভায় নয় দফা দাবি স্থিরীকৃত হয় এবং নুরুল আমিনের জঘন্য মিথ্যা বিবৃতির পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয়, আর প্রদেশের ও কেন্দ্রের আন্দোলনে যোগ সাধনের জন্য কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়। ...রাত্রে আজিমপুর কলোনিতে মেয়েরা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। ... প্রায় কয়েক হাজার মহিলা সভায় একত্রিত হয়ে সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ ১৩) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যেসব শহীদ বীর ২১ ও ২২ তারিখে পুলিশের গুলির আঘাতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটি রাঙিয়ে দিয়েছেন তাদের স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রগণ তাদের কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিজ হস্তে একরাত্রির মধ্যে ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। (আজাদ ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) ২৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামপুর রোড ও ঢাকা রেল স্টেশনের আরএমএস অফিসের নিকট জনতার ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে কয়েক ব্যক্তি আহত হয়। এদিন শহরে সান্ধ্য আইন কিছুটা শিথিল করে রাত্রি ৮টার বদলে ১০ হতে ভোর ৫টা পর্যন্ত করা হয়। সর্বত্র পুলিশ ও সামরিক প্রহরা পূর্ণ মাত্রায় বজায় থাকে। এদিন শহরের নানা স্থানে সরকারের সমালোচনামূলক নানা নতুন ধরণের প্রচারপত্র বিলি করা হয়। (আজাদ ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)
২৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পঞ্চম দিবসে ঢাকা শহরে সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এদিন পুলিশ তিনবার যুবলীগ অফিসে হানা দেয়। (আজাদ ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) এদিন পূর্ববঙ্গ সরকারের এক এশতেহারে বলা হয়, অদ্য ঢাকা শহরে কোনও গোলমাল হয়নি এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করে কোথাও কোনও শোভাযাত্রা বের হয়নি। এশতেহারে বলা হয়েছে, প্রদেশে আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের ষড়যন্ত্রের কয়েকজন নেতা এবং ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আরও কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। (আজাদ, প্রাগুক্ত) আজাদ পত্রিকার অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্রেপ্তাররা হলেনআবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের প্রাক্তন সম্পাদক আবুল হাশিম, মনোরঞ্জন ধর এবং গোবিন্দ লালা ব্যানার্জি। ক্রমাগত ধর্মঘটে অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের আর্থিক সংকটের আশংকা থাকায় এদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অপরাপর প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। কমিটির ৯ দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে ৯৬ ঘণ্টার সময় দেওয়া হয় এবং ৫ মার্চ প্রদেশের সর্বত্র শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। (আজাদ, প্রাগুক্ত) ‘নেতৃত্বের দিক থেকে আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ঘোষিত না হওয়ার ফলে এবং নেতৃত্বের প্রতি জনসাধারণের পর্যাপ্ত আস্থার অভাবে আন্দোলনে ধীরে ধীরে ভাটা আসতে থাকে। এ অবস্থায় ২৫ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ছাত্রদের হল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আন্দোলনের নেতাদের নামে প্রকাশ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আর ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তার চলতে থাকে। ...প্রধানত নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই পূর্ব বাংলার জনগণের ১৯৫২ সনের ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থান তখন কোনও সাফল্যজনক যৌক্তিক পরিণতি লাভ করতে পারেনি। নানা কৌশলে নুরুল আমিন সরকার এই গণঅভ্যুত্থান দমনে সক্ষম হয়। সর্বদলীয় কর্মপরিষদের আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায় ও আন্দোলনের চাপে সরকার ‘আন্দোলনের নেতাদের বন্দী করে রেখে সরকারি লোক দিয়ে এক ভুয়া তদন্ত কমিশন বসান’। সর্বদলীয় কর্মপরিষদ তা বর্জন করলেও আগেই তারা যেভাবে নেতৃত্ব হারিয়েছিলেন তাতে আন্দোলনের গতি অব্যাহত রাখা তখন আর তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ ১৩-১৪)
তবে কি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ ছিল? অবশ্যই নয়। এটা ঠিক আন্দোলনের তাৎক্ষণিক কোন ফল পাওয়া যায়নি, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফল অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের ফলে সরকারি দল মুসলিম লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় যুক্তফ্রন্টের কাছে। ৭ মে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে। সংবিধানের ২১৪ (১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়: ‘২১৪.(১) ‘The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali’ অর্থাৎ উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
বস্তুত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ রোপিত হয়। ’৬২-র সামরিক শাসন ও শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন,’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের সুবাদে জনগণের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা, বিস্তৃতি ও ব্যাপ্তি ঘটে। বাঙালিত্বের ভিত্তিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। এর ফলে ভাষা আন্দোলনের চেতনা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক